কন্টেন্ট দৃষ্টিনন্দন করতে একজন দক্ষ ভিডিও এডিটরের প্রয়োজন পড়ে। ভিডিও এডিটর পর্দার পিছনের হিরোদের একজন। ভিডিও এডিটরের হাতের ছোঁয়ায় একটি কাজ হয়ে উঠে উপভোগ্য। আমরা সহজ ভাষায় যাকে বলি চোখের আনন্দ। এই চোখের আনন্দ দিতে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন জোবায়ের আবীর পিয়াল। তিনি বর্তমান সময়ের দক্ষ এডিটরদের একজন। নাটক, টেলিফ্লিম কিংবা ওয়েব কন্টেন্ট সব জায়গাতেই কাজের মাধ্যমে নির্মাতারদের আস্থা অর্জন করেছেন তিনি। বর্তমান সময়ে সমানতালে কাজ করছেন ছোটপর্দার পাশাপাশি ওটিটি প্লাটফর্মে। তিনি লিনিয়ার এবং নন-লিনিয়ার এডিটিংয়ে বেশ দক্ষ। বর্তমানে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আই মিডিয়া প্রোডাশন লিমিটেডের চিফ এডিটর অ্যান্ড আইটি হেড হিসেবে কাজ করেছেন। তার কথা জানাচ্ছেন শিশির আহমেদ।
জোবায়ের আবীর পিয়াল ১৯৯১ সালের ১০ জানুয়ারি জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কৈশোর কেটেছে জয়পুরহাট জেলায়। ছোটবেলা থেকেই পিয়াল বেশ শান্ত ও লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। সবসময় আড়ালে থাকতে চাইতেন। মুসলিমগঞ্জ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন তিনি। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তিনি বিখ্যাত আমেরিকান পরিচালক ও এডিটর ওয়াল্টার মার্চের বেশ ভক্ত ছিলেন। সময়ের ধারাবাহিকতায় বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করে পরবর্তীতে শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আসেন। তবে এডিটর হওয়ার নেশা তার পিছু ছাড়েনি। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াকালীন সময়ে ভর্তি হন এডিটিং কোর্সে। এসময়ে বেশ কিছু ফ্রিল্যান্সিং কাজও করেন তিনি। এরপর যুক্ত হন কর্মজীবনে। পিয়াল জানান, তার অদম্য ইচ্ছে তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই নিজের কাজের প্রতি ছিল তীব্র ভালোবাসা।
জোবায়ের আবীর পিয়ালের এডিটর হিসেবে হাতেখড়ি হয় ২০০৪ সালে স্কুলে পড়ার সময়। তখন এডিটিং সম্পর্কে বেশি কিছু না জানলেও, ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। ২০১২ সাল থেকে তিনি পুরোদস্তুর এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করে। জোবায়ের আবীর পিয়াল ক্যারিয়ারের শুরুতে ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’ সিনেমায় সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘রোদ’ ধারাবাহিকের সহকারী এডিটর হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে মেগা সিরিয়াল ‘লোটা কম্বল’ দিয়ে তার এডিটর হিসেবে যাত্রা শুরু হয় শোবিজ অঙ্গনে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এডিটর হিসেবে পিয়ালের হাতেখড়ি হয় প্যারাডক্স প্রোডাকশন বিডিতে, সেখানে অডিও ভিজ্যুয়াল এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তবে বেশি দিন যুক্ত ছিলেন না তাদের সঙ্গে। এরপর ২০১৪ সালে যুক্ত হন আলফা আই মিডিয়া প্রোডাকশনে। এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ভিডিও এডিটর হিসেবে। আলফা আই বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের একটি। চাকরির পাশাপাশি জেএপি স্টুডিওস নামের একটি পোস্ট প্রোডাকশন এজেন্সি খুলেন তিনি। ২০২১ সালে যাত্রা শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠানের। আলফা আইতে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন নির্মাতার সঙ্গে কাজ করতেন তিনি। শিহাব শাহিনের ‘ভালবাসার পংক্তিমালা’, মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘কথোপকথন’, গৌতম কৈরীর ‘শেষটা একটু অন্যরকম’, মাহমুদুর রহমান হিমির ‘নিঃশ্বাস’ দর্শক জনপ্রিয়তা পায়। যেগুলোতে যুক্ত ছিলেন জোবায়ের আবীর পিয়াল।
