জায়ান্টবধের বিশ্বকাপে ভারতের মুক্তি

নিবিড় চৌধুরী

অবশেষে প্রায় ১৪০ কোটি ভারতীয়দের মনে স্বস্তি ও এক অভিশাপ থেকে মুক্তির আনন্দ এনে দিলেন রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলিরা। আহমেদাবাদে ঘরের সমর্থকদের সামনে গত নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার হলুদ উৎসবের সামনে তাদের বেদনায় নীল হয়ে যাওয়ার কষ্ট ঘুচল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট হলো মার্কিন মুলুকে। শুধু তাই নয়, আফগানদের উত্থান, শুরুতেই জায়ান্টদের বিদায়, ড্রপ ইন পিচ, ব্যাটারদের রানখরা, বিভিন্ন কারণে স্মরণে থাকবে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

যুক্তরাষ্ট্রের চমক

বিশ্বকাপের আগেই বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে মিলে নিজেদের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন, স্বাগতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে কেউ ফেবারিটের তালিকায় রাখেনি। ফেবারিট না হলে কী হবে, শুরুর চমকটা তারাই দিয়েছে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই প্রথমবার মার্কিন সফরে যাওয়া বাংলাদেশের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতার ধারাবাহিকতাটা তারা ধরে রাখে মূল মঞ্চেও। সুপার ওভারের রোমাঞ্চে পাকিস্তানকেও হারিয়ে ইতিহাস গড়ে। প্রথমবারের মতো খেলে সুপার এইট। নিউ জিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার কোরি অ্যান্ডারসনসহ দলে একঝাঁক বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্রের শুরুটা টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে প্রতিবেশি কানাডাকে হারিয়ে। গ্রুপ ‘এ’ থেকে ভারতের সঙ্গী হয়ে পরের রাউন্ডে যায় তারা। সেখানে অবশ্য বলার মতো তেমন কিছু করতে পারেনি।

জায়ান্টদের বিদায়

সীমিত ওভারে শিরোপা না জিতলেও গত এক দশকে ক্রিকেটের অন্যতম সফল দল নিউ জিল্যান্ড। ২০১৫ থেকে তিন সংস্করণ মিলিয়ে চারবার ফাইনাল খেলেছে কিউইরা। ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ২০২১ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে তারা প্রথম কোনো বৈশি^ক শিরোপার স্বাদ পায়। একই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালেও হারে ব্ল্যাক ক্যাপরা। নিউ জিল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মের সাফল্য অনেক। কিন্তু জিততে পারেনি তেমন কিছু। এবার তো তারা প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল গ্রুপ পর্বেই। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় সাবেক দুই চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। এমন এক বিশ্বকাপকে অঘটনের না বলে উপায় আছে? গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াও এবার ঘরে ফিরে সেমি ফাইনালের আগে।

আফগানদের উত্থান

কাবুলে এমন আনন্দ হয়েছিল কবে? রশিদ খানরা বিশ্বকাপে একের পর এক ম্যাচ জিতছে আর আনন্দ উৎসব হচ্ছে আফগানিস্তানের শহরটিতে। আফগানদের কাছে এই বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রথমবার আইসিসির কোনো মঞ্চে তারা খেলল সেমি ফাইনাল। দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়াও তাদের জন্য এই প্রথম। গ্রুপ পর্বে নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়েছে। সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়াকে। আর কী লাগে! ওশেনিয়ার এই দুই দলের বিশ্বকাপ যাত্রা থামিয়ে দেয় আফগানরাই। অবশ্য শেষ চারে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে। তবে এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের উত্থানের গল্পটাও লিখলেন রশিদরা। বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার সুবিধাই যেন পেল আফগানিস্তান। এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের ও সর্বোচ্চ উইকেটের মালিকও হয়েছেন তাদের দুজন, অপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ ও পেসার ফজলহক ফারুকি।

স্বাগতিকদের অভিশাপ

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসে স্বাগতিক হয়ে কোনো দল শিরোপা জিততে পারেনি। সেই রেকর্ড অক্ষুণ্ন থাকল এবারও। আয়োজক ওয়েস্ট ইন্ডিজের দৌড় থামে সুপার এইটে। টুর্নামেন্টের দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা গ্রুপ সেরা হয়ে পরের রাউন্ডে উঠেছিল। সহআয়োজক যুক্তরাষ্ট্রও থামে সুপার এইটে।

সূচি ও ফ্লাইট জটিলতা

প্রথমবারের মতো মার্কিন মুলুকে বিশ্বকাপ। নতুন পরিবেশে রানখরায় ভুগতে হয়েছে ব্যাটারদের। বলতে গেলে, এই বিশ্বকাপ ছিল বোলারদের। নিউ ইয়র্কের নাসাউয়ের ড্রপ ইন উইকেটে লো স্কোরিং ম্যাচে তারা-ই তোপ দাগিয়েছে। সঙ্গে শুরু থেকে আলোচনায় উঠে আসে, সূচি ও ভ্রমণ বিড়ম্বনার বিষয়টি। শ্রীলঙ্কা দল অভিযোগ করে, এক ম্যাচ শেষ করেই তাদের দ্রুত অন্য শহরে যেতে হয়েছে। যেখানে বেশ কয়েকটি দল একই মাঠে টানা কয়েকটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া ফাইনালের আগে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে বার্বাডোজে যাওয়ার আগে ফ্লাইট জটিলতার কারণে তাদের পরিবারসহ ত্রিনিদাদে আটকে থাকতে হয় ৬ ঘণ্টা। তাদের সঙ্গে ছিলেন আম্পায়াররাও। সেমি ফাইনালের আগে আফগানিস্তানকে প্রায় ৪ ঘণ্টা একই কারণে অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি শুরু থেকে ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকেও একই ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ড এসব নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করে।

ভারতের মুক্তি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…’। ভারতের মুক্তি যেন বিশ্বকাপ জিতে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম চ্যাম্পিয়ন তারা। ২০০৭ সালে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিরা। এরপর ১৭ বছর পেরিয়ে গেছে। ভারত ২০১৬ সালে আরেকটি সীমিত ওভারের এই বিশ্বকাপ খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। অবশেষে সেই আক্ষেপ ঘুচল। ২৯ জুন রাতে বার্বাডোজে রোমাঞ্চকর ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শিরোপা জেতে ভারত। সঙ্গে ১১ বছর পর কোনো আইসিসির শিরোপাও হাতে উঠল তাদের। এ নিয়ে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমান দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতল ভারত। ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের সমান তিন ফাইনাল খেলল টুর্নামেন্টে। সমান দুটি বিশ্বকাপ জিতল ৫০ ও ২০ ওভারের ক্রিকেটে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ফাইনাল

লম্বা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপ দিয়ে বিশ্বমঞ্চে পদার্পণ। সেবার বিতর্কিত বৃষ্টি আইনে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে সেমিফাইনালে থেমে গিয়েছিল প্রোটিয়াদের স্বপ্ন। এরপর থেকে যে গায়ে ‘চোকার’ শব্দটি লাগল তাদের গায়ে, সেটি কিছুতেই গেল না। ১৯৯৯ সালে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর আর কোনো বৈশি^ক শিরোপা জিততে পারেনি। এবার অবশ্য সেটির খুব কাছে ছিল। কিন্তু ফাইনালেও চোকিং করে তারা। খুব কাছে গিয়েও জেতা হয়নি শিরোপা। আটবারের চেষ্টায় কোনো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও শিরোপা জেতা হলো না প্রোটিয়াদের। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপেও দুর্দান্ত খেলে শেষ চারে বিদায় নিয়েছিলেন এইডেন মার্করামরা।

