গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকটের বিড়ম্বনা

সালেক সুফী

চলমান গ্রীষ্মকালে বহমান তাপদাহের সময় বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাম অঞ্চলে চলছে বিদ্যুৎ দুর্ভিক্ষ।  অধিকাংশ গ্রামে দিনে ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। কোথাও কোথাও ৮-১০ ঘণ্টা।  শুধু গ্রামাঞ্চল বলি কেন ঢাকা মহানগরী এবং কয়েকটি প্রধান শহর ছাড়া দেশজুড়ে রুরাল ইলেট্রিফিকেশন বোর্ডের আওতাধীন বিস্তীর্ণ এলাকায় চলছে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা। একই সঙ্গে শহর অঞ্চলে বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার ভিত্তিক বিদ্যুৎ  বিলের ভৌতিক কান্ড।

আজ শেষ রাতে তাহাজ্জুত নামাজের জন্য একটু আগে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ইউটিউবে দেখছিলাম বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে এফবিসিসিআই বিদ্যুৎ জ্বালানি বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান  এবং শীর্ষ স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করি ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠান এনার্জি প্যাকের সিইও হুমায়ুন রাশিদ এবং ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির প্রাক্তন ব্যাবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলি কাওসার আমির আলী আলোচনা।

এর কিছুপরেই বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ায় পড়লাম বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর ব্যাখ্যা এবং প্রতিশ্রুতি। তিনি জানালেন সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে এখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩০,০০০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিমন্ত্রীর মতে কোভিড অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট কারণে জ্বালানি সংকট এবং ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সংকট হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আর এবারে নজিরবিহীন দাবদাহের কারণে বিদ্যুৎ চাহিদা অনেক বেড়ে গাছে।  প্রতিমন্ত্রী অচিরেই পরিস্থিতি উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক মিটিংয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রথমেই বলবো অজুহাত হিসাবে এখন আর কোভিড অথবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভাঙা রেকর্ড বাজানো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। ৩০,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে ১৭৮০০ মেগাওয়াট প্রতিশ্রুত বিদ্যুৎ করতে না পারার ব্যার্থতার মূল কারণ সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের অভাব তথা অদূরদর্শী পরিকল্পনা। সরকার সম্পূর্ণ দেশকে ১০০% বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনার অর্জন নিয়ে গর্ব করে। সেখানে বিশাল গ্রামীণ অঞ্চলকে চাহিদা মাফিক বিদ্যুৎ সরবরাহ না করার ব্যার্থতার দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। গ্রামীণ জনগণকে বঞ্চিত রেখে শহরাঞ্চলের মানুষদের আলোকিত রাখা কোন গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য বলা যাবে না। দেখতে হবে অনেক প্রস্তুতির ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও সরকার কেন ১৭,৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বার্থ হলো?

বরাবরের মতো এবার কিন্তু গ্যাস সংকটের দোহাই দেওয়া যাবে না। সার কারখানাগুলোকে গ্যাসবঞ্চিত রেখে হলেও কিন্তু এবার পেট্রোবাংলা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১৩৫০-১৪০০ এমএমসিএফডি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরবরাহ করেছে। ব্যাহত হয়েছে তরল জ্বালানি ব্যাবহারকারী বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন করার ব্যার্থতা।  সরকার বিশেষ আইনের আওতায় অসংখ্য তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে অনুমতি দিয়েছে।

ক্যাপাসিটি চার্জের নাম এই কেন্দ্রগুলোর মালিক বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। কিন্তু উঁচু চাহিদার সময় এই কেন্দ্রগুলো ক্ষমতার ৩০% র বেশি উৎপাদন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। অবশ্য তাদের যুক্তি আছে। সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বিপুল অর্থ বকেয়া আছে। তরল জ্বালানি ক্রয়ের জন্য ওরা ব্যাংক থেকে লেটার অফ ক্রেডিট খুলতে পারেনি।

এর পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ ক্ষমতায় চালানো হয়নি। একদিন আদানী গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি ব্যাহত হয়েছে। রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ডের আওতাধীন পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থাগুলোর এলাকায় ৩০০০ মেগাওয়াটের অধিক লোড শেডিং হয়েছে। ব্যাহত হয়েছে সেচ কাজ। সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এলাকায় শিল্প কারখানাগুলো পরিচালনা সংকট হয়েছে। কৃষিতে সেচ সমস্যা এবং শিল্পে বিদ্যুৎ সমস্যা নিঃসন্দেহে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। আগামী অন্তত দুইমাস রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে।

বিদ্যুৎ সেক্টরেও অনেক সমস্যা। সরকারি বেসরকারি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া আছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনকরী কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ বিল, পেট্রোবাংলাকে গ্যাস বিল প্রদান করতে পারছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতকে ভর্তুকি প্রদান করতে পারছে না। সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারকে কিছু ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ সহসা গ্রহণ করতেই হবে.

দেখলাম বিদ্যুৎ বিভাগ শপিং মলসহ দোকান পাঠ রাত ৮টার পর বন্ধ রাখার উপদেশ দিয়েছে, এয়ার কুলারগুলোর তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির উপরে রাখতে বলেছে। এগুলো মনিটরিং করার মতো জনবল আছে কি না সন্দেহ। তবে ব্যবহারে কৃচ্ছতা এবং জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যাবহারে দক্ষতা অর্জন ছাড়া আপাতত বিকল্প নাই।

কোনোভাবেই বর্তমান অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৭০০০ মেগাওয়াটের অধিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর পেট্রোবাংলার পক্ষেও দীর্ঘ সময় ১৪০০ এমএমএমসিএফডি গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী কাছের ঘরে বসে ঢিল ছোড়ার মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে. সবার সঙ্গে বসে সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ সহ সকল বিষয়ে সমতা ভিত্তিক বণ্টন পাওয়ার অধিকার সংবিধান সম্মত, নগরগুলো আলোকিত রেখাকে গ্রামগুলোকে আঁধারে নিমজ্জিত রাখা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × four =