জোবায়ের আবীর পিয়ালের নিজের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট শিহাব শাহীনের পরিচালনায় ক্রাইম থ্রিলার ‘আগস্ট ১৪’ ওয়েব সিরিজে এডিটর হিসেবে কাজ করা। সেই সিরিজের মাধ্যমে তার মেধা এবং দক্ষতা টের পায় বাংলাদেশের নির্মাতারা। ‘আগস্ট ১৪’ বাংলাদেশের ওটিটি প্লাটফর্মের অন্যতম আলোচিত ও প্রশংসিত কাজ। এটি মুক্তির পর জোবায়ের আবীর পিয়াল নিজের কাজের জন্য প্রশংসায় ভাসেন। ওটিটি প্লাটফর্ম ‘বিঞ্জ’ এ মুক্তি পাওয়া এই ফিকশনটির সাফল্যের ভাগ এডিটর জোবায়ের আবীর পিয়ালও পেয়েছিলেন ভালো ভাবেই। এই ফিকশন দিয়েই ওটিটিতে তার পথচলার শুরু। এরপর আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’, ‘মহানগর ২’, ‘সাবরিনা’, শিহাব শাহীনের ‘মরীচিকা’, ‘সিন্ডিকেট’, ভিকি জাহেদের ‘আমি কি তুমি’, ‘আরারাত’, ‘টিকিট’, সুমন আনোয়ারের ‘সদরঘাটের টাইগার’, কাজল আরেফিন অমির ‘শেষমেশ’, ‘অসময়’, ‘ফিমেল ৪’ ছাড়াও অনেক ওয়েব সিরিজে কাজ করেছেন তিনি। দেশের প্রথম সারির সকল নির্মাতার সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন এই তরুণ। একজন ভিডিও এডিটরের কাজ অনেক, তার ওপর একটি দৃশ্যের অনেক কিছুই নির্ভর করে। সিকুয়েন্স বাই সিকুয়েন্স পর্দায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য সাজাতে হয়। আর এই কঠিন কাজে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন জোবায়ের আবীর পিয়াল। পাশাপাশি একটি ভালো কন্টেন্টে কালার গ্রেডিং ভালো রাখতে হয়। আর এই ব্যাপারটাও ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন তিনি। তার দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত দারুণ সব কাজ উপহার পাচ্ছে দর্শকেরা। যার কারণে নির্মাতাদের কাছে আস্থাশীল ভিডিও সম্পাদক হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছেন জোবায়ের আবীর পিয়াল। যার ফলে শোবিজ অঙ্গনে পর্দার পিছনের কারিগর হিসেবে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ব্লেন্ডার’স চয়েস দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যান্ড ডিজিটাল কনটেন্ট অ্যাওয়ার্ডসে ২০২২ সালে বেস্ট এডিটিং ক্যাটাগরিতে ওয়েব সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’ এডিটর হিসেবে নমিনেশন পান। একই অ্যাওয়ার্ডে ২০২৩ সালে বেস্ট এডিটিং ক্যাটাগরিতে ‘মহানগর ২’ এর জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
জোবায়ের আবীর পিয়াল বড় পর্দায় প্রথমবারের মতো কাজ করেন ২০২৪ সালে। রায়হান রাফি নির্মিত ‘তুফান’ সিনেমায় এডিটর হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। জোবায়ের আবীর পিয়াল এই কাজে দেশের বাইরের কিছু এডিটরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি জানান, কাজ করতে গিয়ে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন এবং অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছিলেন। পিয়াল বড় পর্দায় আরও বেশ কিছু কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ২০২৫ সালে দর্শক বেশ কিছু কাজ বড় পর্দায় দেখতে পারবে।
এতোদিন শুধু ওটিটি কন্টেন্টে এডিটিংয়ের কারিশমা দেখালেও এবার চলচ্চিত্রে অঙ্গনে প্রবেশের ইচ্ছে আছে বলে জানান জোবায়ের আবীর পিয়াল। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও এখন ওটিটিতে সাফল্য ইতিমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি। নান্দনিক নির্মাণ, অভিনয় দক্ষতা এবং ক্যামেরার পেছনের মানুষগুলোর ভালো কিছুর করার চেষ্টা এই মাধ্যমকে অনেক কিছুই এনে দিচ্ছে। যা কয় বছর আগেও চিন্তা করা যেতো না। তাই যারা ওটিটিতে কাজ করেন তারা সিনেমায় গেলে সিনেমার মান বৃদ্ধি পাবে বলে আমার বিশ্বাস। জোবায়ের আবীর পিয়াল আরও জানান, অফিশিয়াল ঘোষণা না আসা পর্যন্ত নাম বা কিছুই শেয়ার না করলেও সিনেমাতে বেশ কয়েকটা কাজ লক হয়ে আছে আমার। কতোটুকু সফল হয়েছি তা ইন্ডাস্ট্রির মানুষজন ভালো জানে, তবে অনেক সাধারণ দর্শকও যখন অভিনেতা, অভিনেত্রী বা নির্মাতার পাশাপাশি এডিটর কে ছিলেন সেটা জানতে চায় তখন মনে হয় কিছু ভালো কাজ করতে পেরেছি। এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ভবিষ্যতে শুধু ভালো কাজ করে যেতে চাই। সংখ্যায় বেশি কাজ করতে চাই না। গুণগত মান ঠিক রেখে ভালো কাজ করতে চাই।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে