জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে যোগদিতে প্রধানমন্ত্রীর নিউ ইয়র্ক আগমনে বাংলাদেশ মিশনের প্রেস ব্রিফিং

শিব্বীর আহমেদ

জাতিসংঘ, নিউ ইয়র্ক

আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতরে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম  অধিবেশন। এই অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ বিশ্বের প্রায় দেড় শতাধিক রাষ্ট্রপ্রধান এই সাধারণ অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে এক প্রেস ব্রিফিং এ জানিয়েছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত এম এ মুহিত। এ সময় মিশনের ডেপুটি প্রধান তৌফিক ইসলাম শাতিল উপস্থিত ছিলেন।

নিউ ইয়র্কের সাংবাদিকদের সাথে গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এই প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফরের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত এম এ মুহিত বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম  অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আগমী ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে নিউইয়র্কে পৌঁছাবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এমপি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি, বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড.তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী,বীর বিক্রম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক এমপি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হবেন।

এ বছর সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য “Rebuilding trust and reigniting global solidarity: Accelerating action on the 2030 Agenda and its Sustainable Development Goals towards peace, prosperity, progress and sustainability for all”। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস পুনর্গঠন এবং বিশ্বব্যাপী সংহতি পুনরুজ্জীবিত করার বিষয় এবারের অধিবেশনে গুরত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। বৈশ্বিক শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২০৩০ এজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন সংক্রান্ত আলোচনা এবারের অধিবেশনে বিশেষ প্রাধান্য পাবে।

এছাড়াও অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ পরিষদের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য প্রদান করবেন। জাতিসংঘের সর্বশেষ শিডিউল অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী আগামি ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরের আগেই বক্তব্য প্রদান করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রদূত এম এ মুহিত। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য ইত্যাদি বিষয়ের উপর আলোকপাত করবেন। পাশাপাশি, বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, নিরাপদ অভিবাসন, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক সংকট, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তুলে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঘের ৫টি উচ্চ পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করবেন। প্রথমত, আগামি ১৮-১৯ সেপ্টেম্বর SDG Summit 2023 অনুষ্ঠিত হবে। দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভায় জাতিসংঘ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের অগ্রগতি, প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং এই  প্রতিবন্ধকতাসমূহের উত্তরণ ঘটিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে কিভাবে লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই সামিটের অধীনে বিভিন্ন থিমের ওপর ৪ টা “Leaders’ Dialogue” অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী ১৮ সেপ্টেম্বর  “Leaders’ Dialogue-4” এ কথা বক্তব্য রাখবেন। “Leaders’ Dialogue-4” এর বিষয় হল “Strengthening integrated policies and public institutions for achieving the SDGs”।

দ্বিতীয়ত, আগামী ২০ সেপ্টেম্বরে High-level meeting on pandemic prevention, preparedness and response অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সভার প্লেনারি সেশনে বক্তব্য দিবেন। তৃতীয়ত, ২০ সেপ্টেম্বর Annual Meeting of the UNGA Platform For Women Leaders অনুষ্ঠিত হবে । এই সভাটি প্রতিবছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি বিশ্বের নারী নেতৃবৃন্দের সম্মানে আহবান করে থাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী এতে অংশগ্রহণ করবেন।

চতুর্থত, ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিবের আহবানে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ‘Climate Ambition Summit’ অনুষ্ঠিত হবে। এই সামিটের High Level Thematic Session “Delivering climate justice: Accelerating ambition and implementation on adaptation and early warnings for all”-এ বক্তব্য দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  পঞ্চমত, ২১ সেপ্টেম্বর  High-level Event on Universal Health Coverage অনুষ্ঠিত হবে। এই সভার প্লেনারি সেশনে বক্তব্য দিবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যবান্ধব নীতি এবং জনগনের স্বাস্থ্য উন্নয়নে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনসমূহ তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই ৫টি সভার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রধানদের আহবানে ৪ টি উচ্চ-সভায় অংশগ্রহণ করবেন। এর মধ্যে জলবায়ু সুংক্রান্ত ২টি বৈঠক `High-Level Breakfast Summit on Climate Mobility and High Level Breakfast Summit on addressing the existential threat posed by sea-level rise’, এবং `United Nations Industrial Development Organization (UNIDO)-এর আয়োজনে High Level event on ‘Thought for Food-Collaborating for food supply chain innovation to accelerate the SDGs’-তে অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়াও স্পেনের প্রধানমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আহবানে High Level Roundtable on “Towards a Fair International Financial Architecture’ এ অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সাধারণ পরিষদে বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের সভা আহবান করে থাকে। প্রতিবছরের ন্যায় বাংলাদেশও এ বছর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আমরা ২টি High-level Side Event আয়োজন করেছে এবং এই ইভেন্ট দুইটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন।  অনুষ্ঠান ২টির প্রথমটি Community Clinic and Universal Health Coverage সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের সভা যা অনুষ্ঠিত হবে ১৯ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের এই সভাটি Antigua and Barbuda, Bhutan, China, Malaysia, Chatham House, UK এবং Suchona Foundation কো-স্পন্সর করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে Community Clinic প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের সকল মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বাংলাদেশ যে যুগান্তকারী সফলতা অর্জন করেছে,  এই সভাতে তা তুলে ধরা হবে।

দ্বিতীয়টি আগামি ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে Rohigya Crisis সংক্রান্ত  উচ্চ পর্যায়ের সভার আয়োজন করা হয়েছে। এই সভাটির  সহ-আয়োজক হিসেবে রয়েছে Canada, Gambia, Malaysia, Türkiye, United Kingdom, Unites States of America। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যার ষষ্ঠ বছরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিকভাবে গৃহীত পদক্ষেপ আশানুরূপ কোন সমাধান দিতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন এক নম্বর priority ইস্যু। এই বক্তব্যই আবারও বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দিতে এই সাইড ইভেন্ট আয়োজন করা হয়েছে।

উপরোক্ত সভায় অংশগ্রহনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং বেশ কয়েকটি দেশ ও সংস্থার প্রধানরা  দিপাক্ষিক সভা করবেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামি ২০ সেপ্টেম্বর একটি Ocean Governance সংক্রান্ত International Treaty স্বাক্ষর করবেন, যা  সংক্ষেপে BBNJ Agreement বলা হয়ে থাকে।  জাতিসংঘ সদর দপ্তর এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সাধারণ পরিষদের lobby area -কে স্থান হিসেবে নির্ধারিত করেছে।

এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। এছাড়া, জার্মানির Chancellor-এর আহবানে 50th Anniversary of Germany’s Membership to the United Nations সংক্রান্ত একটি Reception-এ অংশগ্রহণ করবেন বলে রাষ্ট্রদূত এম এ মুহিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফরের সময় বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেয়ার পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রী  একে আব্দুল মোমেন এমপি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ, জলবায়ু পরিবর্তন, LDC, ACD, OIC, NAM, BIMSTEC, G-77 বিষয়ক বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করবেন। হাঙ্গেরি এবং কাজাখাস্তান-এর সাথে ২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী/অন্যান্য মন্ত্রীগণের সাথে দ্বিপাক্ষিক সভায় মিলিত হবেন। এর মধ্যে ঘানা, অস্ট্রেলিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং নেদারল্যান্ডস-এর বৈদেশিক বাণিজ্য এবং উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী অন্যতম।

এবারের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের মূল বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্যখুবই জরুরি। বিশেষ করে, যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিহার করে চলমান খাদ্য ও জ্বালানি সংকট নিরসন, আর্থিক অনিশ্চয়তা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা, বিশ্বশান্তি, বহুপাক্ষিকতাবাদ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট  লক্ষ্যসমূহ অর্জন প্রভৃতি বিষয়ে এবারের সাধারণ অধিবেশনে গুরুত্বের সাথে আলোচনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়াও অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা এবং এর স্থায়ী ও টেকসই সমাধান এর বিষয়টিও ব্যাপকভাবে আলোচিত হবে, যা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে।

জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন সুদৃঢ় করবে, তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরো প্রসারিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত এম এ মুহিত।

সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন রাষ্ট্রদূত এম এ মুহিত এবং সবশেষে রাতের খাবারে আমন্ত্রণ জানান।

শিব্বীর আহমেদ: গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আইটি বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 6 =