গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের দি হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিপক্ষে গাম্বিয়ার করা গণহত্যার মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এই তিন দিন আদালতের বাইরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ভিয়েনা থেকে গিয়ে সেখানে বাংলাদেশ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছি। আদালতের কার্যক্রম শেষ হতেই উড়ে এসেছি লন্ডনে। উপলক্ষ ব্রিটেনের নির্বাচনে সাক্ষী হওয়া শুধু নয়, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বাঙালীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার টিউলিপ সিদ্দিকের পাশে থাকা।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয়ে ভোটগ্রহণ চলে রাগ ১০টা পর্যন্ত। শুক্রবার স্থানীয় সময় ভোর থেকেই ভোটের ফল জানা যেতে থাকে। আর এখন তো সবার কাছেই স্পষ্ট যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে বরিস জনসনের দল কনজারভেটিভ পার্টি। যুক্তরাজ্যে গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটা ছিল তৃতীয় নির্বাচন। এই সাধারণ নির্বাচনটি ছিল মূলত ব্রেক্সিটের ভাগ্য নির্ধারণের ভোট। কনজারভেটিভ পার্টি যেমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তেমনি ভরাডুবি ঘটেছে লেবার পার্টির। অর্ধশতাধিক আসন খুইয়েছে তারা। কিন্তু এই দুঃসংবাদের মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়েছেন চার বাঙালী নারী। এমপি হিসেবে নির্বাচিত এই চার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নারী টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রূপা হক, রুশনারা আলী ও আফসানা বেগম। ব্রিটেনের নির্বাচনে বাঙালীর বিজয় পতাকা তুলে ধরলেন তারা।
লেবার পার্টির হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি নির্বাচিত হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তারা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাঙালীর জয়পতাকা উড়িয়ে জানিয়ে দিলেন ‘কম নয় বঙ্গনারী’। এর আগেও বাঙালীকে নতুন গর্বের সঙ্গী করেছেন রুশনারা আলী, রূপা হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আফসানা বেগম। বিজয়িনী চার বাঙালীকন্যাকে অভিনন্দন। ব্রিটিশ বাঙালী প্রজন্মের এই ‘চার কন্যা’ ভোটে লড়েছেন লেবার পার্টির হয়ে।
লন্ডনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসন হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্নে লেবার দলের প্রার্থী টিউলিপ পেয়েছেন ২৮ হাজার ৮০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের জনি লাক ভোট পেয়েছেন ১৩ হাজার ৮৯২। ২০১৫ সালে ১ হাজার ১৩৮ ভোটের ব্যবধানে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন টিউলিপ। ২০১৭ সালে ভোটে টিউলিপের জয়ের ব্যবধান বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৫৬০। এবার ১৪ হাজার ১৮৮ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে। একদিকে পারিবারিক পরিচয়, অন্যদিকে লন্ডনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে প্রার্থিতার কারণে টিউলিপ সব সময়ই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। ৩৭ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিককে পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। টিউলিপ প্রথমে ইংরেজী এবং পরে রাজনীতি, নীতি ও সরকার বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট নেতা বারাক ওবামার প্রচারাভিযানেও অংশ নেন। নির্বাচনে জয়ের পর এক টুইট বার্তায় টিউলিপ লিখেছেন, Thank you Hampstead & Kilburn for electing me once again. Thanks to all my volunteers & my family. But devastated by our national results- sorry to lose such talented MPs. Tough times ahead, we have to work together.
