চিঠি নিয়ে তৈরি হওয়া সিনেমা

প্রতি বছর পহেলা সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’ পালিত হয়। এই দিনটি চিঠি লেখার গুরুত্ব এবং সেই ঐতিহ্যবাহী যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উদযাপন করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিনেমায় চিঠিকে কেন্দ্র করে সিনেমা নির্মাণ করা হয়েছে। এমনই দশটি সিনেমা নিয়ে জানাচ্ছেন শিশির আহমেদ।

দ্য লাঞ্চ বক্স – রিতেশ বাটরা

২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে রোমান্টিক ঘরানার সিনেমা ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ মুক্তি পায়। অবশ্য সিনেমাটি ২০১৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম  প্রদর্শিত হয়। রিতেশ বাটরা পরিচালিত সিনেমাটিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে ইরফান খান, নিমরাত কাউর এবং নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। অনান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেনজিল স্মিথ,  লিলেট দুব, নকুল বৈদ, ভারতী আচরেকারসহ আরও অনেকে। গল্পটি শুরু হয় ইলা নামক একজন অল্পবয়সী গৃহবধূকে নিয়ে, যার সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। অনেক চেষ্টা করেও ইলা তার স্বামীকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই ইলা সিদ্ধান্ত নেয় তার স্বামীর জন্য সুস্বাদু রান্না করে তার ভালোবাসা অর্জন করবে। তবে লাঞ্চ বক্সটি ভুল করে তার স্বামীর কাছে না পৌঁছে অন্য একজন কর্মকতা সাজন ফার্নান্দেসের কাছে পৌঁছায়। ফার্নান্দেসের স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা যায়, তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি পুনরায় বিয়ে করেননি, যার কারণে সবসময় তাকে নিষ্প্রাণ লাগে। যখন লাঞ্চ বক্সটি ফেরত আসে তখন ইরা বুঝতে পারে লাঞ্চ বক্সটি অন্য কারো কাছে চলে গেছে। পরের দিন ইরা পুনরায় আরেকটি লাঞ্চ বক্স তৈরি করে ফার্নান্দেসের কাছে ভুল করে খাবার চলে যাওয়ার বিষয়টি চিরকুটের মধ্যেমে জানায়। এরপর প্রতিদিনের মধ্যাহ্নভোজের সাথে পাঠান বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা তাদের জীবনের স্মৃতি এবং ঘটনা ভাগ করে নেয়।

ইল মেরে – লি হিউন সেউং

২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ান মুক্তি পায় ফ্যান্টাসি রোমান্স ফিল্ম ‘ইল মেরে’। লি-হিউন-সেউং পরিচালিত সিনেমাটিতে অভিনয় করেন জুং-জায়ে, জুন জি-হিউনসহ আরও অনেকে। কোরিয়ার সিনেমাগুলো তাদের নিজস্ব গল্প বলার চেষ্টা করে। তেমন একটি সিনেমা হলো ‘ইল মেরে’। মুভির গল্পর স্থান একই কিন্তু দুটি ভিন্ন সময়। দুটি পৃথক সময়ে জীবন কাটানোর নায়ক ১৯৯৭ সালে রয়েছে এবং নায়িকা এর দুই বছর পরের সময়ে অর্থাৎ ভবিষ্যতের ১৯৯৯ সালে বাস করছেন। অথচ নায়কের সাথে তার দিব্যি যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে। সে যোগাযোগ আবার একটি রহস্যময় ডাকবাক্সের মাধ্যমে হচ্ছে। যে ডাকবাক্সটি কিনা একটি সমুদ্রতীরবর্তী বাড়ির সামনে স্থাপন করা। ওই বাড়ির নাম ইল মারে। মুভির নামকরণ করা হয়েছে ওই বাড়ির নামেই। ভবিষ্যতের একজন মানুষের সাথে কীভাবে এই বাস্তবিক বা বর্তমানের সশরীরে যোগাযোগ? অবিশ্বাস্য এই বিষয়টিই পরিচালক নিখুঁতভাবে নির্মাণ করেছেন।

হঠাৎ বৃষ্টি – বাসু চ্যাটার্জী

১৯৯৮ সালে মুক্তি পায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা ‘হঠাৎ বৃষ্টি’। এটি একটি রোমান্টিক সিনেমা। পরিচালনা করেছেন বাসু চ্যাটার্জী। বিভিন্ন চরিত্র অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদীসহ আরও অনেকে। দীপা নন্দী একজন বেকার শিক্ষিত নারী। চাকরির জন্য দীপা কলকাতায় যান। চাকরি না পাওয়ার কারণে তিনি বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ট্রেনে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার ব্যাগ ছিনতাই হয় যাতে তার সার্টিফিকেট, টাকাসহ অনেক মূল্যবান কাগজপত্র ছিল। তবে পকেটমার টাকা নিয়ে সব সার্টিফিকেট রেখে যায়, ট্টেনে উপস্থিত অজিত চৌধুরী বিষয়টি খেয়াল করে। ছোটবেলা থেকেই  অজিতের মানুষের নাম, জন্মদিন সংগ্রহ করা এবং তাদেরকে জন্মদিনের কার্ড পাঠানোর শখ রয়েছে। অজিত ঠিকানা অনুযায়ী ব্যাগটি পৌঁছে দেয়। ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য দীপা অজিতকে চিঠি পাঠায়। ধীরে ধীরে চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কে তৈরি হয়।

দ্য জাপানিজ ওয়াইফ – অপর্ণা সেন

২০১০ সালে মুক্তি পায় ভারতীয়-জাপানি রোমান্টিক নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন অপর্ণা সেন। অভিনয় করেন রাহুল বসু, রাইমা সেন, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, চিগুসা তাকাকুসহ আরও অনেকে। গল্প শুরু হয় এক গ্রামের তরুণ বাঙালি স্কুল শিক্ষককে ঘিরে। হঠাৎ সেই স্কুল শিক্ষক তার জাপানি বন্ধুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। চিঠির মাধ্যমে পরিচয়। অনেকগুলো চিঠির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। চিঠির অক্ষরে অক্ষরে দৈনন্দিন জীবনের গল্প একে অপরকে শুনিয়ে যায় পাত্র-পাত্রী। কখনো চিঠি, কখনো লং ডিসট্যান্ট টেলিফোন কল। স্বামী-স্ত্রীর মতো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে কিসের ভিত্তিতে! অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’ মুভিটি দেখলে আনমনে হয়তো উত্তর হিসেবে বেরিয়ে আসবে, পারস্পরিক বিশ্বাস ও শেয়ারিং এই বিষয়গুলোই সম্পর্কে অধিকারবোধ জন্ম দেয়। অবশ্য একে অপরকে না দেখে ১৫-১৭ বছরের একটি সম্পর্ক টিকে থাকার বিষয়টি বতর্মান সময়ের প্রেক্ষাপটে মিথ মনে হতে পারে। তবে অপর্ণা সেন তার মুভিতে যে সমাজের চিত্র এঁকেছেন কিংবা যে আর্থসামাজিক অবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থানকে ধরতে চেয়েছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পর্কের বিষয়টি চিন্তা করা ভালো। বড় বাক্সে করে কিছু একটা আসছে। বাক্সের ভেতর কী আছে তা শুরুতেই জানছে না কেউ। অজপাড়াগাঁ এমন বর্ষা এলেই চারপাশ পানিতে ডুবে যায়। তবে তাদের বিয়ে হয় চিঠির মাধ্যমে, যদিও বাস্তবে কখনও তার সাথে দেখা হয়নি। এই আজব বিবাহবন্ধন নিয়েই চলতে থাকে চলচ্চিত্রটির গল্প।

ওয়েটিং ফর রেইন – জো জিন-সেমোং

২০২১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মিত রোম্যান্স মেলোড্রামা সিনেমা  ‘ওয়েটিং ফর রেইন’। জো জিন-সেমোং পরিচালিত সিনেমাটিতে অভিনয় করেন হা-নেউল হল, চুন উ-হি, চোই মিউং-বিন,  লি সিওল সহ আরও অনেকে। গল্পে মূল চরিত্র পার্ক ইয়াং হু যে পড়াশোনায় অনেক দুর্বল যার কারণে সে প্রতিবার পরীক্ষার ফেল করে। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে ছোটবেলায় ইয়াং এক দৌড় প্রতিযোগিতার সময় পড়ে যায়, তারপর একটি মেয়ে তাকে সাহায্য করে, তবে হুট করে মেয়েটির ট্রান্সফার হয়ে যায়। তারপর থেকে মেয়েটির সাথে ইয়াংয়ের কখনো দেখা হয়নি। তবে ইয়াং তার বন্ধুর থেকে খোঁজ নিয়ে তার কাছে চিঠি পাঠায়, তবে মেয়েটি তখন শয্যাশায়ী ছিল, তবে মেয়েটির ছোট বোন তাকে খুশি করার জন্য চিঠি লিখতে থাকে তার বোনের নাম করে। তবে এই চিঠিতে একটা শর্ত থাকে যে কখনো তারা একে অপরের সাথে দেখা করবে না এবং কোনো প্রশ্ন করবে; না এই নিয়েই গল্পটি চলতে থাকে।

দ্য পোস্ট ম্যান – কেভিন কস্টনার

১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় আমেরিকান পোস্ট অ্যাপোক্যালিপটিক অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম ‘দ্য পোস্ট ম্যান’। কেভিন কস্টনার নির্মিত এবং পরিচালিত, যিনি সিনেমাটিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন। ডেভিড ব্রিনের ১৯৮৫ সাল প্রকাশিত ‘দ্য পোস্ট ম্যান’ নামক বইয়ের উপর ভিত্তি করে সিনেমাটি নির্মিত হয়। ছবিতে আরও অভিনয় করেন উইল প্যাটন, লারেনজ টেট, অলিভিয়া উইলিয়ামস, জেমস রুশো এবং টম পেটি। সিনেমাটি একটি কাল্পনিক গল্প নিয়ে তৈরি করা হয়। দেখা যায় একটি দুর্গম অঞ্চলে অনেক সম্প্রদায়ের বসবাস, সেখানে অনেক লোক বাস করে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর একজন পোস্ট ম্যান আসেন, তাদের সবার চাহিদা এবং দরকার সম্পর্কে তাদের লেখা চিঠিগুলো সে শহরে পৌঁছে দেয়। চিঠি পৌঁছানোর মধ্যে দিয়ে নানান ঘটনা সৃষ্টি হয় তা নিয়েই এই সিনেমার গল্প।

