জলবায়ুতে নারী

আফরোজা নাইচ রিমা: নারী এবং জলবায়ু এক রকম শীতল পাটির মতো। শীতল পাটিতে বসলে শত গরমেও যেন আরাম পাওয়া যায়, তেমনি জলবায়ুর পরিবর্তন হলেও নারী যেন মানিয়ে তুলছে নিজেকে যুগোপযোগী করে। এখানেই নারী এবং জলবায়ু এক ও পরিপূরক।উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ২১ শতকের সুচনা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরুষদের চেয়ে নারীর ওপর বেশি পড়ে। জাতিসংঘের এক তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতদের তালিকায় ৮০ ভাগই নারী। বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাধারণত একটি পরিবারে নারীরা অন্য সদস্যদের খাবার তৈরি ও যত্নের দায়িত্বে থাকেন, ফলে বন্যা বা খরার সময়গুলোতে সংসার চালিয়ে নেওয়া তাঁদের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়ে।

রিও +২০ সম্মেলনে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ – সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায়নারীদের পূর্ণ ও সমঅংশগ্রহণ এর পথে বাধা দূরীকরণ এবং নেতৃত্বে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়েছে।  UNFCCC ও জাতীয়প্রতিনিধিবর্গের মাঝে লৈঙ্গিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার এক  প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে , ‘নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়’ এবং নারীদের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে একঘরে করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের উপাত্ত হতে দেখা যায়UNFCCC এর প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের নগণ্য উপস্থিতি, যার মাঝে রয়েছে অভিযোজন কমিটি (শতকরা ২৫ ভাগ), GEC কাউন্সিলের (শতকরা ১৯ ভাগ) ও এক্সপার্ট গ্রুপে (শতকরা ১৫ ভাগ) এবং সামগ্রিকভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শতকরা ২০ ভাগ  প্রতিনিধিদলের প্রধান নারী ও UNFCCC এর সভাগুলোতে নারী প্রতিনিধি শতকরা ৩০ ভাগেরও কম।

২০২১ সালে গ্লাসগোতে কপ ২৬ এর সাইড লাইন এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  উইমেন এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ  শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের এক প্যানেল আলোচনায়  বলেন ,উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীরা এর মধ্যে অন্যতম। নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নিতে পারে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সাহসী ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নারীদের দুর্বলতাগুলো মোকাবেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের জন্য জায়গা তৈরি করাটা জরুরি। বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একেবারে তৃণমূল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করেছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত নীতি ও কৌশলে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন ও জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করার কথাও জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিভিএফ একটি জলবায়ু জরুরি চুক্তি নিয়ে এসেছে। চুক্তিটি জলবায়ু অর্থ সরবরাহ পরিকল্পনাকে সমর্থন করে। এটি তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখার বিষয়টির ক্রমাগত অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। কপ২৬-এর প্রেসিডেন্সি ও ইউএনএফসিসিসির সব সদস্যকে সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের অংশ হিসেবে জলবায়ু জরুরি চুক্তি গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি ।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন কৃষি থেকে আরম্ভ করে জ্বালানি কিংবা পানি সংগ্রহ অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারী থেকে আরম্ভ করে সকল কন্যা এবং শিশুদের জন্য অভিযোজনের বহুমাত্রিক উপায় বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে।

দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশে ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক আছে। যাদের ৫০ শতাংশই নারী। পলিসি তৈরি থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে সবখানে সরকার নারীদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচির মাধ্যমে মৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশ সফল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ৫০ বছর আগে একটি ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গেছেন। সেখানে এক বছর আগে সে রকম একটি ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকশতে এসে দাঁড়িয়েছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৩ নম্বর এ  বলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ  এবং নারী ,যুবসমাজ ,স্থানীয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রাধিকারসহ স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে অর্থায়ন ,প্রযুক্তি ও সক্ষমতা বিনির্মাণসহ সহায়তার পরিমাণ ও বিশেষ সহায়তাপ্রাপ্ত স্বল্পোন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে সাহায্য করা ।

নারী এবং জলবায়ু পরিবর্তন এক ও অবিচ্ছেদ্য। পরিবেশের উপর নারীর প্রভাব বেশি ,কেননা নারীরা পুরুষদের চেয়ে প্রকৃতির উপর বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু ,জলবায়ুর প্রভাবের কথা বিবেচনা  কল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রণীত হয়েছে অনেক আইন ও নীতিমালা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -পরিবেশ এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত রিও ঘোষণা ১৯৯২। এ ঘোষণার ২০ নম্বর নীতিতে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক ( POPs ) ক্ষতিকর পদার্থ -সংক্রান্ত স্টকহোম কনভেনশন ২০০১ এর অনুচ্ছেদ ১০ ( গ) তে বলা হয়েছে, POPs  – সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষত নারী, শিশু ও কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষাগত ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য কনভেনশন ১৯৯২ এ বলা হয়েছে যে ,জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও এর উপাদানগুলোর টেকসই ব্যবহারের সাথে সম্পকিত সনাতনী জ্ঞান আবিষ্কার ও চর্চার ফলে যে সুবিধার সৃষ্টি হবে তা ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টন করে নেওয়ার ইচ্ছাকে স্বীকার করে নিয়ে জীববৈচিত্র্য  সংরক্ষণ ও এর টেকসই ব্যবহারে নারীসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করে নিয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের সব স্তরে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিয়ে এ কনভেনশন গৃহীত হয়।

মরুকরণ মোকাবেলায় জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৪ এর অনুচ্ছেদ ৫ (ঘ) ও ১০ -এ বলা হয়েছে যে পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ মরুকরণ মোকাবেলায় ও খরা কমানোতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার সকল কর্মসূচিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাধ্য। ১৯৯৫ সালের বেইজিং চতুর্থ নারী সম্মেলন এ নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকল্পে বেশ কিছু কৌশল ঠিক করা হয়। এককথায় ,বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত ন্যায়বিচার সুরক্ষায় নারীর অংশগ্রহণকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান ,দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ ,বননীতি ১৯৯৪ ,খাদ্যনীতি ২০০৬ , পানিনীতি ১৯৯৯ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নারী ও পরিবেশের সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৩ তে বলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবের প্রাথমিক স্বীকার নারী ,তাই নারীরা যাতে করে অভিযোজন ও প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এজন্য নারীর অবদান গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ডায়ানা লিভারম্যান বলেন,’ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই গুরুত্ব সহকারে জলবায়ু পরিবর্তনের সকল আলোচনার স্তরে নারীদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। কেননা ,জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষমতার কোনো লড়াই না ,এটি টিকে থাকার লড়াই।’পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে নারীর ভূমিকা অপরিহার্য। টেকসই উন্নয়ন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পরিবেশ সংরক্ষণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণই নিশ্চিত করবে আগামীর সুন্দর ভবিষ্যৎ।

লেখক: সিনিয়র ইনফরমেশন অফিসার, পিআইডি

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 3 =