নাহিন আশরাফ: শুরুতেই দুটি ঘটনা বলি। প্রথমটা হচ্ছে, শান্তা দাওয়াত খেতে তার ফুপুর বাসায় গিয়েছে। তার ফুপুর বাসায় বুক সেলফে জহির রায়হানের একটা বই দেখে তার সেটা খুব নিতে ইচ্ছে করছে। এমনিতে সে বই পড়ে না। কিন্তু তাও তার ইচ্ছে করছে কাউকে কিছু না জানিয়ে বইটি ব্যাগে করে নিয়ে যেতে। সে কিছুতেই তার সেই ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারে না। সে বইটি তার ব্যাগে নিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর আচমকা সবার সামনে তার ব্যাগ থেকে বইটি মাটিতে পড়ে যায়, এতে সে ভীষণ লজ্জা পায়। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, দিপু মায়ের সাথে একটা সুপার শপে যায়। তার মা কেনাকাটায় ব্যস্ত। সে দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। হঠাৎ তার নজর যায় একটা চকলেটের দিকে। সে কাউকে আশেপাশে দেখতে না পেয়ে পকেটে চকলেটটি নিয়ে নেয়। তার মাকে বললেই হয়তো সে তাকে চকলেট কিনে দিত। কিন্তু তাও সে চুরি করে বসে।
দিপু আর শান্তার গল্পটি পড়ে যে কেউ তাদের খারাপ ভাববে। কিন্তু এটা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে করছে না। তাদের এই সমস্যাটার নাম ‘ক্লিপটোমেনিয়া’। মূলত এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজের চুরি করার ইচ্ছা দমন করতে পারে না। চুরি করা ব্যক্তি সাধারণত কোনো অভাব বা লোভে পড়ে চুরি করে না। চুরি করা জিনিসের বেশিরভাগ জিনিসই সে ব্যবহার করে না। এটা এক প্রকার আবেগ নিয়ন্ত্রণ ব্যাধি। রোগীরা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা কিছুতেই চুরির ইচ্ছা আটকাতে পারে না।
বিখ্যাত শিল্পী ব্রিটনি কিংবা অভিনেত্রী লিন্ডসে লোহান হয়তো আপনার পরিচিত। জেনে অবাক হবেন, তারা দু’জনই দীর্ঘদিন এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। লিন্ডসে লোহান একবার ২৫০০ ডলারের একটি নেকলেস চুরি করে ধরা পড়েন। এছাড়াও আগে কয়েকবার নানা দোকান থেকে জুতা, ড্রেস ইত্যাদি চুরি করেছিলেন। এমন কাণ্ডের জন্য লিন্ডসে লোহানকে রিহ্যাব অব্দি যেতে হয়েছে। একবার অভিনেত্রী মেগান ফক্স ৭ ডলারের লিপ গ্লস চুরির জন্য ধরা পড়েছিলেন। এরা চাইলেই এসব জিনিস কিনতে পারতেন কিন্তু তারা নিজের উদ্দীপনা সামলাতে না পেরে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এগুলো চুরি করেন।
১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে চুরি করাও যে একধরনের মানসিক সমস্যা তা নিশ্চিত করেন কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী। অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণার পর শনাক্ত করা সম্ভব হয় এগুলো হচ্ছে ‘ক্লিপটোমেনিয়া’ রোগের লক্ষণ। ‘ক্লিপটোমেনিয়া’ শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। এটিকে অনেক সময় ‘ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার’ বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর ০.৬ শতাংশ মানুষ ক্লিপটোমেনিয়া রোগে আক্রান্ত। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে ব্যবসায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় ক্লিপটোমেনিয়ার জন্য। ইস্কাদার ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট অফ সাইট্রিক লেকচারার ডা. হাবিব এই রোগের ব্যাপারে সবাইকে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্লিপটোমোনিয়ার সঠিক কারণ জানা নেই। কিন্তু মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক নিম্ন ক্লিপটোমোনিয়ার কারণ হতে পারে। কারণ সেরোটোনিন আবেগ ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ডোপামিনও নিঃসরণও আরেকটি কারণ। ডোপামিন একটি নিউরোটক্সিন যা আনন্দ অনুভূতি জাগায়। তবে যাদের অতীতে উদ্বেগ এবং হতাশার মতো কিছু মানসিক রোগ রয়েছে তাদের মধ্যে এই রোগ থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ক্লিপটোমোনিয়া রোগীদের অনেকে জুয়া খেলায় আসক্ত থাকেন। এছাড়া তাদের বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকতে পারে এবং অনেকের আত্মহত্যার প্রবণতাও রয়েছে।’