সীতা রামাম – হানু রাঘবপুদি

২০২২ সালে মুক্তি পায় তেলুগু রোমান্টিক সিনেমা সীতা রামম। হানু রাঘবপুদি সিনেমাটি রচনা ও পরিচালনা করেন। ২০২২ সালে সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অভিনয় করেন দুলকার সলমান, মৃণাল ঠাকুর, রশ্মিকা মন্দানা, সুমন্তসহ আরও অনেকে। সীতারামমা ছবিটির গল্প মূলত ১৯৬৪ সালের এক ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যকে নিয়ে। গল্পে রাম সাহসের সাথে এক যুদ্ধ থামিয়ে দেয়, যার কারণে গণমাধ্যম তাদের ইন্টারভিউ নিতে আসে। রামকে প্রশ্ন করা হয় তার পরিবারের কে আছে। উত্তরে রাম জানায় তার পরিবারে কেউ নেই, যা সেই গণমাধ্যম কর্মীকে প্রভাবিত করে। যার কারণে সকলকে আহ্বান করেন রামকে যাতে সকলে চিঠি লিখে তার পরিবারের অংশ হয়। তখন অসখ্য চিঠি আসে রামের কাছে, সবগুলো চিঠি পড়ার পর তা ফেরত দিলেও একটি চিঠি ফেরত দিতে রাম ভুলে যায়। যাতে সীতা নামক এক মেয়ে নিজেকে রামের স্ত্রী হিসেবে প্রকাশ করে, তবে চিঠিতে কোনো ঠিকানা ছিল না, যার কারণে রাম শুধুমাত্র চিঠি পড়তে পারতো, চিঠির উত্তরে কিছু লিখতে পারতো না। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ রাম তার সাথে দেখা করে, দেখা করার পর তাদের জীবন ভিন্ন রূপ নেয়।

হারু – ইয়োশিমিৎসু মরিতা

১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় জাপানি রোমান্টিক সিনেমা হারু।  ইয়োশিমিৎসু মরিতা রচিত ও পরিচালিত সিনেমাটিতে অভিনয় করেন এরি ফুকাতসু, সেয়ো উচিনো, সেই হিরাইজুমি, নাহো তোদাসহ আরও অনেকে। গল্পের মূল চরিত্র নোবোরু হায়ামি একসময় আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু পিঠে আঘাত লাগার কারণে তিনি আর কখনো ফুটবল খেলতে পারেনি। বর্তমানে নোবোরু একজন সাধারণ অফিস কর্মীর মতো জীবনযাপন করেন। তবে তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ সবসময় তাকে বিষণ্ন করে রাখে। একদিন হঠাৎ একটি বিষয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য একজনের সাথে মেইলে কথা বলেন, মেইলের ওপারে যিনি ছিলেন তিনি তাকে পুরুষ বলে প্রথমে সম্বোধন করে, তবে একটা সময় পরে তার মিথ্যা কথা বলার কারণে তার কাছে ক্ষমা চায় এবং তাদের মাঝে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে তারা দুজনই তাদের চেহারা একে-অপরের থেকে লুকিয়ে রাখে।

দ্য ক্লাসিক – কিওয়াক জেই ইং

২০০৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মুক্তি পায় রোমান্টিক মেলোড্রামা সিনেমা ‘দ্যা ক্লাসিক’। সিনেমাটি পরিচালনা করেন কিওয়াক-জেই-ইং। অভিনয় করেন সন ইয়ে-জিন, জো ইন-সং, চো সেউং-উওসহ আরও অনেকে। দ্য ক্লাসিক ছবিটি একটি রোমেন্টিক ছবি। শুরুতে দেখা যায় জি-হে তার মায়ের ঘর গুছাচ্ছিল, ঘর গুছানোর সময় সে একটি বাক্স খুঁজে পায় যেখানে তার মায়ের জীবনের স্মৃতি ছিল। জি-হে খেয়াল করতো যখন তার মা এই চিঠিগুলো পড়তেন তখন তার চোখ দিয়ে পানি পড়তো। জি-হে দেখে চিঠিতে তার মায়ের জীবনের প্রথম প্রেম সম্পর্কে লেখা হয়েছে। চিঠিগুলো পড়ে জি-হে বুঝতে পারে কেন তার মা সবসময় নিশ্চুপ এবং মনমরা হয়ে থাকেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 + 16 =