মাহবুব আলম
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরায়েলের উপর হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। ফিলিস্তিনি জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। তারা তাদের ভূখণ্ড অন্যের বসতিতে পরিণত হতে এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশাও ধুলায় মিশে গেছে। এ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, হামাসের হামলা ন্যায়সঙ্গত।
জাতিসংঘের ঘোষণাতেই আছে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে সশস্ত্র লড়াই বৈধ, আইনসম্মত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক পাশ্চাত্য দুনিয়ায় অধিকাংশ দেশ এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে হামাসকে সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন বলে হামাসের হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বর্ণনা করেছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও হামাসকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে তাদের হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ ইসরায়েলের বর্বরতা তাদের চোখে পড়ছে না। তাদের চোখে পড়ছে না ইসরায়েলের একের পর এক গণহত্যা।
যুদ্ধেরও একটা নিয়ম আছে। ইসরায়েল কোনদিন কখনোই সেই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র জনগণের উপর নির্বিচারের গুলি ও বোমা বর্ষণ করছে। বোমা বর্ষণ করছে, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, রেডক্রসের সেবা দানকারী ও আশ্রয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্য দুনিয়া দেখেও না দেখার ভান করছে। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের এই অবৈধ কার্যকলাপ এমন কি গণহত্যাকে সমর্থন দিচ্ছে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের নামে। সর্বশেষ গাজায় যে বর্বরতা চালাচ্ছে ইসরাইল একে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন প্রকাশ্যে সমর্থন করছে এবং ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সহযোগিতার জন্য ২০০০ সেনাসহ রণতরী প্রেরণ করেছে।
৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইসরায়েলের বিমান ও বোমা হামলায় প্রায় ৯ হাজার নিহত হয়েছে। এরমধ্যে চায় সহস্রাধিক শিশু। এই বিমান ও বোমা হামলা কার্যত গণহত্যা। কারণ এই হামলা হচ্ছে নিরস্ত্র জনতার উপর, বসতির উপর, হাসপাতালের আশ্রয় কেন্দ্র উদ্বাস্তু শিবিরের উপর। গাজায় মহা মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খাদ্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংকটে মানুষ অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তারপরও ত্রাণ সরবরাহে বাধা দান ও যুদ্ধবিরতিতে অসম্মতি জানাচ্ছে ইসরায়েল। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস করার পরও জাতিসংঘের এই প্রস্তাবকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এ বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রাশিয়ার চেষ্টাকে বারবার ভন্ডুল করে দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বলছে তারা যুদ্ধবিরতি চায় না।
এই অবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কি হবে? বিশেষ করে গাজায় ২২ লাখ মানুষের কি হবে? এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল কি গাজায় ২২ লাখ মানুষকে শেষ করে দেবে? সব মানুষকেই কি হত্যা করবে? হ্যাঁ, সম্ভব হলে তাই করবে এবং সেই চেষ্টাই করছে। ইসরাইলের অতীত ইতিহাস ও আচরণ সে কথাই বলে। এখন প্রশ্ন হল এটা কি সম্ভব? না কোনমতেই সম্ভব নয়। আর এটা যে সম্ভব নয়, ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ দিয়েছে হামাস যোদ্ধারা। হামাস যোদ্ধারা প্রমাণ করেছে ইসরায়েল যত শক্তিশালী হোক না কেন গাজায় তাদের চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা ও সাহস আছে। ইতিমধ্যে হামাস যোদ্ধাদের হাতে ১৪০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। আটক হয়েছে মার্কিন নাগরিকসহ দুই শতাধিক। আর তাই এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। তবে যুদ্ধে জয় পরাজয় কি হবে তা নিশ্চিত করে এখনই বলা কঠিন। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় সেক্ষেত্রে এই যুদ্ধ পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।
একটা বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নেবে। ইতিমধ্যে সিরিয়া, ইরাক, নেমালন ও ইয়েমেনে যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল সিরিয়ায় বিমান হামলা করছে। লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লার সঙ্গে লড়াই করছে। সেই সাথে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ঘাটিতে হামলার পর হামলার ঘটনা ঘটছে। এরপর রয়েছে ইরানের সঙ্গে বৈরীতা। শুধু বৈরীতা বললে যথেষ্ট বলা হয় না। বরং বলা উচিত ইরানের সঙ্গে রয়েছে ইসরায়েলের যুদ্ধংদেহি মনোভাব। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ভষ্মে ঘি ঢালছে। ফলে একটি বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই।
শেষ পর্যন্ত যদি তাই হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্য এক মহাবিপর্যয় দেখা দেবে। কারণ এতে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। যেমনটি হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে দুর্বল করে রাশিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করার মার্কিন চক্রান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ন্যাটো ও ইইউভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে এখন কঠিন মূল্য দিচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি সংকটে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানিসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশকেই এক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে আকাশচুম্বী। এই অবস্থায় এইসব দেশে জনগণের ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেটে পড়ি। এই অভিজ্ঞতা থেকে কম বেশি সবাই শিক্ষা নেবে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধের উস্কানিতে পা না দেওয়াই কথা। তারপরও একটা কথা আছে, প্রেম আর যুদ্ধ কোনো ব্যাকরণ কোনো যুক্তি মানে না। মানে না বিবেকের দংশন নিষেধাজ্ঞাও। তাই শেষ পর্যন্ত কি হবে এই নিয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। তবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার কোনো সমাধান নেই। সেই সমাধান যদি আলাপ-আলোচনা করে হয় তাহলে উত্তম। তবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেক্ষেত্রে লড়াই একমাত্র পথ, যে পথ বেছে নিয়েছে হামাস। হামাসের পথই পথ চিনিয়ে দেবে ফিলিস্তিনিদের। সেইসঙ্গে আরব বিশ্বকেও। যে আরব বিশ্ব বছরের পর বছর মার্কিন হুমকি আর ইসরায়েলের আক্রমণের ভয়ে-ভীতি হয়ে শামুকের খোলে ঢুকে পড়েছে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক