জড় বস্তুতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে অ্যানিমেশন

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

ছোটবেলায় কার্টুন দেখেননি এমন ব্যক্তি পাওয়া বেশ দুষ্কর। এসব কার্টুনের সাথে মিশে আছে আমাদের হাজারো স্মৃতি, এখনো অনেকেই এসব কার্টুন দেখেন। তবে আমরা কী জানি কীভাবে আমাদের ছোটবেলায় স্মৃতিতে কার্টুন জায়গা করে নিল।

অ্যানিমেশন হচ্ছে একাধিক স্থির চিত্রের সমন্বয়ে বিশেষ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে স্থির চিত্রগুলোকে জীবন্ত ও সচল বলে মনে হয়। ল্যাটিন ভাষার শব্দ ধহরসধ (আত্মা/ংড়ঁষ), এর ক্রিয়াবাচক শব্দ হচ্ছে অহরসধঃব যার অর্থ আত্মা দান করা, বা প্রাণ দেওয়া। অর্থাৎ একটি জড় বস্তুতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। অ্যানিমেশনে জড়/স্থির চিত্রকে গতিশীল করে প্রাণ দেওয়া হয় বলেই একে অ্যানিমেশন বলা হয়। স্থির চিত্রকে গতিশীল করার প্রচেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে করা হয়েছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে গুহা চিত্রে একটি জন্তুর চারটি পায়ের জায়গায় আটটি পা আঁকা হয়েছিল যাতে মনে হয় চিত্রটি জীবন্ত। অতীতে গ্রিকরা মাটির গোল পাত্রের চারদিকে মানুষের ছবি এঁকে ছিল এবং পাত্রটি জোরে ঘুরিয়ে ছবিগুলোর নড়াচড়া লক্ষ্য করেছিল। প্রথম হাতে আঁকা ছবির সূত্রপাত হয় মিশরে, মিশরের পিরামিডের সমাধি ঘরে পাওয়া যায় প্রায় ৪০০০ বছর পুরানো ফুলদানি, তাতে কুস্তিযুদ্ধের পাঁচটি ছবির ক্রম দেখা যায়, যা দেখতে বর্তমানে কমিকসের মতো ছিল।

অ্যানিমেশনকে বর্তমান রূপ দেওয়ার আগে চলচ্চিত্রের কলাকৌশল পূর্ণাঙ্গ রূপে বিকশিত হওয়ার দরকার ছিল। বর্তমানে অ্যানিমেশন এই স্থানে পৌঁছানোর পেছনে অনেক মানুষের অবদান ছিল। এথোনেসিয়াস কার্চার নামক এক জাদুকর ১৬৪০ সালে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ নামের একটি যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি কাচে ছবি এঁকে সেই ছবি ম্যাজিক লণ্ঠনের মাধ্যমে পর্দায় প্রদর্শন করেছিলেন। যার ফলে অ্যানিমেশনের একটি রূপ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তখনকার সময় কার্টুন তৈরির জন্য সর্বদাই হাতে আঁকা ছবি ব্যবহার করা হতো। যদিও তখন ক্যামেরা আবিষ্কার হয়েছিল, তবে এসব কার্টুনের জন্য ক্যামেরায় তোলা ছবি ব্যবহার উপযোগী ছিল না। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন ‘জুট্রোপ’ নামক যন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি গতিশীল বস্তুর ক্রমিক ছবি তোলার জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন। এই কাজের জন্য ১৮৮৮ সালে তিনি তার সহযোগী উইলিয়াম ডিক্সন-কে দায়িত্ব দেন। দীর্ঘ গবেষণার পর তারা দুইজন ক্রমিক ছবি তোলার জন্য বিশেষ ছবির মাধ্যম কাইনেটোগ্রাফ তৈরি করেন এবং সেই ছবি চলমান অবস্থায় চালাবার জন্য কাইনেটোস্কোপ নামে এক ধরনের যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। ১৮৯৪ সালে ‘কাইনেটোস্কোপ’ যন্ত্র বাজারে আসে। এই যন্ত্রে একটি ফুটার মাধ্যমে চলমান ছবি দেখার ব্যবস্থা ছিল। তাতে একবারে একজন ব্যক্তি ছবিটি দেখতে পারতেন। এই অসুবিধা দূর করতে প্রতিদ্বন্দ্বী আবিষ্কারকরা সেই ছবি পর্দায় বড়ো করে দেখার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। টমাস এমার্ট নামক একজন বিজ্ঞানী ভিটাস্কোপ নামক এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা বর্তমানে প্রজেক্টর হিসেবে ব্যবহার হয়। এরপর থেকে অ্যানিমেশন ছবির নির্মাণ নতুন মাত্রা পায়।

