চোখের নিচের কালো দাগ

নীলাঞ্জনা নীলা

চোখ যে মনের কথা বলে! আনন্দ, বেদনা, ভালবাসা, স্মৃতি সবই যেন ফুটে উঠে চোখে। আবার অনেকে তো মনে করে মানুষের মূল সৌন্দর্য তার চোখে। তাইতো কবিতায় উঠে আসে কাজল কালো চোখের নারীর কথা। যে চোখ নিয়ে এত কথা সে চোখের যত্ন আমরা কতজনই বা ঠিকমতো নেই? কর্মব্যস্ত দিনের ক্লান্তি যে চোখে ফুটে উঠে সে বিষয়ে আমাদের খেয়ালই থাকে না। ক্লান্তি ভরা চোখে আমরা যত সুন্দর করেই সাজি না কেন কিংবা রূপচর্চা করি না কেন, তা কখনোই পরিপূর্ণ হয় না।

তাই আলাদা করে চোখেরও প্রয়োজন রূপচর্চা। নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমরা যেভাবে যত্ন নেই তেমন করে যত্ন চায় চোখও। কাজল কালো চোখ হলে সমস্যা নেই, কিন্তু চোখ যদি কালো হয়ে যায় ডার্ক সার্কেলে তাহলে কিন্তু সৌন্দর্যের ক্ষতি। চোখের অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যে একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে জেদি ডার্ক সার্কেল। জেদি বলার কারণ হচ্ছে, একবার যদি এই ডার্ক সার্কেল চোখে বসে যায়; তাহলে তা সহজে যাওয়ার নাম নেয় না। এই ডার্ক সার্কেল আমাদের চোখে বাসা বাঁধে কিছু অবহেলার কারণে। তাই জেনে নেওয়া যাক ডার্ক সার্কেল হবার কারণ এবং কিভাবে ঘরে বসেই আমরা এ থেকে কিছুটা রেহাই পেতে পারি।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে চোখের নিচে মোটা করে কালো দাগ পড়াকে ডার্ক সার্কেল বলে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় পেরিঅরবিটাল অথবা আনফ্রাঅরবিটাল, পিগমেন্টেশন বা ডার্কেনিং বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় বিভিন্ন রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিলেও ডার্ক সার্কেলকে সাধারণত জটিল কোনো রোগ ধরা হয় না। শুরুতেই জেনে নেওয়া প্রয়োজন ডার্ক সার্কেল কেন হয়। ডার্ক সার্কেল বিভিন্ন কারণে হতে পারে তবে সাধারণ কিছু কারণ হলো:

রাত জাগা

চিকিৎসক থেকে শুরু করে রূপ বিশেষজ্ঞ সকলেই ডার্ক সার্কেলের অন্যতম কারণ মনে করে থাকেন ঘুম কম হওয়া কিংবা রাত জাগাকে। বর্তমান লাইফ স্টাইলে রাত জাগা যেন একটি ফ্যাশন। সারাদিন আলসেমি করে কাটিয়ে আমরা সমস্ত কাজ জমিয়ে থাকি রাতের জন্য। রাত জেগে দীর্ঘ সময় মোবাইল চালানো, কম্পিউটার কিংবা টেলিভিশন দেখা অনেকের নিত্যদিনের অভ্যাস। আবার অনেকের ঘুমের সমস্যা রয়েছে, তারা চাইলেও ঘুমাতে পারে না। সবাই যে ইচ্ছাকৃতভাবে রাত জাগে তা ঠিক নয়। অনেকের নানা সমস্যার কারণে রাতে ঘুম হতে চায় না। দীর্ঘদিন এই রাত জাগার রুটিনে চললে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যায়। আমরা অনেকেই জানি না যে ঘুমের সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্পর্ক রয়েছে। সঠিকভাবে না ঘুমালে আমাদের কোষ নতুন করে কাজ করার সুযোগ পায় না। শরীর ও মনের সজীবতা ফিরিয়ে নিয়ে আসে ঘুম। ঘুমের অভাবে অনেকের দেখা দেয় ডার্ক সার্কেল।

ভিটামিনের অভাব

খাবারের একটি বিশাল প্রভাব আমাদের শরীরের উপর পড়ে। দীর্ঘদিন আয়রনযুক্ত খাবার না খেলে চোখের নিচে কালি পড়ে যায়। এছাড়া ভিটামিন ডি-এর অভাবে চোখের নিচে কালি পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অতিরিক্ত প্রসেসড ফুড, ফাস্টফুড, তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার ফলে চোখের নিচে পিগমেন্টেশন তৈরি হয়। অনেকের অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলেও চোখের নিচে কালি এবং পিগমেন্টেশন পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ভিটামিনের অভাবে চোখের নিচে কালি পড়লে রূপচর্চা করেও অনেক সময় তা কমানো সম্ভব হয় না।

জিনগত কারণ

বাবা-মা কিংবা রক্তের সম্পর্কের কারো যদি চোখের নিচে পিগমেন্টেশন কিংবা ডার্ক সার্কেলের মতো সমস্যা থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে চোখের নিচে কালি পড়তে পারে। জন্মগত কারণেও অনেকের চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল হয়ে থাকে।

মানসিক চাপ

অতিরিক্ত স্ট্রেস, বিষণ্নতা কিংবা অ্যাংজাইটির মতো সমস্যায় ভুগলে শরীরে রক্ত চলাচল কমে যায়। এছাড়া মানসিক চাপে থাকলে রাতে ঘুম হতে চায় না, খাওয়া-দাওয়া সমস্যা হয়। এর ফলে অনেকের চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে। মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবে চোখের নিচে কালি পড়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনা থাকে।

পানিশূন্যতা

পানিশূন্যতার ফলেও অনেকের চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে। অনেকে অতিরিক্ত ব্যায়াম কিংবা শারীরিক পরিশ্রম করে। কিন্তু দেহের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করে না। ফলে চোখের নিচে পিগমেন্টেশন ও কালো দাগ পড়ে যায়।

হরমোনাল সমস্যা

থাইরয়েডের সমস্যা, অতিরিক্ত ওজন,  পিসিওএস-এর মতো সমস্যায় হরমোনাল ভারসাম্য ঠিক না থাকলেও চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে অনেক সময় কালো দাগের পাশাপাশি চোখের নিচে গর্তের মতো হয়ে যায়

বিভিন্ন রোগ হলে

বিভিন্ন রোগের লক্ষণ হিসেবেও অনেক সময় ডার্ক সার্কেল পড়ে। যেমন শরীরের রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে চোখের নিচে কালি পড়ে। এটোপিক ডার্মাটাইটিস, একজিমা, কমন ডার্মাটাইটিস যাদের থাকে, তাদের এ সমস্যা হতে পারে। তাদের চোখের নিচে চুলকায়। নিয়মিত চোখ চুলকাচ্ছে, ঘষাঘষি করছে, এ কারণে সমস্যা হচ্ছে। একে সেকেন্ডারি পিআই বা পোস্ট ইনফ্লেমেটরি হাইপার পিগমেন্টেশন বলা হয়। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে চোখের নিচে কালি পড়তে পারে।

ডার্ক সার্কেল দূর করার উপায়

ডার্ক সার্কেল দূর করার জন্য প্রথমে তা হওয়ার কারণ জানতে হবে। সাধারণ ক্ষেত্রে ডার্ক সার্কেল হওয়ার পেছনে জীবনযাত্রার একটি প্রভাব থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় ডার্ক সার্কেল দূর করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয় জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করতে। যেমন প্রথম অবস্থায় অবশ্যই ঘুমের সার্কেল ঠিক করতে হবে। দ্রুত ঘুমাতে যেতে হবে এবং খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। পরবর্তীতে খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। সঠিক পরিমাণ খাবার গ্রহণ করতে হবে। আয়রন জাতীয় খাবার খেতে হবে। ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে হবে। ক্যাফেইন জাতীয় খাবার কম গ্রহণ করতে হবে। কোনো স্ট্রেস এবং মানসিক উদ্বেগের মধ্যে থাকলে তা দূর করতে হবে। মানসিক চাপ দূর করার জন্য ব্যায়াম, ইয়োগা কিংবা মেডিটেশন করা যেতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে হবে। অনেক সময় জটিল কোনো রোগের লক্ষণ হিসেবে ডার্ক সার্কেল হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই অবহেলা না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়ে সকল ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। হরমোনের কারণে যদি ডার্ক সার্কেল হয়ে থাকে তাহলে ঔষধ খেয়ে হরমোন ব্যালেন্স করতে হবে। ওজন কমাতে হবে।

এছাড়া কিছু ঘরোয়া উপায়ে ডার্ক সার্কেল কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন নিয়মিত চোখের উপরে শসা কিংবা টমেটো ঘষলে ডার্ক সার্কেল অনেকটাই কমে আসে। এছাড়া অনেকে ডার্ক সার্কেল কমাতে বরফ থেরাপি নেয়। চোখের নিচে নিয়মিত হালকা করে বরফ দিয়ে ঘসলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় ও ডার্ক সার্কেল কমা শুরু করে। এছাড়া নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে, যেমন ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি সম্বৃদ্ধ খাবার। কলাতে অনেক পটাশিয়াম থাকার কারণে এটি যেকোনো কালো দাগ দূর করতে সাহায্য করে।

ডার্ক সার্কেল দূর করার ঘরোয়া উপায়

শশা

প্রথমে শশা গোল গোল করে কেটে ফ্রিজে রেখে দিন। এবার এই ঠান্ডা শশার টুকরা ১০-২০ মিনিট চোখের উপর দিয়ে রাখুন

টমেটো

১ চা চামচ টমেটো রসের সঙ্গে ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ডার্ক সার্কেলের উপর লাগান। এভাবে ১০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ভালো করে চোখ ধুয়ে ফেলুন।

গোলাপ জল

গোলাপ জলে তুলা ভিজিয়ে ১০ মিনিট চোখের পাতার উপর দিয়ে রাখুন

ঠান্ডা টি ব্যাগ

সাধারণ টি ব্যাগ বা গ্রিন টি ব্যাগ পানিতে ভিজিয়ে প্রথমে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে নিন। তারপর ঠান্ডা টি ব্যাগ ১০ মিনিট চোখের উপর দিয়ে রাখুন।

লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven − 3 =