গৃহসজ্জায় বেতের আসবাব

মাধবী লতা

শান্তা ও সামিন সদ্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। শুরু হয়েছে নিজেদের নতুন সংসার। কিন্তু কীভাবে বাজেটের মধ্যে কিন্তু সুন্দর করে ঘর সাজানো তা নিয়ে বেশ চিন্তিত দুজনেই। একদিন শান্তা এক কলিগের সাথে গল্প করার সময় জানতে পারলো খুব কম খরচেই বেতের আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানো যায়। শান্তা আর দেরি না করে সামিনের সাথে আলোচনা করে বেতের আসবাবপত্র কিনতে চলে গেলো। ঘরের প্রায় ৭০ শতাংশ জিনিসই তারা বেত দিয়ে সাজালো। তাদের ছোট ঘরটি অনেক বেশি নান্দনিক হয়ে যায়। কোনো মেহমান আসলে তাদের ঘরের প্রশংসা সবাই করে। তারা তাদের বারান্দায় রেখেছে বেতের চেয়ার। সেই বেতের চেয়ারে বসে চা খেয়ে তাদের ছুটির দিনের সন্ধ্যাগুলো দারুন কাটে।

শুধু শান্তা ও সামিন না এখন অনেকেই ঘর সাজাতে বেছে নিচ্ছেন বেতের আসবাবপত্র। সাধারণ একটা বেতের চেয়ার ঘরের শোভা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। চাইলে পুরো ঘরও বেত দিয়ে সাজানো যেতে পারে। খাট, সোফা, ডাইনিং টেবিল, সাধারণ টেবিল, চেয়ার, মোড়া, দোলনা থেকে শুরু করে আলনা, ওয়্যারড্রব, ডিভান পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে বাঁশ ও বেত দিয়ে। বেতের আসবাবপত্র বেশকিছু উপকারিতাও রয়েছে। বেত একটি প্রাকৃতিক উপাদান, যারা নিজের বাড়ি নিয়ে সচেতন তাদের জন্য বেতের আসবাবপত্র দারুন পছন্দের। অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণের মতো ছিদ্রযুক্ত নয় এবং আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যান্য প্রাকৃতিক পণ্যের তুলনায় বৃষ্টি এবং বাতাসের মতো প্রাকৃতিক উপাদানকে ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারে। অনেকের মধ্যে ভুল ধারনা রয়েছে যে বেতের আসবাবপত্র হয়তো বেশি টেকসই হয় না। কিন্তু এটা পুরোপুরি ভুল ভাবনা। বেতের আসবাবপত্র বেশ টেকসই, প্রায় ১০ বছর। সঠিক যত্ন নিলে ভালো থাকে।

বেতের আসবাবপত্র একসময় প্রচুর চাহিদা ছিল। গবেষণায় জানা গেছে ১৮৮৫ সালের দিকে এ দেশে সর্বপ্রথম বেতের আসবাবপত্রের নকশা করা হয়। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত শুধু সিলেটের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বেতের চাষ হতো। সিলেট বাদে আর কোনো এলাকায় বেতের চাষ তেমন হতো না। তাই অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ সিলেট থেকে বেত সংগ্রহ করে বেতের চাহিদা পূরণ করতো। এছাড়া মিয়ানমার থেকেও প্রতি বছর বেত আমদানি করা হয়। বেতের পণ্য তৈরিতে ছয় ধরনের বেত প্রয়োজন। মোতরা বেত বা গোল্লা বেত, ভুতুম বেত, জালি বেত, বরা বেত ও লতা বেত। এইসব বেত দিয়ে পণ্য দিয়ে হয়। এছাড়া বাকি বেত দিয়ে তেমন ভালো মানের পণ্য তৈরি করা যায় না। যারা এই বেত দিয়ে বিভিন্ন অনুষঙ্গ তৈরি করে তাদের বলা হয় বেত বুননশিল্পী।

বেত বুননশিল্পীরা এখন তাদের ডিজাইনের মধ্যে ভিন্নতা আনছে। একঘেয়ে ডিজাইন থেকে বের হয়ে বেতের আসবাবপত্রে আনা হচ্ছে বৈচিত্র্যময় নকশা। ফলে বেতের আসবাবপত্র নজর কাড়ছে সৌখিন মানুষদের। ড্রয়িং রুম গর্জিয়াস করে সাজাতে চাইলে ভারী কাজের বেতের সোফা সেট বানানো হয়ে থাকে। এছাড়া পাওয়া যায় ডাবল রঙের বেতের আসবাবপত্র। বেতের আসবাবপত্র সাধারণত বাদামি বা বেইজ রঙের হয়। কিন্তু ডাবল রঙের বেতের আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে বেতের স্ট্রিপগুলিতে একটি বাইরের প্রাইমার প্রলেপ ব্যবহার করে ভিন্নভাবে রঙিন করা হয়। এছাড়াও সাদা ধবধবে বেতের আসবাবপত্র দেখা যায়। অনেকেই নিজের ঘরকে দিতে চান শুভ্রতার ছোঁয়া, তারা এ ধরনের বেতের আসবাবপত্র বেছে নিতে পারেন। অনেকেই বড় বারান্দা দোলনা দিয়ে সাজাতে পছন্দ করেন। বেতের দোলনার সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না। অনেকেই ফুল দিয়ে ঘর সাজাতে পছন্দ করেন। বেতের ফুলদানি ব্যবহার করলে ঘরের সৌন্দর্য বাড়বে।

বাড়িতে বেতের আসবাবপত্র ব্যবহারে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। বেতের আসবাবপত্র মজুবত কিন্তু গড়ন হালকা তাই এটি খুব সহজে একস্থান থেকে আরেক স্থানে বহন করা যায়। বেত অত্যন্ত টেকসই এবং বেতের যেকোনো জিনিস খুব পরিবেশবান্ধব। বেতের আসবাবপত্রে খুব সহজে ধুলোবালি জমে না, পরিষ্কার করা অন্যান্য আসবাবপত্র থেকে তুলনামূলক সহজ। রোদ, বৃষ্টিতে বেতের আসবাবপত্র খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। এজন্য বারান্দা কিংবা বাড়ির ছাদে বেতের আসবাবপত্র নিশ্চিতে রাখা যায়। বেতের আসবাবপত্র বেশ সাশ্রয়ী, জায়গা কিছুটা কম দখল করে। যারা নিজের ঘরকে নান্দনিক করে তুলতে চান তারা বেছে নিতে পারেন বেতের আসবাবপত্র।

বেতের আসবাবপত্রের জন্য কিনতে হয় মানানসই ফোম ও কুশন। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফোমের মধ্যে কারমো, এপেক্স, আখতার ইত্যাদির চাহিদা বেশি, মানও ভালো। তবে বেতের আসবাবপত্রের ফোম কিনতে হবে বুঝে-শুনে। কুশনের রঙের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেকোনো উজ্জল রঙ যেমন লাল, বেগুনি, কমলা, হলুদ, মেরুন, রয়েল ব্লু, সবুজ, ফিরোজা ইত্যাদি বেতের আসবাবপত্র সাথে ফুটে উঠে। বেতের আসবাবপত্রের রঙ মলিন হয়ে থাকে তাই হালকা রঙের কুশন এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

বেতের জিনিসের যত্ন নিতে হবে বিশেষভাবে। তাহলে বেত ভালো থাকবে বছরের পর বছর। বেতের আসবাবপত্র যেকোনো স্থানে রাখা গেলেও যে স্থানে বাতাস বেশি চলাফেরা করে সেসব স্থানে রাখার চেষ্টা করতে হবে। বেতের আসবাবপত্রে উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে অলিভ অয়েল বেশ কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। অলিভ অয়েল একটি পরিষ্কার কাপড়ে নিয়ে ঘষে ঘষে সপ্তাহে একদিন পরিষ্কার করলেই যথেষ্ট। পানি বেতের খুব একটা ক্ষতি না করলেও চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব পানি এড়িয়ে চলা যায়। আসবাবপত্র তেমন মেরামতের ঝামেলা নেই বললেই চলে। বেতে আসবাবপত্র মূলত বেঁধে বানানো হয় তাই বাঁধন খুলে যাওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে। বাঁধন খুলে গেলে আবার বাঁধিয়ে রঙ করিয়ে নিলেই নতুনের মতো হয়ে যায়।

বেতের আসবাবপত্র এখন প্রায় সব জায়গাই খুব সহজে পাওয়া যায়। ঢাকার গ্রিন রোড, ইস্কাটন রোড, মিরপুর, ধানমন্ডি, সোনারগাঁও রোডের বিভিন্ন স্থানে বেতের আসবাবপত্রের দোকান রয়েছে। এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন পেইজে বেতের আসবাবপত্র পাওয়া যাচ্ছে। দাম নির্ভর করছে এর মান ও ডিজাইনের উপর। এছাড়া যারা বেতের আসবাবপত্র তৈরি করে তাদের সাথে কথা বলে নিজের মনমতো ডিজাইনে কাস্টমাইজ করে নেওয়া সম্ভব। বেতের আসবাবপত্র একসময় খুব কম দামে পাওয়া গেলেও সময়ের সাথে সাথে এর দাম কিছুটা বেড়েছে।

চেয়ার-টেবিল সেট ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। সোফা সেটের দাম ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। দোলনা ২ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। মোড়া ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা মধ্যে পাওয়া যাবে। খাট এবং ডিভান ৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। ঝুড়ি পাওয়া যাবে ৫০০ থেকে ৩০০০ হাজার টাকার মধ্যেই। কিছু দোকানে দামাদামি করে দাম কিছুটা কমানো যায়।

প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেতের জিনিস বিক্রি করছেন আল মাহমুদ। তার দাদা ছিলেন একজন বেত বুননশিল্পী। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তিনি এই পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি বলেন, একটা সময় বেতের জিনিস এনে তিনি সারতে পারতেন না। সাথে সাথে সব বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু এখন চাহিদা দিন দিন কমে আসছে। এমন মাসও গেছে একটা বেতের জিনিসও বিক্রি হয়নি। তাই তিনি সবাইকে আহ্বান করেন ঘরের কোণায় একটা ছোট বেতের জিনিস হলেও রাখতে। তাহলেই আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটা বেঁচে যাবে।

অনেক বছর আগে ঘর সাজানোর সামগ্রী বলতে ছিল শুধু বেত ও বাঁশের আসবাবপত্র। তখন এতো নামি দামি ফার্নিচার ছিল না। কারিগররা নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে বেত ও বাঁশের আসবাবপত্র তৈরি করতো। তখন এর বেশ কদর ছিল। বেতের আসবাবপত্র আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। সিলেট নগরের ঘাসিটুলা এলাকায় বেত বুননশিল্পীদের বিশাল আস্তানা রয়েছে। ঘাসিটুলা গেলে দেখা যায় বেতের তৈরি নানা জিনিসপত্র। ঐতিহ্যবাহী বেত বুননশিল্পের বেশ কয়েকটি দোকান এখনও টিকে আছে। বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা আগের মতো না থাকাতে ও বুননশিল্পীরা অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতায় না পাওয়ায় এই শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। ঘাসিটুলা এলাকার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে নারীরাও বেত দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করেন। আর্থিকভাবে সহযোগিতা পেলে এই শিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। সত্যি বলতে এরা কোনো ধরনের সহযোগিতাই পায় না। সবার উচিত এই বুননশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখা। না হলে চাহিদার অভাবে একদিন এই শিল্প পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইনটেরিয়র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × 4 =