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব লন্ডনের ‘বেথনাল গ্রিন এ্যান্ড বো’ আসনে লেবার পার্টির বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থী রুশনারা আলী এবারও বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। রুশনারা আলীর প্রাপ্ত ভোট ৪৪ হাজার ৫২। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির নিকোলাস স্টোভোল্ট। তিনি পেয়েছেন ৬ হাজার ৫২৮ ভোট। ২০১০ সালের নির্বাচনে রুশনারা আলী প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ এমপি নির্বাচিত হন। তার ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বাংলাদেশীদের অভিষেক ঘটে। লেবার দলীয় রাজনীতিক রুশনারা এবার চতুর্থ দফায় ব্রিটিশ এমপি নির্বাচিত হলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী প্রথমবার নির্বাচিত হন ২০১০ সালের নির্বাচনে। সে সময় তিনি পার্লামেন্টারি ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য ছিলেন। কনজারভেটিভ সরকারের আমলেও তিনি বাংলাদেশ-বিষয়ক বাণিজ্য দূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণ এক কর্মজীবী বাঙালীর মেয়ে রুশনারা পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ডিগ্রী নিয়েছেন অক্সফোর্ডের সেইন্ট জন’স কলেজ থেকে।
পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাকটন আসনেও টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন লেবার এমপি রূপা হক, যার আদি বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। ৪৮ বছর বয়সী রূপা ২০১৫ সালের নির্বাচনে রক্ষণশীলদের হাত থেকে আসনটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি ব্যবধান বাড়িয়ে আসনটি ধরে রাখেন। আর এবার তিনি কনজারভেটিভ প্রার্থী জুলিয়ান গ্যালান্টকে হারিয়েছেন ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে। রূপ হক ক্যামব্রিজে রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন পড়েছেন। তিনি পড়াচ্ছেন সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের মতো বিষয়। শিক্ষক রূপা এর আগে ডেপুটি মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পূর্ব লন্ডনের পপলার এ্যান্ড লাইমহাউজ আসন থেকে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশী আরেক কন্যা আফসানা বেগম। লেবার দলের প্রার্থী আফসানা পেয়েছেন ৩৮ হাজার ৬৬০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী শন ওক পেয়েছেন ৯ হাজার ৭৫৬ ভোট। প্রথমবারই বিপুল ব্যবধানে জয় পেলেন আফসানা। আফসানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসে হলেও বাংলাদেশে তাদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আবাসন বিভাগে চাকরি করছিলেন তিনি।
এবারই প্রথম চারজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছেন গণতন্ত্রের সূতিকাগারে। তিন দল থেকে মোট সাতজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশ নিলেও লেবারের চার কন্যা ছাড়া জয় পাননি কেউ। লেবার পার্টি থেকেই তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের বেকেনহাম আসনে নির্বাচন করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ব্যারিস্টার মেরিনা আহমেদ। এবারও তিনি কনজারভেটিভ প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন বড় ব্যবধানে। কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে জয় পেলেও এ দলের একমাত্র বাঙালী প্রার্থী আনোয়ারা আলী নিজের আসনে ভোটে জিততে পারেননি। হ্যারো ওয়েস্ট আসনে তিনি লেবার প্রার্থীর কাছে হেরেছেন নয় হাজার ভোটের ব্যবধানে। আর মৌলভীবাজারের মেয়ে বাবলিন মল্লিক লিবডেমের মনোনয়নে প্রার্থী হয়েছিলেন কার্ডিফ সেন্ট্রাল আসন থেকে। তার অবস্থান এবার তৃতীয়।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে লন্ডনের বাঙালী কমিউনিটির পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ ছিল। কারণ এবারের নির্বাচনে বাঙালী প্রার্থী ছিলেন ১১ জন। এই ১১ জনের সাতজনই লেবার পার্টির প্রার্থী। লিবারেল ডেমোক্রেটিক থেকে তিনজন এবং ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ থেকে প্রার্থী ছিলেন মাত্র একজন। আজকের দিনে ব্রিটেনের মতো দেশেও ধর্মান্ধগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে ব্রিটেনের জনগণ। আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিলাতের রাজনীতিতে বাঙালীর অগ্রযাত্রার নতুন দিগন্ত সূচিত হলো। এই অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন চার বাঙালী নারী। অভিনন্দন এই বাঙালী নারীদের।