গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড আলো ধরে এগিয়ে যাওয়া

অপরাজিতা জামান: ৬৫তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডটির দিকে এবার সর্বোচ্চ মনোযোগ ধরে রেখেছিলেন বাংলাদেশিরাও। কেননা এবারই প্রথম দুই বাংলাদেশি গায়িকা নাম লিখিয়েছিলেন এ পুরস্কারের আসরে। এই কৃতিত্ব নজরুল সংগীতশিল্পী নাশিদ কামাল ও তার মেয়ে আরমিন মুসার। ভারতীয় অ্যালবাম ‘শুরুয়াত’ গ্র্যামিতে সেরা গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। বাংলাদেশি দুই শিল্পী ছাড়াও এই অ্যালবামে গান গেয়েছেন ভারতীয় সংগীত জগতের একাধিক রথী-মহারথীরা। নাশিদ কামালের লেখা ও সুর করা ‘জাগো পিয়া’ গানটি ছিল অ্যালবামটিতে। মা-মেয়ে দুজনেই কণ্ঠ দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য শেষ পর্যন্ত সহায় হয়নি। কেননা শুরুয়াতকে হারিয়ে এ বিভাগে স্বীকৃতি পেয়েছে জাপানের অ্যালবাম ‘সাকুরা’। এদিকে এবারের গ্র্যামিতে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে উড়ে গিয়েছিলেন সংগীত পরিচালক প্রীতম হাসান ও গায়িকা জেফার। বিশ্ব তারকাদের পাশে বসে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছেন তারা। এ নিয়ে বেশ উচ্ছসিত ছিলেন তরুণ দুই গায়ক। সংগীতের রথী মহারথীদের কাছে থেকে দেখে তাদের আনন্দ যেন ধরছিল না। সামাজিকমাধ্যমে সেই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তারা। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন এদেশের প্রীতমরা বিশ্বসংগীতের রথী-মহারথীদের কাতারে দাঁড়িয়ে গ্র্যামি জেতার অনুভূতি প্রকাশ করবেন নেট দুনিয়ায়। নাশিদ কামাল ও আরমিন মুসা সেই পথে আলো জ্বেলেছেন। ওই আলো ধরে এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা।

গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড যাত্রা শুরু করেছিল আজ থেকে ছয় দশক আগে। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৫৮ সাল থেকে এর আরম্ভ করেছিল প্রযোজনা সংস্থা দ্য মার্কিন রেকর্ডিং একাডেমি। সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসে দেওয়া হলো গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩। পুরস্কারটির ৬৫তম আসর ছিল এটি। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্রিপটো ডটকম অ্যারেনায় বসেছিল গ্র্যামির এবারের আসর। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে বাংলাদেশ সময় সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে পর্দা ওঠে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের। এদিন আলোকোজ্জ্বল এ আসরে ঘোষণা করা হয় এ বছরের জন্য বিশ্বসংগীতে জায়গা করে নেওয়া সংগীতশিল্পী ও তাদের সেরা কাজগুলোর তালিকা। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন কমেডিয়ান ট্রেভর নোয়াহ।

প্রতিবারই এ পুরস্কারে জয়জয়কার হয় পশ্চিমাদের। সেইসঙ্গে অনুন্নত বিশ্বের দু’একজনও আজকাল ঠাঁই পাচ্ছেন মার্কিন বার্ষিক এ পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। চলুন আগে জেনে নেই গ্র্যামির ৬৫তম এ আসরে কারা কারা পেলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার। সদ্য সমাপ্ত গ্র্যামির আকাশে মার্কিন পপ তারকা রিয়ন্সে যেন চাঁদ হয়ে ভেসে উঠেছিলেন। অ্যারেনার সমস্ত রঙ ও আলো টেনে নিয়েছিলেন নিজের দিকে। ৬৫তম গ্র্যামিতে রীতিমতো রাজত্ব করেছেন তিনি। নয়টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে পুরস্কার জিতেছেন চারটি ক্যাটাগরিতে।

বেশ কয়েক বছর ধরে শ্রোতারা রিয়ন্সের নতুন অ্যালবামের জন্য মুখিয়ে ছিলেন। গত বছর এ পপ তারকা ভক্তদের উপহার দেন রেনেসাঁ নামের একটি অ্যালবাম। প্রকাশের পরই হুলুস্থুল শুরু হয়েছিল এটি নিয়ে। বোদ্ধারা তখনই ভেবেছিলেন রেনেসাঁ আশীর্বাদ হয়ে এসেছে রিয়ন্সের জন্য। হলোও তাই। চারটি বিভাগের সেরা পুরস্কার ঘরে তুলেছেন তিনি। ফলস্বরূপ তার মোট গ্রামির সংখ্যা হলো ৩২। এটিও যেন তার জন্য এবার ভাগ্যবান সংখ্যা। কেননা তিনিই প্রথম গ্র্যামিতে এতবার পুরস্কার পাওয়ার রেকর্ড গড়লেন। এত রেকর্ডের ছড়াছড়িতে স্বামী জে-জেডকেও নিয়েছিলেন সাথে। দুজনে মিলে ৮৮ বার মনোনয়ন পেয়ে আরও একটি রেকর্ড করেছেন। এর আগে এতবার মনোনয়ন কোনো দম্পতি পায়নি। অ্যারেনায় রিয়ন্সের সাজটাও ছিল দেখার মতো।

সেরা নাচ/ইলেকট্রিক মিউজিক অ্যালবাম (রেনেসাঁ) ছাড়াও সেরা ট্র্যাডিশনাল আরঅ্যান্ডআর পরিবেশনা (প্লাস্টিক অব দ্য সোফা), সেরা নাচ/ইলেকট্রিক রেকর্ডি (ব্রেক মাই সোল), সেরা আরঅ্যান্ডআর গান (কাফ ইট) বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন বিয়ন্সে। তবে একাধিক রেকর্ড রিয়ন্সের দখলে থাকলেও আসরের অন্যতম পুরস্কার ‘রেকর্ড অব দ্য ইয়ার’ বগলদাবা করেছেন গায়িকা লিজ্জো। ৩৪ বছর বয়সী লিজ্জোকে তার ‘অ্যাবাউট ডাম টাইম’ গানটি এ পুরস্কার এনে দিয়েছে। শুধু অর্জনেই আলোকিত ছিলেন না লিজ্জো। সাজসজ্জায়ও আলো ছড়িয়েছেন। লাল গোলাপ হয়ে এসেছিলেন তিনি। গ্র্যামির বাগানে তিনি হাজির হয়েছিলেন গোলাপের আদলে বানানো লাল টুকটুকে এক পোশাকে। ফলে এবারের লাল গালিচায় অন্যদের চেয়ে একটু বাড়তি মনোযোগই পেয়েছেন তিনি।


এবারের গ্র্যামিতে জোড়া পুরস্কার জিতেছেন হ্যারি স্টাইলস। ‘অ্যালবাম অব দ্য ইয়ার’ ও ‘বেস্ট পপ ভোকাল’ অ্যালবামের অ্যাওয়ার্ড দুটি পেয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে পোশাক পরিচ্ছদেও নজর আটকে রেখেছিলেন সবার। একাধারে গায়ক ও অভিনেতা হ্যারি স্টাইল বুক খোলা একটি ব্যাতিক্রমী পোশাক পরে এসেছিলেন। যার কারণে ফটো সাংবাদিকদেরও লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এবারের ‘সং অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারটি গেছে মার্কিন প্রবীন ব্লুজ গায়িকা বনি রেইটের ঘরে। ‘জাস্ট লাইক দ্যাট’ গানটি এ পুরস্কার এনে দিয়েছে তাকে। আমেরিকান ফার্স্ট লোডি জিল বাইডেনের হাত থেকে এ পুরস্কার নিয়েছেন রেট। ওই মুহূর্তটা তার কাছে অবিশ্বাস্য লেগেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। কালো পোশাকে একগাদা পুরস্কার হাতে হাস্যোজ্জ্বভাবে লেন্সবন্দি হয়েছেন তিনি।

এবারের গ্র্যামি আসরে ‘বেস্ট পপ সলো’ পারফর্মেন্সের পুরস্কার জিতেছেন ব্রিটিশ কণ্ঠশিল্পী অ্যাডেল। ‘ইজি অন মি’ গানটির জন্য এ পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এর মাধ্যমে প্রথমবার গ্র্যামির স্বাদ আস্বাদন করলেন এ গায়িকা। গ্র্যামিতে খাতা খোলার আনন্দে পুরস্কার হাতে বেশ উচ্ছসিত দেখাচ্ছিল অ্যডেলকে। ক্যারিয়ারের ১২তম গ্র্যামি পেয়েছেন সংগীতশিল্পী টেইলর সুইফট। তার ঝুলিতে এ পুরস্কারটি এনে দিয়েছে ‘অল টু ওয়েল’ শিরোনামের মিউজিক ভিডিওটি। মিউজিক ভিডিওটি প্রকাশের পরই শ্রোতা দর্শকদের হৃদয় হরণ করেছিল।

বোদ্ধারা তখনই ভেবেছিলেন গ্র্যামিতে এবার পুরস্কার বিজেতার ঘরে নাম থাকবে তার। পাশাপাশি তার প্রাক্তন প্রেমিক হ্যারি স্টাইলও বিজেতার কাতারে থাকায় সবার মাঝে দারুণ কৌতুহল বিরাজ করছিল সাবেক এই যুগল নিয়ে। সবাই ভাবছিলেন তারা একে অন্যের সাফল্যটা উপভোগ করবেন কিভাবে? নাকি এখানেও একে অন্যকে এড়িয়ে যাবেন তারা। কিন্তু তেমনটা না করে উপস্থিত সকলকে অবাক করেছেন তারা। টেইলর পুরস্কার জেতায় অভিবাদন জানিয়েছেন স্টাইল। অন্যদিকে স্টাইল যখন গাইছিলেন টেইলর তখন কোমর দুলিয়েছেন। দুজনের পথ দুদিকে বেঁকে যাওয়ার পরও এমন আচরণ মুগ্ধ করেছে সবাইকে।

গ্র্যামিতে উল্লেখযোগ্য একটি পুরস্কার হলো ‘বেস্ট নিউ আর্টিস্ট’। তাই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এটি। কোন নবাগতর পাচ্ছেন এ স্বীকৃতি তা নিয়ে জল্পনার শেষ থাকে না। এ আসরে এ স্বীকৃতির মালা উঠেছে সামারা’র গলায়। শুধু বেস্ট নিউ আর্টিস্ট না, বেস্ট জ্যাজ ভোকাল অ্যালবামের পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। লিংগার অ্যাওহিল অ্যালবামটি এ সম্মান এনে দিয়েছে ২৩ বছর বয়সী সামারা জয়কে। এবারের গ্র্যামিতে গান পরিবেশন করেছেন তিনি। কান্ট গেট আউট অব দিস মুড গানটি গেয়ে শুনিয়েছেন সবাইকে। সাজসজ্জায়ও অনন্য ছিলেন এ গায়িকা। কালোকেশী সামারা নিজেকে সাজিয়েছিলেন রক্ত লাল পোশাকে। শুধু পুরস্কার বিজেতাই যে আলো ছড়িয়েছে আসরে তা কিন্তু না। যারা মনোনয়ন পেয়েছিলেন তারাও এসেছিলেন। এসেছিলেন অন্যরাও। বেস্ট ড্যান্স/ইলেকট্রনিক রেকর্ডিং ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বেবি রেক্সা। তবে পুরস্কার জোটেনি ভাগ্যে। তাই বলে যে মন খারাপ করে বাড়ি চলে যাবেন তা কিন্তু না। গোলাপি পোশাকে নিজেকে জড়িয়ে তিনিও সুবাস ছড়িয়েছেন আসরে। ডিজে খালেদও কোনো পুরস্কার জেতেননি এবার। তবে লাল গালিচায় তার উপস্থিতি প্রাণবন্ত করেছে সবাইকে। গাঢ় নীল রঙে নিজেকে রাঙিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন র‌্যাপার কার্ডি বি। বেচারির ভাগ্যে এবার মনোনয়নও জোটেনি গ্র্যামির। তারপরও সকলের চোখের মণি হয়েছিলেন ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনারের তৈরি গাউন গায়ে চাপিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত রিকি কেজ তার ‘ডিভাইন টাইডস’ অ্যালবামের জন্য এবার জিতে নিয়েছেন সেরা ইম্প্রেসিভ অডিও বিভাগের পুরস্কারটি। এ অর্জন তিনি উৎসর্গ করেছেন ভারতকে। এছাড়াও গ্র্যামিতে এবার এসেছিলেন পপসম্রাজ্ঞী ম্যাডোনা কন্যা লর্ডিস লিওন। সামাজিকমাধ্যমে এরইমধ্যে সেলিব্রেটি বনে গেছেন তিনি। এবার সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে গেলেন সংগীতের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ এ আসরে। লাল টুকটুকে পোশাকে সেজেগুজে এসেছিলেন তিনি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 3 =