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ‘ক্লিপটোমোনিয়া’ রোগীদের আফিম আসক্ত ব্যক্তিদের মতো আকাক্সক্ষা তৈরি হয়, যা চুরি করার মাধ্যমেই শেষ হয়। সময়ের সাথে সাথে আকাক্সক্ষা তীব্র হতে পারে আবার কমেও যেতে পারে। অনেকে নিজের উদ্বেগ কমাতে চুরি করে থাকেন। চুরি করার পরে তাদের কিছুক্ষণ মানসিক শান্তি লাগলেও এর কিছুক্ষণ পর তারা অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। চুরি করা জিনিস ফেরত দিয়ে আসতে চান কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে সম্ভব হয় না। অশান্তির কারণে তারা প্রতিজ্ঞা করেন যে আর কখনো এই কাজ করবেন না। কিন্তু তারা এই কাজ আবার করে ফেলেন। কারণ মনকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন না। ক্লিপটোমোনিয়া রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেখা যায় তাদের বেশীরভাগই আগে থেকেই কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন। এটি সাধারণত কিশোর বয়সে বা আরেকটু পরে দেখা যায়। ক্লিপটোমোনিয়া’র সাথে মুড ডিজঅর্ডার জড়িত। মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা বিশেষ করে অল্প বয়সে কোনো মানসিক আঘাত এই রোগকে আরো শক্তিশালী করে। পুরো পৃথিবীতে এই রোগে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। দেখা গেছে যদি ক্লিপটোমোনিয়ার পারিবারিক ইতিহাস থাকে তাহলেও এই রোগ দেখা দিতে পারে।
এই রোগের চিকিৎসা
ক্লিপটোমোনিয়ার রোগী চক্ষুলজ্জার কারণে নিজেদের রোগ বুঝতে পেরেও চিকিৎসা নিতে চান না। তারা মনে করেন, সবাই কি ভাববে। এই ভাবনাই তাদের আরো ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ থেকে আজীবনের জন্য মুক্তি পাওয়া যায়। যেহেতু ক্লিপটোমোনিয়া রোগের জন্ম নেবার মূল কারণ অতীতের বিষণ্নতা কিংবা উদ্বেগ তাই চিকিৎসকরা প্রথমে তা বের করে দূর করার চেষ্টা করে থাকেন। ডাক্তাররা রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। প্রথমেই রোগীদের সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়ে থাকে। এটি রোগীর চিন্তা ও আবেগকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে রোগীদের আবেগপ্রবণতা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। অনেক রোগীরা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াও ওষুধ খাওয়া কিংবা সাইকোথেরাপি নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে আবার রোগটি ফিরে আসে। মনে রাখতে হবে সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি এই রোগের সমাধানও রয়েছে। তাই সংকোচ কাটিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। ক্লিপটোমোনিয়া রোগীরা অনেক সময় সামাজিকভাবে অপদস্ত হয়ে থাকে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই কেউ যখন চুরি করে তাকে চোর বলেই সম্মোধন করা হয়ে থাকে। এতে তার সাথে সমাজের মানুষ ও পরিবারের মানুষের সাথে খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয়। তখন সে নিজেকে সবার কাছে থেকে গুটিয়ে নেয় ও অনুশোচনায় ভুগতে থাকে। চিকিৎসার অভাবে রোগীর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হলে আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত হতে পারে। যদি রোগের শুরু থেকেই তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করা যায় তাহলে সেরে উঠার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা