ঘুরে এলাম ঢাকা মেট্রোরেল

শিব্বীর আহমেদ: ঢাকা মেট্রোরেল নিয়ে দেশের জনগনের বিপুল আগ্রহ ও উৎসাহ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত এই মেট্রোরেল প্রকল্প দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একটি অভিজ্ঞতা যা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেও আগ্রহী করে তুলেছে। ২৮ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক এমআরটি-৬ আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর থেকে এই রেলে ভ্রমন করার আগ্রহ মানুষের বেড়ে শীর্ষ পর্য‍ায়ে  পৌঁছে যায়। শহরের মানুষের পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। কি জোয়ান কি বৃদ্ধ, নারী পুরুষ শিশু যুবা, একা কিংবা স্বপরিবারে সবাই আসছেন মেট্রোরেল ভ্রমন করতে। প্রথমবারের মত মেট্রোরেলে উঠবার ও ভ্রমন করবার অভিজ্ঞতা লাভের জন্য দীর্ঘলাইন দেখা যায় মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে। বাদ যায়নি প্রবাসীরাও। দেশের বাইরে মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতার পরও প্রবাসীরা ছুটে আসছেন দেশের মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এ যেন বাঙালির এক মহাবিজয়ের অর্জন। এ যেন বাংলাদেশের অর্জন, বাংলার জনগনের এক ঐতিহাসিক অর্জন ও বিজয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেট্রো রেল ভ্রমন করবার অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও ঢাকা মেট্রোরেল ভ্রমনের লোভ ছিল বেশ কষ্টকর। প্রথম দু’দিন যাবো যাবো করে যাওয়া হয়ে উঠেনি। তৃতীয়দিন ভোরেই রামপুরার বাসা থেকে বের সিএনজিতে উঠে বসলাম। গন্তব্য আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশন। ৩১ তারিখ মঙ্গলবার, ২০২২ সালের শেষদিন  সকালবেলা। রাস্তা প্রায় ফাঁকাই। কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা ভেদ করে এগিয়ে চলেছে সিএনজি। বেশিক্ষন লাগল না সময়। চলে এলাম স্টেশনে। সিএনজি থেকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ লম্বা লাইন। এত ভোরে এত মানুষ মেট্রোরেল চড়তে আসাবে ভাবিনি। সিএনজির ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে চলে এলাম লাইনের শেষ মাথায়। মানুষ আসছে তো আসছেই। কেউ রিকশায়, কেউ হোন্ডায়, কেউবা সপরিবারে গাড়িতে আসছেন। লাইন ধরছেন আমার পিছনেই। স্কাউটের ছেলেমেয়েদেরকে দেখলাম গাইড করতে। পুলিশও আছে ওদের সাথে। দশজন বিশজন করে স্টেশনে প্রবেশ করতে দিচ্ছি পুলিশ। সুশৃংখল ভাবেই প্রত্যেককে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করতে দেখলাম। সবাই উৎসুক সবার মাঝেই আগ্রহ। মেট্রোরেলে চড়বার অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিতে ধরে রাখবার জন্য মোবাইল দিয়ে ছবি তোলার হিড়িক সবার মধ্যে। আছে টেলিভিশন নিউজ পেপারের সাংবাকিরা। সাক্ষাতকার নিচ্ছেন তারা।

আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর পর্যন্ত আপাতত মেট্রোরেল এমআরটি-৬ চলছে সকাল ৮-১২টা পর্যন্ত মোট ৪ঘন্টা। এই রুটে মোট ৯টি স্টেশন রয়েছে। আগারগাঁও, শেওরাপাড়া, কাজিপাড়া, মিরপুর ১০. মিরপুর ১১, পল্লবী, উত্তরা সাউথ, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা উত্তর। তবে আপাতত মেট্রোরেল এমআরটি-৬ চলছে সরাসরি আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর পর্যন্ত। মাঝখানের স্টেশনগুলো এখনো চালু করা হয়নি। আগামী ২৬ মার্চ এই রুটের সবগুলো স্টেশন খুলে দেয়ার কথা রয়েছে এবং ট্রেনের ফুল ক্যাপাসিটিতে যাত্রীবহন করা হবে। তখন এই ট্রেন চলবে মতিঝিল পর্যন্ত। এই রুটে আগারগাঁও থেকে আরো যুক্ত হবে বিজয়সরনি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্রেটারিয়েট এবং সর্বশেষ মতিঝিল স্টেশন।

এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলে ঘন্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। ৬টি কোচ সম্বলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬ টি স্টেশনে থেমে সর্বোচ্চ ২,৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। মেট্রোরেলে অল্প সময়ে অধিক সংখ্যায় যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হয়। এতে ছোট ছোট যানবাহনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানীর ব্যবহার বহুলাংশে কমে যাবে। ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ হবে। মহানগরবাসীর কর্মঘন্টা সাশ্রয় হবে। যানজট বহুলাংশে হ্রাস পাবে। যানজট এবং এর ফলশ্রুত প্রভাবে যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এমআরটি-৬ চালু হওয়ার পরৎ মেট্রোরেল পরিচালনাকালে দৈনিক ট্রাভেল টাইম কস্ট  বাবদ প্রায় ৮ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা এবং ভেহিকেল অপারেশন কস্ট বাবদ প্রায় ১ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা সাশ্রয় হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সাশ্রয়কৃত কর্মঘন্টা ব্যবহার করা যাবে।

মেট্রোরেল সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চালিত বিধায় কোনো ধরনের জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানি ব্যবহৃত হবে না। ফলে বায়ু দূষণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মেট্রোরেল অল্প সময়ে অধিক সংখ্যায় যাত্রী পরিবহন করবে বিধায় ছোট ছোট যানবাহনের ব্যবহার বহুল সংখ্যায় হ্রাস পেয়ে জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস পাবে। এতে বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে যাবে। মেট্রোরেলের রেলওয়ে ট্র্যাকের এর নিচে মাস স্প্রিং সিস্টেম  থাকবে। কনটিনিউয়াস ওয়ালডেড রেল ব্যবহার করা হবে। উড়াল মেট্রোরেলের ভায়াডাক্টের উভয় পার্শ্বে শব্দ প্রতিবন্ধক দেয়াল থাকবে। ফলশ্রুতিতে মেট্রোরেলে শব্দ ও কম্পন দূষণ মাত্রা মানদন্ড সীমার অনেক নিচে থাকবে। সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বরং পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

মেট্রোরেলের ভাড়া

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর আওতায় বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল লাইন-৬ (উত্তরা হতে কমলাপুর) এর ভাড়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিম্নরূপ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে:

১.  ভাড়ার হার যাত্রী প্রতি কিলোমিটার ৫.০০ (পাঁচ) টাকা;

২.  সর্বনিম্ন ভাড়া যাত্রী প্রতি ২০.০০ (বিশ) টাকা;

৩.  সর্বোচ্চ ভাড়া যাত্রী প্রতি ১০০ (একশত) টাকা (উত্তরা নর্থ স্টেশন হতে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত) ২০ (বিশ) কিলোমিটার দূরত্বের জন্য;

নারীবান্ধব মেট্রোরেল

মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করার নিমিত্ত প্রতিটি ট্রেনের একটি করে কোচ শুধুমাত্র নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৯০ জন নারী যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। নারী যাত্রীরা ইচ্ছা করলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারবেন। মেট্রো স্টেশনগুলোতে মহিলা যাত্রীদের জন্য পৃথক বাথরুমের সংস্থান আছে এবং তাতে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তনের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থা সংযোজিত আছে। গর্ভবতী মহিলা ও বয়স্ক যাত্রীগণের জন্য মেট্রো ট্রেনের কোচের অভ্যন্তরে আসন সংরক্ষিত থাকবে।

মেট্রোরেলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের যাতায়াতের সুবিধাদি

এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য মেট্রো ট্রেনে এবং মেট্রো স্টেশনে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা সংযোজন করা হয়েছে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ও খর্বকায় ব্যক্তিগণ যাতে সহজে টিকেট সংগ্রহ করতে পারেন সে জন্য অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় টিকেট বুথ থাকবে। একইভাবে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের টিকেট সংগ্রহ করতে পারেন সে ব্যবস্থাও রয়েছে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের পেইড জোনে সহজে প্রবেশ এবং বাহিরের নিমিত্ত হুইল চেয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় ভাড়া পরিশোধের প্রশস্ত গেইট আছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের লিফটে সহজে উঠা-নামার সুবিধার্থে লিফটের অভ্যন্তরে ধরার হাতল, নিম্ন উচ্চতায় কন্দ্রোল প্যানেল ও নিজের অবস্থান বোঝার জন্য আয়না আছে। লিফ্টের কন্ট্রোল প্যানেলে ব্রেইল পদ্ধতিতে নির্দেশনাও থাকবে।

হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে স্টেশনে উঠা-নামার জন্য লিফটের সম্মুখে ঢালু পথ (জধসঢ়) থাকবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা সম্বলিত ও সজ্জিত ওয়াশরুমের ব্যবস্থা থাকবে। মুক ও বধির যাত্রীগণ ডিজিটাল নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে মেট্রো স্টেশনে ও মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবেন। অন্ধ যাত্রীদেও মেট্রো স্টেশনে চলাচলের জন্য ব্লাইন্ড স্টিক ব্যবহারের সুবিধার্থে হলুদ রঙয়ের ট্যাকটাইল পথের ব্যবস্থা রাখা হবে। টয়লেট, লিফ্ট ও অগ্রাধিকার আসন সহজে বোঝার জন্য প্লাটফর্ম ও মেট্রো ট্রেনে শনাক্তকারী চিহ্ন থাকবে। স্টেশন এলাকায় এবং মেট্রো ট্রেনের অভ্যন্তরে অডিও এবং ভিজুয়াল ইনফরমেশন সিস্টেম থাকবে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে অন্যান্য যাত্রীদের ন্যায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যাত্রীরাও শোনা ও দেখার মাধ্যমে সহজে মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবেন। যাত্রীগণের পদস্খলনজনিত দুর্ঘটনা রোধ এবং হুইল চেয়ার ও ব্লাইন্ড স্টিক ব্যবহারের সুবিধার্থে মেট্রো ট্রেনের কোচের ফ্লোর এবং স্টেশনের প্লাটফর্ম-এর উপরিভাগ একই সমতলে রাখার নিমিত্ত মেট্রো কোচের নিচে অত্যাধুনিক এয়ার ব্যাগ সাস্পেনশন সংযোজন করা হয়েছে। মেট্রো কোচের বহির্ভাগ এবং প্লাটফর্মের মধ্যে সর্বত্র এমনভাবে ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে যাত্রীগণ নিরাপদে ও সহজে মেট্রো ট্রেনে উঠা-নামা করতে পারেন।

চলে এলাম স্টেশনের মূল প্রবেশমুখের কাছে। এক যাত্রীকে দেখলাম লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে নৌকা মাথায় করে। কাচের বাক্সে নৌকা বানিয়ে মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছেন। সাক্ষাতকার দিচ্ছেন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। তাঁর মাথার কাচের বাক্সের উপরে সাদা কাগজে লেখ রয়েছে, ‘বাংলার জননী রানী মা ও রানী মা। মুই ত গ্রাম থাইক্কা শহরে আইছি। মেট্রো রেল এ উঠুম বইল্লা।’ তাঁর হাতের মধ্যে পলিথিন ব্যাগে ঝুৃলে আছে গুড় এবং মুড়ি। নিশ্চই এগুলো খাবারের জন্য এনেছে।

