গৃহসজ্জায় ইনডোর প্ল্যান্ট

ময়ূরাক্ষী সেন

নিজের ঘরকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে আমাদের কত আয়োজন। কর্মব্যস্ত দিনের পর যান্ত্রিক শহর থেকে ছুটি নিয়ে আমরা ঘরে ফিরি, আর সেই ঘর যাতে প্রশান্তি দেয় তা সবাই চায়। তাই তো কয়েক বছর ধরে ঘর সাজাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইনডোর প্ল্যান্ট। এটি আপনার ঘরকে শুধু আকর্ষণীয় করে তুলবে তা নয়, ইনডোর প্ল্যান্টের রয়েছে অনেক উপকারিতা।

মানসিক চাপ কমায়

প্রায় সবাইকে নানারকম মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কাজের চাপ, পড়ালেখা, নিত্যনতুন ঝামেলা ইত্যাদি; যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেয় ইনডোর প্ল্যান্ট। সাধারণত গাছপালা মানুষকে প্রশান্তি দেয় ও মনের চাপ কমায়। তাই সে গাছ যদি থাকে আপনার ঘরেই থাকে তাহলে দিন শেষে বাড়ি ফিরে কিছুটা প্রশান্তি উপভোগ করা যাবে। তাছাড়া গাছপালা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

বাতাস বিশুদ্ধ করে

গবেষণায় দেখা গেছে ইনডোর প্ল্যান্ট পরিবেশের ক্ষতিকর দ্রব্য কার্বন মনোক্সাইড, ফর্মালডিহাইড, অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাই অক্সাইডসহ আরও অনেক কিছু দূর করতে সাহায্য করে। এই পদার্থগুলো আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটির জন্যই ক্ষতিকর। ইনডোর প্ল্যান্ট ঘরের অক্সিজেনকে বিশুদ্ধ করে।

সাশ্রয়ী

অ্যালোভেরা, পুদিনা, তুলসী ইত্যাদির মতো কিছু ইনডোর গাছ ঘরে থাকলে খুব সহজেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে রূপচর্চা করা যায়। ঘরের খালি স্থান কিভাবে সাজাবো এটি নিয়ে প্রায় অনেকেরই চিন্তায় মধ্যে পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে ইনডোর প্ল্যান্টের চেয়ে সাশ্রয়ী কিছুই হতে পারে না। ইনডোর প্ল্যান্ট বলতে আমরা সেসব গাছকে বুঝি যারা কম আলো বাতাস ছাড়াই ঘরের মধ্যে বেড়ে উঠতে পারে। তাই সব ধরনের গাছ চাইলেই ঘরের মধ্যে রাখা সম্ভব হয় না। জনপ্রিয় কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট হলো:

মানি প্ল্যান্ট

অনেকে মনে করে থাকেন মানি প্ল্যান্ট থাকলে নাকি ঘরে টাকা আসে। এ বিষয়ে সত্যতা না পাওয়া গেলেও এ গাছের রয়েছে রয়েছে অনেক গুণ। ঘরে যারা গাছ রাখতে ভালোবাসেন তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও পরিচিত নাম হচ্ছে মানি প্ল্যান্ট। এটি খুব কম যত্নে বেড়ে উঠতে পারে। মানি প্ল্যান্টের খুব বেশি আলোর প্রয়োজন হয় না, তবে জানালার পাশে রাখলে এটি তুলনামূলক বেশি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মানি প্ল্যান্ট ঠান্ডার চাইতে গরম পরিবেশে সবচেয়ে বেশি ভালো থাকে। তাপমাত্রা যদি ৫৫ ফারেনহাইটের নিচে নেমে যায় তবে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।

এরিকা পাম

অফিস রুম, ঘরের বড় রুমের শোভা বাড়াতে এরিকা পামের জুড়ি মেলা ভার। এরিকা এক প্রজাতির পাম জাতীয় গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম ডিপসিস লুটেসেন্স। টবে লাগালে এ গাছ ৫/৬ ফুট লম্বা হয়। এরিকা ইনডোরের গাছ হলেও এর কিছুটা আলোর প্রয়োজন হয়। তাই এটি একদম অন্ধকার ঘরে রাখা উচিত না। তাই এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে কিছুটা আলো বাতাস চলাফেরার সুযোগ পায়। এ গাছে পোকামাকড়ের উৎপাত তুলনামূলক অন্য গাছের চেয়ে কম হয়। এমনিতে ব্যাকটেরিয়াও এ গাছে কম হয়ে থাকে।

স্পাইডার প্ল্যান্ট

এ গাছের আদি বাসস্থান আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। স্পাইডার প্ল্যান্ট প্রায় বারো থেকে আঠারো ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বছরের একটি সময় এ গাছ থেকে লম্বা স্পাইক বের হয় যা দেখতে অনেকটা মাকড়সার জালের মতো। তাই হয়তো এ গাছের নামকরণ করা হয়েছে স্পাইডার প্ল্যান্ট। অনেকে এ গাছকে রিবন প্লান্ট নামেও চিনে থাকে। এ গাছের প্রায় ২০০ রকমের জাত রয়েছে। তবে সব জাতের স্পাইডার প্ল্যান্ট ঘরে রাখা যায় না। ২০০ জাতের মধ্যে কয়েকটি জাত ইনডোরের জন্য উপযুক্ত। এ গাছ কড়া রোদ সহ্য করতে পারে না। তাই ঘরের এমন স্থানে রাখতে হবে যে স্থানে খুব কড়া রোদ যাতে না পৌঁছাতে পারে। মাঝে মধ্যে এর পাতা শুকিয়ে হলুদ হয়ে যায়, আবার নিজেই তা ঠিক হয়ে যায়।