যত বিতর্ক

ফাইনালে জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৬ রান। আর্শদীপ সিংয়ের করা প্রথম বল উড়িয়ে মেরেছিলেন স্ট্রাইকে থাকা ডেভিড মিলার। কিন্তু বাউন্ডারিতে দারুণভাবে বলটি লুফে নেন সূর্যকুমার যাদব। থার্ড আম্পায়ার চেক করে মিলারকে আউট দেন। তবে সেই আউট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় এরপর। অনেকে মনে করেন, সূর্যকুমারের পা ক্যাচ নেওয়ার সময় বাউন্ডারি লাইনে লেগেছে। আর থার্ড আম্পায়ারও খুব বেশি পরীক্ষা করেননি এটি। এই বিতর্ক ছাড়াও ভারত-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় সেমিফাইনালে রিজার্ভ ডে না থাকায় বিতর্ক শুরু হয়। আফগানিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম সেমি ফাইনালে রিজার্ভ ডে থাকলেও পরের সেমিতে সেটি না থাকা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। দ্বিতীয় সেমি বৃষ্টির কারণে ভেস্তে যেতে বসেছিল। তবে রিজার্ভ ডে না থাকায় এই ম্যাচের জন্য প্রায় ৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় রাখা হয়। বৃষ্টির কারণে দেরিতে টস ও ম্যাচ কয়েকবার বন্ধও হয়ে যায়। রিজার্ভ ডে না থাকায় ইংল্যান্ডের সাবেক ব্যাটার মাইকেল ভন, পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক সমালোচনা করেন আইসিসির। এমনকি রোহিত শর্মারা সেমি ফাইনাল ভেন্যুসহ বেশকিছু সুবিধা পেয়েছে বলে জানান ভারতের সাবেক ব্যাটার সঞ্জয় মাঞ্জরেকার।

অবসরের  হিড়িক

চাইলে আরও কয়েক বছর খেলে যেতে পারতেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ তরতাজা থাকতেই ফাইনালের ম্যাচসেরার পুরস্কার নিতে এসে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন বিরাট কোহলি। কিছু সময়ের পর একই ঘোষণা দেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মাও। বিশ্বকাপ জয়ের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই অবসরের ঘোষণা দেন অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজাও। এই তিনজনকে আর দেখা যাবে না ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলতে। অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে দেখা যাবে না ডেভিড ওয়ার্নারকে। টেস্ট ও ওয়ানডে থেকে আগেই অবসর নিয়েছিলেন তিনি। জানিয়ে রেখেছিলেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর এই ফরম্যাটেও থামবেন। অজিরা সুপার এইটে থেমে যাওয়ার পর আর আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলতে হয়নি ওয়ার্নারকে। নিউ জিল্যান্ড গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার পর পেসার ট্রেন্ট বোল্ট বিদায় বলে দেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে। হয়তো ২০২৬ বিশ্বকাপে দেখা যাবে না আফগানিস্তানের দীর্ঘদিনের সঙ্গী মোহাম্মদ নবীকেও। রোহিত-কোহলি বিদায় নেওয়ার পর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে, কবে বিদায় বলবেন সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই দুই বাংলাদেশি অলরাউন্ডার এবারের বিশ্বকাপে ছিলেন নিষ্প্রভ। সাকিবের বয়স হয়ে গেছে ৩৭, মাহমুদউল্লাহর ৩৮। তাদের সময় এসেছে তরুণদের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার। কিন্তু এখনো অবসরের ঘোষণা না দেওয়ায় শুরু হয়েছে সমালোচনা।

দ্র্রাবিড়ের স্বস্তির বিদায়

খেলোয়াড় হিসেবে কখনো বিশ্বকাপ জেতা হয়নি রাহুল দ্রাবিড়ের। ২০০৩ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে না হারলে হয়তো সেই স্বাদ পেয়েও যেতেন ‘দ্য ওয়াল’। ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে ভারত বিশ্বকাপে গিয়ে ফিরে আসে গ্রুপ পর্ব থেকে। খেলোয়াড় হিসেবে যে শিরোপা জিততে পারেননি, সেটি এবার কোচ হিসেবে জিতেছেন তিনি। ভারতকে জেতালেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অবশ্য এ ফরম্যাটের বৈশি^ক মঞ্চে তার কখনো খেলা হয়নি। দায়িত্ব নেওয়ার পর রোহিতরা তার অধীনে ২০২৩ সালের জুনে খেলেছিল বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। কিন্তু হেরে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে। সেই অজিদের কাছে গত নভেম্বরে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালেও হারে ভারত। তবে অবশেষে দ্রাবিড় জিতলেন বিশ্বকাপ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতের হয়ে তার দায়িত্বও শেষ করলেন। সামনে যে বেকার হয়ে যাবেন সেটি নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ মজাও করেছেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × five =