স্টেশনের পাশেই সাইনবোর্ডে টিকেটের মুল্য সহ নানা সতর্কতামুলক তথ্য রয়েছে। চোখ বুলিয়ে নিয়ে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কোন প্রকার অসুবিধা ছাড়াই প্রবেশ করলাম ভিতরে। চলন্ত সিঁড়িতে করে চলে এলাম টিকেট কেনার প্ল্যাটফর্মে। স্কাউটরা সক্রিয় রয়েছে। তথ্য দিচ্ছে যাত্রীদেরকে। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে টিকেট কিনতে সহায়তা করছে লাইনে দাঁড়নো যাত্রীদেরকে। স্টেশনের দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে ডিজিটাল তথ্য সম্বলিত স্ক্রিন। যাত্রীরা এই সকল স্ক্রিন থেকে নানা তথ্য জেনে নিচ্ছে দেখে নিচ্ছেন। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে টিকে না কিনে চলে এলাম টিকেট কাউন্টারে। টিকেট বিক্রয়কারী থেকে ১৩টি কিনে ফেললাম। প্রতি ৬০টাকা করে। একটা নিজের জন্য ১টি বাকীগুলো উপহার হিসাবে বিলাবো। যাওয়া আসা দুই দিকের টিকেট ক্রয় করতে চাইলাম। কিন্তু টিকেট বিক্রেতা বলল, ফিরতি টিকেট উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকেই কিনতে হবে। কি আর করা। তাই একমুখী টিকেট নিয়ে আবারো চলন্ত সিঁড়ি করে চলে এলাম প্ল্যাটফর্মে।

প্রতি ১০মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন যাতায়ত করছে আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশনের মধ্যে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন চলে এল। তৎপর হয়ে উঠল স্কাউটরা। প্রথমেই প্ল্যাটফর্মের উপরের দরোজা স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে গেল। তারপর ট্রেনের দরোজা। যাত্রীরা নেমে পড়তেই অপেক্ষমান যাত্রীদের সাথে উঠে পড়লাম ট্রেনে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নানা তথ্যে সমৃদ্ধ আধুনিক ট্রেন। জাপানী কোম্পানির সহযোগীতায় তৈরি অত্যাধুনিক ট্রেন সহ সবকিছুই। ইংরেজি বাংলায় তথ্য ভেসে উঠছে ট্রেনের প্রতিটি স্ক্রিনে। ট্রেনের ভিতরের প্রতিটি কোচে ভেসে আসছে নানা তথ্য সম্পর্কিত ঘোষণা বা অডিও অ্যানাউন্স। ট্রেনের দরোজা বন্ধ সহ পরবর্তী স্টেশনের নাম জানান দিচ্ছে।

ইতিপুর্বে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো, মন্ট্রিয়াল, লন্ডন সহ বিভিন্ন মেট্রোতে বা সাবওয়ে তে চড়বার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত সাবওয়ে’র প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে আমার। সুতরাং মনের ভিতরে তুলনামুলক ব্যবধান নির্নয় করতে শুরু করলাম মনের অজান্তেই এবং ঢাকার এই মেট্রোরেলকে কোন অংশেই কম মনে হলনা। সবই প্রায় একই রকম। তবে নিউ ইয়র্কে প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের সামনে কোন দরোজা নেই। এখানে আছে। এখানে একটা এক্সট্রা সিকিউরিটি সংযোজন করা হয়েছে বলে মনে হল।

ট্রেন ছুটছে উত্তরা উত্তর স্টেশনের উদ্দেশ্যে। প্রতিটি কোচের প্রতিটি সিট যাত্রী ভরা। যাত্রীদের সাথে মিডিয়া কর্মীরাও ক্যামেরা নিয়ে ট্রেনের ভিতরে। চলছে ইন্টারভিউ। শিশু যুবক বৃদ্ধ যুবক নারী পুরুষ সবশ্রেনীর মানুষই এসেছেন এই মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতা নিতে। সবাই উৎফুল্ল সবাই উৎসক। চোখে মুখে গভীর আনন্দের ছাপ। এ যেন তাদের বিশ্ব জয়। প্রবাসীদেরকে দেখলাম। যার বিদেশে মেট্রো বা সাবওয়ে তে চড়বার অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা ও এসেছেন ডাকা মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য। সবাই ছবি তুলছেন। পরিবার পরিজন সবাইকে নিয়ে ছবি তুলে ইতিহাসের স্বাক্ষী হচ্ছেন। কেউবা আবার ভিডিও কলে নিকটজনকে দেখাচ্ছেন ট্রেনের ভিউ।