অ্যালোভেরা

অ্যালোভেরা যে একটি চমৎকার ইনডোর প্ল্যান্ট তা অনেকেরই অজানা। এটি লিলি প্রজাতির উদ্ভিদ। এটির আরেক নাম ঘৃতকুমারী। এই গাছ ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। অ্যালোভেরার পাতা ১০ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই গাছের প্রচুর ঔষধি গুণ রয়েছে, এছাড়া রূপচর্চাতে অ্যালোভেরার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। অ্যালোভেরা পাতার মধ্যে ঘন এক রকম পিচ্ছিল শাঁস বা জেলির মতো রয়েছে। মূলত তার মধ্যেই রয়েছে সব উপকারিতা। ত্বকের যেকোনো সমস্যার জন্য অ্যালোভেরা বেশ উপকারী। এছাড়া ওজন কমাতে, হজম শক্তি বাড়াতে, ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ হাজার ধরনের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে অ্যালোভেরা। তাই ঘরের মধ্যে একটা অ্যালোভেরা গাছ রেখে দিলে খুব সহজে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়।

লাকি ব্যাম্বু

অনেকেই এই গাছ ঘরে রাখাকে সৌভাগ্য মনে করেন, তাই এর নামও দেওয়া হয়েছে লাকি ব্যাম্বু। এ গাছ ২-৩ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে। এর কান্ডগুলো দেখতে অনেকটা বাঁশের মতো হয়ে থাকে। অন্যসব গাছের মতো এটিও এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে খুব বেশি রোদ যাতে না থাকে। এ গাছ মাটির পাশাপাশি পানিতেও হয়ে থাকে।

ক্যাকটাস

এ গাছ ইদানীং ইনডোরের জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মরুভূমির পরিবেশের গাছ বলে এটির জন্য খুব বেশি পানি কিংবা যত্নের প্রয়োজন হয় না। তবে ক্যাকটাস গাছের দিনে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা উজ্জ্বল আলোর প্রয়োজন হয়। আবার অনেক ক্যাকটাস অতিরিক্ত আলো সহ্য করতে পারে না। তাই ক্যাকটাস গাছ কেনার আগে ক্যাকটাসের জাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখতে হবে। মাটিতে পানি জমলে ক্যাকটাস বাড়তে পারে না, তাই সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। এ গাছে সার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

গাছ দিয়ে কিভাবে ঘর সাজাবেন

আপনার ঘরের জন্য কোন ধরনের ইনডোর প্ল্যান্ট বেছে নিবেন তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার পছন্দ এবং ঘরে কতটুকু স্থান রয়েছে। যেমন এরিকা পাম রাখার জন্য ঘরে পর্যাপ্ত স্থান থাকা চাই। আবার ম্যান্টি প্ল্যান্ট ও ক্যাকটাসের মতো গাছের খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। ইনডোর প্ল্যান্টের টবের মধ্যে আনতে পারেন ভিন্নতা। পাটের টব কিনে আপনার পছন্দের গাছটি সেখানে রাখতে পারেন, তাহলে সেটি ঘরের শোপিস হিসেবেও কাজ করবে। এছাড়া ঘরের বিভিন্ন স্থানে গাছ ঝুলিয়ে দিতে পারেন তাতে জায়গার প্রয়োজন হবে না। অনেক সময় খাটের মাথায় কিছু জায়গা থাকে সেখানেও ক্যাকটাস গাছ দিয়ে সাজানো যেতে পারে। যেসব গাছ পানিতে বেড়ে উঠে সেসব গাছ কোনো কাচের জারে পানি দিয়ে বুক সেলফে সাজিয়ে রাখা যেতে পারে। রান্নাঘরের তাকেও মানি প্ল্যান্ট রাখতে পারেন। এতে আপনার রান্না ঘরটিও সবার নজর কাড়বে।

গাছের যত্ন

বলা হয়ে থাকে ইনডোর প্ল্যান্টের তেমন যত্নের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কিছু বিষয়ের দিকে খেয়াল না রাখলে গাছ ঠিক মতো বেড়ে উঠে না কিংবা মারা যায়। ইনডোর গাছে অতিরিক্ত পানি দিলে গাছের পাতা পচে যায়। তাই মাটি শুকানোর আগে কখনও পানি দেওয়া উচিত না। আবার প্রয়োজন মতো পানি না দিলেও গাছ তার প্রাণ হারায়। গাছ সজীবতা হারালে তাতে কয়েক দিন নিয়মিত পানি দিতে হবে। অনেক সময় গাছে ফাঙ্গাস হয়। সেক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে গাছ বারান্দা কিংবা রোদে রাখতে হবে। গাছে পানি দেওয়ার আগে টবের মাটি চেপে দেখতে হবে ভেজা ভাব আছে কি না। ভেজা ভাব থাকলে পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

গাছে জীবাণুনাশক স্প্রে দিতে হবে, এতে পোকামাকড় থাকবে না। গাছের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যাতে সারারাত পানি জমে না থাকে। তাতে গাছের গোড়া পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেকে কোনো গাছ মরে গেলে মন খারাপ করে সে গাছ তুলে ফেলে, কিন্তু গাছ মরে যাওয়ার সাথে সাথে না তুলে ধৈর্য সহকারে আরো কিছুদিন যত্ন করতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টেরিয়ার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five − four =