গভীর সমুদ্রে ‘ডার্ক অক্সিজেন’: দ্বিধা-বিভক্ত বিজ্ঞানীরা

সূর্যের আলো ছাড়াই সমুদ্রের গভীর অন্ধকারতম স্থানে অবস্থিত ধাতব শিলা কি অক্সিজেন তৈরি করতে পারে? কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন সমুদ্রের আলোহীন অতল গহ্বরে ধাতব বস্তুগুলো অক্সিজেন তৈরি করতে পারে, যাকে ‘ডার্ক অক্সিজেন’ বলা হয়। তবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তথাকথিত এই ‘ডার্ক অক্সিজেন’ উৎপন্ন হওয়ার দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপি’র এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানিয়েছে। খবর বাসস।

নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে গত জুলাইয়ে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত এই আবিষ্কার পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং তীব্র বৈজ্ঞানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

পলিমেটালিক নোডুলের মধ্যে থাকা মূল্যবান ধাতু বের করতে আগ্রহী খনি কোম্পানিগুলোর জন্যও এই গবেষণার ফলাফল ফলপ্রসূ ছিল। এই গবেষণা দীর্ঘদিনের ধারণার ওপর সন্দেহ তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল, অক্সিজেন কেবল সূর্যের আলোতে উদ্ভিদ বা শৈবালসহ সালোকসংশ্লেণকারী প্রাণীরাই তৈরি করতে পারে। যাকে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বলা হয়।

অপরদিকে নতুন এই আবিষ্কারকরা বিশ্বাস করেন, জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই অক্সিজেন অন্ধকারে ধাতব পিণ্ড দ্বারাও তৈরি হতে পারে। স্কটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেরিন সায়েন্সের বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু সুইটম্যান ও তার দল এ ডার্ক অক্সিজেন আবিষ্কার করেন।

মেক্সিকো ও হাওয়াইয়ের মধ্যবর্তী প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল জলরাশি অঞ্চল ক্লারিওন-ক্লিপারটন জোনে এই অক্সিজেন আবিষ্কার করা হয়েছে। এটা নিয়ে খনি কোম্পানিগুলোর মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে।

সমুদ্রতলে চার কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পলিমেটালিক নোডুলগুলোতে ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল কোবাল্ট, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি ও অন্যান্য নিম্ন-কার্বন প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ধাতু রয়েছে।

যে গবেষণাটি ‘ডার্ক অক্সিজেন’ আবিষ্কারের জন্ম দিয়েছে, তাতে কানাডিয়ান গভীর সমুদ্র খনির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘দ্য মেটালস কোম্পানি’ আংশিকভাবে অর্থায়ন করেছে। তারা এই ধরনের অনুসন্ধানের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করতে চেয়েছিল।

কোম্পানিটি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রবিদ অ্যান্ড্রু সুইটম্যান ও তার দলের গবেষণার তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, এটিতে ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’ রয়েছে।

নাজুক বাস্তুতন্ত্র

পরিবেশবিদরা বলেছেন, ডার্ক অক্সিজেনের উপস্থিতি দেখিয়েছে, সমুদ্রের একদম গভীরে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে কতটা কম জানা গেছে। এই আবিষ্কার গভীর সমুদ্র খনন কাজকে অগ্রহণযোগ্য পরিবেশগত ঝুঁকি হিসেবে মনে করে।

গ্রিনপিস নামে একটি পরিবেশবাদী সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে সমুদ্র খনন বন্ধ করতে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘এটি নাজুক কাজ, গভীর সমুদ্রে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে।’

‘ডার্ক অক্সিজেন’ এর আবিষ্কার গভীর সমুদ্র খনন বন্ধের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে বলে জানায় গ্রিনপিস।

বৈজ্ঞানিক সন্দেহ

সুইটম্যানের এই আবিষ্কার বিস্ফোরক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু তারপরও বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের অনেকেই এই সিদ্ধান্তের প্রতি আপত্তি প্রকাশ করেছেন অথবা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

গত জুলাই থেকে সুইটম্যানের আবিষ্কারকে খণ্ডনকারী পাঁচটি অ্যাকাডেমিক গবেষণাপত্র পর্যালোচনা ও প্রকাশনার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে।

জার্মানির কিয়েলে অবস্থিত জিওমার হেলমহোল্টজ সেন্টার ফর ওশান রিসার্চের জৈব-রসায়নবিদ ম্যাথিয়াস হেকেল বলেছেন, তিনি (সুইটম্যান) তার পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের জন্য স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেন নি।

হেকেল বলেন, ‘গবেষণাটি প্রকাশের পরও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। তাই, এখন বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের অনুরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি পরিচালনা করে হয় এটি প্রমাণ অথবা খণ্ডন করা উচিত।’

ফরাসি জাতীয় মহাসাগর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট ইফ্রেমারের ভূ-রসায়ন গবেষক অলিভিয়ার রাউক্সেল এএফপি’কে বলেছেন, ‘এই ফলাফলগুলোর ওপর একেবারেই কোনো ঐকমত্য নেই।’

তিনি বলেন, ‘গভীর সমুদ্রের নমুনা সর্বদা একটি চ্যালেঞ্জ। এটা হতে পারে, অক্সিজেন পরিমাপ যন্ত্রগুলোতে বায়ু বুদবুদ আটকে ছিল।’

এএফপি সুইটম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুতির কথা জানান।

তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক নিবন্ধগুলোতে এই ধরনের এদিক-সেদিক করা খুবই সাধারণ এবং এটি বিষয়বস্তুকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − 3 =