১৮৬৮ সালে বাজারে আসে অন্য এক ধরনের নতুন খেলনা যার নাম ফ্লিপার বুক। এতগুলো যন্ত্রের মধ্যে এটিই ছিল তুলনামূলক সরল এবং জনপ্রিয়। ছবিটিকে বিভিন্ন আকারে আঁকতে হতো। আঁকা ছবিগুলো পৃষ্ঠা দ্রুত চলার ফলে ছবিগুলোকে বাস্তব রূপে দেখা যেত। এই ফ্লিপার বুক আজও বাজারে পাওয়া যায়। ১৯০৮ সালে এমিল কোল ‘ফ্যান্টাসমাগরি’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করেন। যা তৎকালীন সময় প্যারিসের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে দেখানো হয়। চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদদের মতে এটিই ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম অ্যানিমেটেড কার্টুন।

অ্যানিমেশন বা অ্যানিমেটেড কার্টুনকে সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে যদি কেউ নিয়ে যান তিনি হলেন উইনসর মেক্কে, তিনি ছিলেন আমেরিকান কমিকস শিল্পী। তিনি অনেক কমিকস এবং অ্যানিমেটেড কার্টুন নির্মাণ করেন। তার নির্মিত (‘খরঃঃষব ঘবসড় রহ ডড়হফবৎষধহফ’) ছিল তৎকালীন সময় জনপ্রিয় কমিক্স। নিজের সন্তানের জন্য উইনসর প্রায় ৪০০০ ছবিকে সংযুক্ত করে ১৯১১ সালে একটি অ্যানিমেটেড কার্টুন নির্মাণ করেন যার নাম দেন ‘খরঃঃষব ঘবসড়’ যা তৎকালীন সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। উইনসর ১৯১৮ সালে পঁচিশ হাজার ছবির সমন্বয়ে তৎকালীন সময়ে দীর্ঘতম অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করেন, যার নাম দেন  ‘ঞযব ঝরহশরহম ড়ভ ঃযব খঁংরঃধহরধ’। অ্যানিমেশনকে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উইনসর অবদান অনস্বীকার্য। যার সম্মান স্বরূপ ‘কার্টুন জগতের মোজার্ট’ বলে তাকে সম্বোধন করা হয়। মেক্কের অ্যানিমেশন খুব জনপ্রিয় এবং শিল্পকলাত্মক দিক থেকেও উন্নত হওয়ার পরেও তার আঁকা অ্যানিমেশন ছবির মান উন্নত ছিল না। মেক্কে নিজেই ছবি আঁকতেন যা ছিল যথেষ্ট সময়বহুল এবং কষ্ট সাপেক্ষ। যার কারণে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রয়োজন ছিল একাধিক ব্যক্তির অংশগ্রহণ, যার কারণে তখন অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের জন্য স্টুডিও গড়ে ওঠে। কয়েকজন শিল্পী একসাথে ছবি আঁকতেন  এবং সেগুলো ক্যামেরায় ফটোর মাধ্যমে তুলে অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করা হতো। অ্যানিমেশন ছবিগুলোকে কার্টুন বলা হতো। রাওল বার নামক একজন ব্যক্তি ১৯১৪ সালে অ্যানিমেশনের জন্য প্রথম স্টুডিও খুলেছিলেন। এরপর থেকে  পরবর্তী ১৭ বছর কার্টুন ছবি নির্মাণ করে এই স্টুডিওটি। অন্য অনেক স্টুডিও এই সময়কালে উঠে আসে। এই স্টুডিওগুলোকে অ্যানিমেশন ছবি মসৃণ এবং নির্মাণকার্য সহজ করে তুলবার জন্য নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছিল।

আধুনিক অ্যানিমেশনকে দৃষ্টিনন্দিত করার জন্য মেক্স ফ্লেইসার আবিষ্কার করেছিলেন রটোস্কোপ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ‘জীবন্ত ছবি’র ফ্রেমকে পরিবর্ধিত করে সেই ছবির ওপরে অ্যানিমেশন ছবির ফ্রেম আঁকা হতো। জীবন্ত মানুষের ছবি থেকে আঁকার কারণে ছবিগুলো স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিল ‘সেল’-এর  ব্যবহার। সেল  কাগজের মতো একটি পাত। সেলুলয়েড নির্মিত হওয়ার কারণে একে সংক্ষেপে সেল বলা হতো। আসলে সেল সেলুলয়েড সেলুলোজ নাইট্রেট এবং কর্পূরের মিশ্রণ। তবে এটি অতিমাত্রায় জ্বলনশীল এবং সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে সেলুলয়েডের পরিবর্তিত সেলুলোজ অ্যাসিটেট দ্বারা নির্মিত সেল ব্যবহার করা হয়। সেল পদ্ধতিটি বেশ সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে ১৯৯০ সাল থেকে সেলের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে স্টুডিওগুলি কম্পিউটার প্রোগ্রামের সহায়তা নিতে আরম্ভ করে।

অ্যানিমেশনকে তৈরি, সংরক্ষণ বা ধারণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেমন অ্যানালগ পদ্ধতি ও ডিজিটাল পদ্ধতি। অ্যানালগ পদ্ধতিতে  বই, ছবি, ভিডিও টেপ ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে জিআইএফ, ফ্ল্যাশ বা ডিজিটাল ভিডিও মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। উভয় মাধ্যমে অ্যানিমেশন প্রদর্শনের জন্য ক্যামেরা, কম্পিউটার বা প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। স্থির চিত্র জীবন্ত করার জন্য একটি ছবিকে সেকেন্ডে ২৪ বার তোলা হয় এবং প্রতিটি ছবিকে ফ্রেম বলা হয়। পরে প্রজেক্টরের সহায়তায় এই ফ্রেমগুলোকে ক্রম অনুসারে পর্দায় প্রদর্শন করা হয়। আমাদের সকলের দৃষ্টির জড়তার জন্য পরপর প্রদর্শিত স্থির চিত্রের ছবিগুলোকে আমরা চলন্ত দেখি। তবে বর্তমানে কম্পিউটারের সহায়তায় অ্যানিমেশন নির্মাণ সহজতর হয়েছে এবং ২উ ও ৩উ মতো স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত মাধ্যমে পাওয়া গেছে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠে অ্যানিমেশন স্টুডিও। বেশকিছু জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র গড়ে উঠে। এরমধ্যে জনপ্রিয় একটি চরিত্র হলো ‘ফেলিক্স-দা ক্যাট’। অন্যদিকে মেক্স ফ্লেইসারের ইংকওয়েল স্টুডিও থেকে উঠে এসেছিল অন্য একটি জনপ্রিয় চরিত্র ‘দ্যা ইংকওয়েল ক্লাউন’। প্রথম অবস্থায় এই  চরিত্রটির কোনো নাম ছিল না বলে তিনি নিজের নাম অনুসারে চরিত্রটির নাম দেন। পরে অবশ্য ‘কোকো’ নামকরণ করা হয় চরিত্রটির। ১৯২১ সালে ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন চরিত্রগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা কারণে, লাফ-ও-গ্রাম নামে একটি স্টুডিও তৈরি করেন যা ১৯২২ সাল পর্যন্ত ছয়টি কার্টুন ছবি নির্মাণ করে। ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন ছবিকে উন্নত করার জন্য ওয়াল্ট ডিজনি এবং ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও যুক্ত হয়, যার ফলে ১৯২৭ সালে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও থেকে নির্মাণ হয় মিকি মাউসের মতো কার্টুন, যা বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। যার ফলে আমরা ফ্রোজেন, ডোরা, টম অ্যান্ড জেরি, মিস্টার বিন এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় চরিত্র দেখতে পেয়েছি।

বাংলাদেশে অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র একদম নেই বললেই চলে। ২০১৯ সালে মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিনের পরিচালনায় সাইকোর স্টুডিওতে নির্মিত হয় ২৫ মিনিট দীর্ঘ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র ‘টুমরো’ যা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরিতে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দেশের বেশকিছু তরুণ বর্তমানে অ্যানিমেটেড সিনেমা তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

17 − 1 =