বিদ্যুৎ চালিত দ্রুতগতীর উড়াল ট্রেন এমআরটি-৬ দ্রুত গতীতে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। ট্রেনের কাচের জানালায় একের পর এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনেই। দশ মিনিটের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই চলে এল উত্তরা উত্তর স্টেশনে। সবাইকে ট্রেন থেকে নেমে যাবার জন্য ঘোষণা ভেসে এল ট্রেনের অডিও সিষ্টেমে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল শেষ স্টেশনের তথ্য। ট্রেন থেমে যেতেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে প্ল্যাটফর্ম এবং ট্রেনের দরোজা। শতশত যাত্রী প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছে ট্রেনে উঠবার জন্য। নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। তথ্য সমৃদ্ধ ডিজিটাল স্টেশন। চারিদিকে তথ্য সমৃদ্ধ ডিজিটাল স্ক্রিন, রয়েছে স্কাউটদের সহযোগিতা।

প্ল্যাটফর্ম থেকে আগারগাঁও ট্রেনের টিকেট কাটবার জন্য যাবার ব্যবস্থা থাকলেও স্কাউটরা যেতে দিল না। বলল এখন অনুমোদন নেই। বিষয়টি ভালো লাগেনি। বাধ্য হয়েই ধীরে ধীরে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তায় এসেই দেখলাম সারিসারি বিআরটিসি বাস দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের যাত্রীদের জন্য। ট্রেন থেকে নেমেই যাত্রীরা তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যের টিকেট ক্রয় করে উঠে বসছেন বিআরটিসি বাসে।

মেট্রোরেলের নিচের সড়ক

রাস্তায় উঠেই লক্ষ করলাম ঝকঝকে তকতকে পিচঢালা এক নতুন সড়ক পথ। ট্রেন লাইনের ঠিক নিচ দিয়েই এই রাস্তা দু’দিকে দু’লাইন করে মোট চার লেইন চলে গিয়েছে আগারগাঁও এর দিকে। সড়কটি সেজে উঠতে শুরু করেছে নতুন রূপে। বিশেষ করে ট্রেন লাইনের সমান্তরাল উত্তরা থেকে মিরপুরে যোগাযোগের যে নতুন পথ তৈরি হয়েছে, তা নগরীর জন্য বাড়তি পাওনা। এই সড়কের এখনই সুফল পেতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। চলাচল শুরু করেছে কার সিএনজি সহ অন্যান্য গাড়ি। এর মাধ্যমে রাজধানীর উত্তর আর দক্ষিণের যোগাযোগে তৈরি হচ্ছে সংযোগ। মেট্রোরেলের নিচে নতুন রাস্তাটি উত্তরাবাসীর জন্য বিরাট একটি সুখবর। ট্রেন এর মতই এই সড়ক দি্েযয় মিরপুর যেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ মিনিট। ফার্মগেট থেকে মিরপুর হয়ে উত্তরায় যেতে এই বাইপাস মূল সড়ক অর্থাৎ বিমানবন্দর সড়কের চাপ অনেকটাই কমিয়ে আনবে। এখন মিরপুর যেতে আর আগের মতো দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। নিচে রাস্তা হওয়ায় চলাচলের জন্য বাড়তি সুবিধা হয়েছে।

উত্তরা উত্তর স্টেশনের নিচে রাস্তা পার হওয়ার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। গাড়ি চলছে, আর এরই মধ্য অনিরাপদ ভাবে রাস্তা পার হচ্ছে যাত্রীরা। লক্ষ্য করলাম আগত যাত্রী বা ট্রেনের যাত্রীদের জন্য নিচে রাখা হয়নি কোন পার্কিং এর ব্যবস্থাও। বিষয়টি সঠিক মনে হলনা। রাস্তা ক্রস করে হয়ে আবারো স্টেশনে প্রবেশ করলাম। চলে এলাম টিকেট কিনবার প্ল্যাটফর্মে। এবার এলাম স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সামনে। স্কাউট দাঁড়িয়ে আছে মেশিনের সামনে যাত্রীদেরকে টিকেট কিনবার জন্য সহযোগিতা করবার জন্য। স্কাউটের সহযোগিতায় একের পর বাটনগুলো টিপে টাকা দেয়ার সময় নির্দিষ্ট টাকা দিতে দেখলাম টাকাগুলো মেশিন নিচ্ছে না। স্কাউট নিজেও চেষ্টা করল। একে একে অনেকগুলো নোট দিয়ে দেখলাম। সবগুলোই ফেরত দিল। স্কাউট বলল, সব নোট এখনো সফটওয়ারে আপডেট করা হয়নি। অগত্য আবারো চেষ্টা করতে লাগলাম। বিষয়টি সঠিক মনে হয়নি। হয়ত আগামী মার্চ মাসে পূর্ণাঙ্গ ভাবে মেট্রোরেল চালু হলে হয়ত হয়ে যাবে। যাইহোক অনেক চেষ্টার পর একটা ১শত টাকার নোট মেশিন গ্রহন করল। ১টা টিকেট কিনবার জন্য সিলেক্ট করেছি। ৪০টাকা ফেরত দিয়ে মেশিন টিকেট দিল। টিকেট নিয়ে স্কাউটকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। স্কাউট তাড়া দিল ট্রেন এখুনি ছেড়ে দিবে। মাইকেও ঘোষণা এল। দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়লাম। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। যাত্রী নিয়ে ট্রেন আবারো ছুটে চলল আগারগাঁও স্টেশনের উদ্দেশ্যে।

দশ মিনিট যেন দেখতে দেখতেই চলে গেল। ট্রেন চলে এল আগারগাঁও স্টেশনে। বের হয়ে এলাম রাস্তায়। মনে অনিরাপদ জায়গায় নামিয়ে দেয়া হল যাত্রীদেরকে। নিচে কোন পার্কিং বা কোন গাড়ির ব্যবস্থা নেই। রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে যেতে হবে। অগত্য ঝুঁকি নিয়ে আবারো রাস্তা পার হয়ে মেট্রোরেলের প্রবেশ মুখে এলাম।

ঢাকা মেট্রোরেল ঢাকাবাসী বা বাংলাদেশের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্য বাংলাদেশের অহংকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদ্যম প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বে এই প্রজেক্টের প্রথম ধাপ এমআরটি-৬ বাস্তবায়িত হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই লাইনটি উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচলা উদ্বোধন করেছেন। এই লাইনটি সম্পূর্ণই উড়াল ট্রেন। আরো ৫টি লাইন এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪, এবং এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর ও দক্ষিন) এখানো বাকি রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পাতাল ট্রেন। উড়াল রেল, উড়াল-পাতাল রেল সহ মোট ৬টি লাইনে চলবে ট্রেন। এগুলো আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই ট্রেনের নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এই ট্রেনের পরিস্কার পরিচ্ছনতা সরকারের পাশাপাশি গনগনকেও নিতে হবে। জনগনের দ্বারা এই ট্রেনের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, ট্রেন যাতে অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন না থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। কোনভাবেই এই ট্রেনের নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এই ট্রেনের পরিস্কার পরিচ্ছনতায় বিঘ্ন করা যাবেনা। ট্রেনগুলো যাতে নিরাপদ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সেজন্য সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। পত্র পত্রিকা, টেলিভিশন সহ বিভিন্ন মিডিয়ায় এ ব্যাপারে জনগনকে সচেতন এবং শিক্ষীত করে তোলার দায়িত্ব সরকারের।

স্টেশনে কয়েকটা সিএনজি রিকশা দাঁড়ানো আছে। দরদাম করে একটা সিএনজিতে উঠে পড়লাম। ঢাকা মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ফিরে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।

লেখক: সাংবাদিক ও  বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 + 3 =