জাপানের ওকামতো দম্পতির ২৫৪ বিলিয়ন ইয়েন দান

হক মো. ইমদাদুল

মানবতার এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়

জাপানের ক্ষুদ্রতম শহর ওয়ারাবি, যার আয়তন মাত্র ৫.১১ বর্গকিলোমিটার, সেখানেই ঘটেছে এক অনন্য ঘটনা। ৭৭ বছর বয়সী কোইচি ওকামতো এবং ৭৫ বছর বয়সী আকেমি ওকামতো দম্পতি তাদের সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ থেকে ২৫৪ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ২,০৪০ কোটি টাকা) দান করেছেন ওয়ারাবি শহরের হাসপাতাল পুনর্নির্মাণের জন্য। এই দান শুধুমাত্র আর্থিক অনুদান নয়, এটি এক মানবিক বিপ্লব, যা সমাজের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

ওয়ারাবি: জাপানের ক্ষুদ্রতম শহর

ওয়ারাবি শহরটি সাইতামা প্রিফেকচারে অবস্থিত। ক্ষুদ্রতম শহর হলেও এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি—প্রায় ৭০,০০০ মানুষ বসবাস করে। এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দীর্ঘদিন ধরেই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। শহরের হাসপাতালটি অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছিল এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব ছিল। অর্থনৈতিক কাঠামো মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় উন্নত চিকিৎসা সেবার সুযোগ কম ছিল।

তবে এটি তাদের জীবনে প্রথম দান নয়—এর আগেও ওকামতো দম্পতি বহুবার সমাজের কল্যাণে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করেছেন। তাদের জীবন, সংগ্রাম, সাফল্য এবং এই বিশাল দানের পেছনের কারণ জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তাদের জীবনের শুরুতে।

ওকামতো দম্পতির জীবন ও দানের পেছনের কিথা

জন্ম ও শৈশব

কোইচি ওকামতো ১৯৪৮ সালে এবং আকেমি ওকামতো ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যখন পুনর্গঠনের পথে হাঁটছিল, তখন তারা কঠোর বাস্তবতার মধ্যে বেড়ে ওঠেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই দম্পতি ছোটবেলা থেকেই তারা জানতেন, সাফল্যের একমাত্র পথ কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়।

শিক্ষা ও কর্মজীবন

ওকামতো দম্পতির শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত না হলেও জানা যায়, তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরই নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছেন। কোইচি ওকামতো একজন দক্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে দীর্ঘদিন বিনিয়োগ কোম্পানির নির্বাহী ছিলেন, যেখানে তার ব্যবসায়িক কৌশল ও নেতৃত্বগুণ তাকে বিপুল সম্পদ অর্জনে সহায়তা করে। অন্যদিকে, আকেমি ওকামতো তার স্বামীর পাশে থেকে আর্থিক পরিকল্পনায় সহযোগিতা করেছেন। তারা সব সময় সংযমী জীবনযাপন করতেন এবং তাদের মূলমন্ত্র ছিল—সংযমী জীবন ও সমাজসেবার প্রতি অঙ্গীকার।

সম্পদ অর্জন ও সামাজিক দায়িত্ববোধ

১৯৯৫ সালে জাপানে ঘটে ভয়াবহ হানশিন-আওয়াজি ভূমিকম্প, যা ৬,৪০০-এর বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং কয়েক হাজার মানুষকে গৃহহীন করে। এই ভূমিকম্প ওকামতো দম্পতির চিন্তাভাবনায় গভীর পরিবর্তন আনে। তারা স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত হন এবং উপলব্ধি করেন, সমাজের দুর্বল ও অসহায় মানুষের জন্য কিছু করা দরকার।

এরপর থেকেই তারা সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন এবং ২০০২ সালে ব্যক্তিগত অর্থায়নে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তারা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের জন্য দান করতে থাকেন। তারা মনে করতেন, সমাজের উন্নয়ন হলে তবেই ব্যক্তি ও পরিবার সত্যিকারের সুখ লাভ করতে পারে।

ওকামতো দম্পতির পূর্ববর্তী দান ও সমাজসেবা

ওকামতো দম্পতির দানের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তারা শুধুমাত্র এবারই বিপুল অর্থ দান করেননি—এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বহুবার দান করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা, পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প, এবং গবেষণা কার্যক্রম। তবে ওয়ারাবি হাসপাতালের পুনর্নির্মাণের জন্য এত বিশাল পরিমাণ অর্থ দান করার সিদ্ধান্ত সমাজকে বিস্মিত করেছে। তারা বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিয়েছেন, দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন এবং অসুস্থ ও প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করেছেন। এত সম্পদ থাকার পরও তারা কখনও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ব্যয় করেননি, বরং সবসময় সমাজের কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন।

১. ১৯৯৫ সালের হানশিন-আওয়াজি ভূমিকম্প ত্রাণ তহবিল

ভূমিকম্পের পর তারা বিপুল অর্থ পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য দান করেন।

২. ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামি ত্রাণে সহায়তা

জাপানের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামির পর তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুনর্গঠনের জন্য বিপুল অর্থ দান করেন।

৩. ২০১৫ সালে শিশুদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি

অসহায় ও গরিব শিশুদের জন্য তারা শিক্ষা বৃত্তি চালু করেন, যা বহু শিশুকে শিক্ষার আলো এনে দিয়েছে।

৪. ২০১৯ সালে হাসপাতালের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম দান

একটি হাসপাতালকে উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য তারা অনুদান দেন।

বর্তমান জীবন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ওকামতো দম্পতি বর্তমানে সংযমী জীবনযাপন করেন। তারা বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে সমাজসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন, সাধারণ খাবার খান এবং নিজেরাই রান্না করেন। তাদের মতে, জীবনের শেষ সময়টুকু সমাজের কল্যাণে ব্যয় করাই প্রকৃত শান্তির উৎস ।

✔ তারা বিলাসবহুল বাড়ি বা গাড়ি ব্যবহার করেন না।

✔ তারা নিজেদের রান্না নিজেরাই করেন এবং খুব সাধারণ খাবার খান।

✔ তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন এবং সাধারণ জীবনযাপন করেন।

তাদের মতে, জীবনের শেষ সময়টুকু সমাজের কল্যাণে ব্যয় করাই প্রকৃত শান্তির উৎস। তবে, তাদের সন্তানদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। তাদের সন্তান আছে কিনা, থাকলে তারা কী করেন বা তারা এই বিশাল দানের বিষয়ে কী ভাবেন—সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে এই দান নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল কিনা, সেটিও জানা যায়নি। তবে, এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা নিশ্চয়ই পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বা নিজেরাই পরিপূর্ণভাবে চিন্তা-ভাবনা করে এই মহৎ কাজে নিজেদের সম্পদ উৎসর্গ করেছেন।

এই তথ্যের অভাব সত্ত্বেও ওকামতো দম্পতির দানের ব্যাপ্তি এবং সমাজের প্রতি তাদের গভীর দায়বদ্ধতা আজীবন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

দানের প্রভাব ও শহরের প্রতিক্রিয়া

ওয়ারাবি শহরের বাসিন্দারা এই দানকে অভূতপূর্বভাবে গ্রহণ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিকরা ওকামতো দম্পতির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এই অর্থের মাধ্যমে শহরের পুরনো হাসপাতালটি আধুনিকভাবে পুনর্নির্মাণ করা হবে, যেখানে উন্নত চিকিৎসাসেবা, নতুন যন্ত্রপাতি এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থাকবে। এ হাসপাতালের উন্নয়ন শুধুমাত্র ওয়ারাবি শহরের বাসিন্দাদের জন্য নয়, বরং আশপাশের অঞ্চলগুলোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

জাপানের গণমাধ্যমে আলোড়ন

ওকামতো দম্পতির দানের খবর এনএইচকে, আসাহি শিম্বুন, মাইনিচি শিম্বুন, ইয়োমিউরি শিম্বুন, ফুজি টিভি সহ শীর্ষ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়।

বিশ্বের ধনী সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা

ওকামতো দম্পতির এই দান শুধুমাত্র ওয়ারাবি শহরের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ বা বিশ্বের অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা যদি এই মহানুভবতা থেকে অনুপ্রাণিত হন, তবে দারিদ্র্য বিমোচন ও জনকল্যাণমূলক কাজের প্রসার আরও ত্বরান্বিত হবে। ধনী ব্যক্তিদের উচিত তাদের সম্পদের একটি অংশ সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা, যাতে দারিদ্র্য হ্রাস পায় ও মানবতার উন্নয়ন সম্ভব হয়।

উপসংহার

ওকামতো দম্পতির দানের এই অনন্য দৃষ্টান্ত নিছক আর্থিক অনুদান নয়, বরং এটি মানবতার প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার এক চিরন্তন উদাহরণ। তারা প্রমাণ করেছেন যে প্রকৃত সুখ ও মানসিক পরিতৃপ্তি অন্যের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই নিহিত। তাদের দানের পেছনে কেবল আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং মানবপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার এক শক্তিশালী বার্তা রয়েছে। আজকের বিশ্বে যেখানে অনেকে সম্পদকে কেবল নিজের বিলাসিতা ও ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় করে, সেখানে ওকামতো দম্পতি দেখিয়ে দিয়েছেন, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয় সেটি কীভাবে এবং কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে।

তাদের এই নিঃস্বার্থ অবদান শুধু জাপানের মানুষের নয়, বরং সারা বিশ্বের অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং বিত্তশালীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। যদি সমাজের বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন এবং সম্পদকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত করেন, তাহলে বিশ্বে দারিদ্র্য হ্রাস পাবে, সামাজিক বৈষম্য কমবে এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটবে। ওকামতো দম্পতির মতো মানুষদের কারণেই সমাজে আশার আলো জ্বলে ওঠে, এবং তারা মনে করিয়ে দেন যে দানশীলতা ও উদারতা মানবসভ্যতার অন্যতম ভিত্তি।

তাদের এই দান ও মহানুভবতা শুধু ওয়ারাবি শহর নয়, সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জাপানের গণমাধ্যম এই দানের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে দানের গুরুত্ব, মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করেছে। তাদের এই মহৎ কাজ প্রমাণ করে যে দানশীলতা শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং নৈতিক ও মানবিক আদর্শের ক্ষেত্রেও এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত। যদি যুগে যুগে এমন মহান ব্যক্তিদের জন্ম হয়, যারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণে নিজেদের সর্বস্ব উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে বিশ্ব আরও মানবিক, সহানুভূতিশীল ও উন্নত হয়ে উঠবে। ওকামতো দম্পতির এই মহান দান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

হক মো. ইমদাদুল, জাপান: লেখক, সংগ্রাহক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − 12 =