জীবনের কলোরব থামিয়ে রাজীবের ঘুম

রোজ অ্যাডেনিয়াম

একজন লেখকের জীবনের শেষ লেখার প্রতি পাঠকের অন্যরকম আকর্ষণ থাকে। এই শেষ লেখার ভেতর আমরা খুঁজতে থাকি লেখক আগেই জানতেন কি না, তিনি শিগগিরই মারা যাচ্ছেন! অথবা জানার চেষ্টা করি, মৃত্যুর আগে ঠিক কী বলে যেতে চেয়েছেন তিনি! লেখার ভেতর থেকে যায় অনেক কিছু। অনেক গল্প। দুঃখ-কষ্ট, মান-অভিমান, আক্ষেপ। যে মানুষটির কথা বলছি তিনি সদ্যপ্রয়াত নন্দিত গীতিকার রাজীব আশরাফ। ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এই গীতিকার। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে এই গীতিকবির প্রতি শ্রদ্ধা।

কে ছিলেন রাজীব আশরাফ?

আশরাফুল আনোয়ার রাজীব কিংবা যাযাবর ছাই বা জিপসি অ্যাশ, চিকু, পামেলা, রাজীব আশরাফ কত নামে তাকে ডাকতো মানুষ! তবে গীতিকার ও নির্মাতা রাজীব আশরাফ নামেই বেশি পরিচিত তিনি। দেশের নন্দিত গায়ক অর্ণবের অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার ছিলেন রাজীব। তার গানের কথায় থাকতো অন্যরকম এক দ্যোতনা। রাজীবকে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন অর্ণব। রাজিবের লেখা বেশকিছু গানের সুর-সংগীত করেন তিনি। ‘হোক কলরব’, ‘নাম ছিল না’, ‘প্রকৃত জল’, ‘ঘুম’, ‘ধূসর মেঘ’, ‘রোদ বলেছে হবে’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘একটা মেয়ে’, ‘মন খারাপের একটা বিকেল’সহ বেশকিছু তুমুল জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন এই জুটি। শিল্পীরা তারকা খ্যাতি পেলেও গীতিকারদের বেলায় এমনটা ঘটে না। বরাবরই আড়ালে থেকে যান তারা। কঠিন এই বাস্তবতায় অর্ণবকে সবাই চিনলেও আড়ালেই থেকে গেছেন রাজীব। তার মৃত্যুর পরে অনেকে নতুন করে জেনেছেন এতসব জনপ্রিয় গানের গীতিকার ছিলেন তিনি।

নাটক-টেলিছবি-বিজ্ঞাপন ও সিনেমায় রাজীব

শুধু অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেননি রাজীব আশরাফ। জিঙ্গেল লিখেছেন। নাটক-টেলিছবি ও সিনেমার জন্যও গান লিখেছেন। এয়ারটেল প্রযোজিত প্রায় সব টেলিছবিতে গান লিখেছেন রাজীব আশরাফ। সেগুলো হলো: ‘জলকণা উড়ে যায়’ (ভালোবাসি তাই), ‘ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই’ (ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই), ‘এই আমার শহর’ (অ্যাট-এইটিন অলটাইম দৌড়ের ওপর), ‘যাযাবর পাখনা’ (মাংকি বিজনেস), ‘এই যাত্রার শেষ কোথায় অজানা’ (ইউ-টার্ন)। আরাফাত মহসিন পরিচালিত ‘জোনাক পোকা’ টেলিছবিতে ‘নিঝুম রাতের তারা’, আদনান আল রাজীবের ‘মিডেল ক্লাস সেন্টিমেন্ট’ নাটকে ‘প্রহর’, ওল্ড স্কুলের মোবাশ্বের চৌধুরীর সুর-সংগীতে তারিনের কণ্ঠে ‘কালো মখমল’ নাটকের গানও রাজীব আশরাফের লেখা। এর আগে হাবিবের সুর-সংগীতে চ্যানেল ওয়ানের থিম সং ‘সম্ভাবনার দুয়ার’সহ বাংলালিংক, মোজো, সেভেন আপ-সহ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল লিখেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের গানও লিখছেন রাজীব আশরাফ। রেদওয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ ছবিতে অর্ণব গেয়েছেন রাজীবের লেখা ‘বোকা চাঁদ’। তার লেখা গান রয়েছে ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রেও।

পরিচালনা ও অভিনয়ে রাজীব আশরাফ

গান লেখার পাশাপাশি রাজীব আশরাফ একজন নির্মাতা ছিলেন। বানিয়েছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, নাটক। এগুলো হলো ‘জলচর’, ‘বিস্ময়’ এবং ‘অ্যাকুয়ারিয়াম’। বিজ্ঞাপনও বানিয়েছিলেন বেশকিছু। বাংলাদেশ গেমসের জন্য বানিয়েছিলেন তথ্যচিত্র। শুধু লেখা বা নির্মাণই নয়, রাজীব আশরাফ অভিনয়ও করেছেন নাটক-টেলিছবিতে। এরমধ্যে আছে আশুতোষ সুজনের ‘টিনের তলোয়ার’, অমিতাভ রেজার রচনা ও আবিদ মল্লিক পরিচালিত ‘কিশোর ছবি আঁকতে পারে’, মনোয়ার কবিরের রচনা ও অনিমেষ আইচের ‘হলুদ’, নূরুল আলম আতিকের ‘মজিদের টেলিভিশন’, অমিতাভ রেজার পরিচালনায় ‘একটা ফোন করা যাবে প্লিজ’ প্রভৃতি।

কবিতার রাজীব আশরাফ

আপাদমস্তক একজন কবিতার মানুষ ছিলেন রাজীব আশরাফ। খুব ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য চর্চা করতেন। তার প্রতিটা গানই মূলত কবিতা। সুরকার সুর দিয়ে এই কবিতাগুলোকে গান করে তুলেছেন। ক্লাস সেভেনে থাকতেই একটি কবিতার বই প্রকাশ হয় রাজীব আশরাফের। এই তথ্য অনেকেরই অজানা। সেই বই সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে পরিণত বয়সে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন রাজীব। তার সেই কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ধরেছি রহস্যাবৃত মহাকাল’। তার লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটির কথাই ধরা যায়। এটি গান হিসেবে সমাদৃত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু নির্মল এক কবিতা হিসেবেও এটি অনন্য। এখনও কনসার্টে অর্ণবের সঙ্গে হাজার হাজার দর্শক গেয়ে ওঠে: হোক কলরব ফুলগুলো সব/লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান/অসম্ভবে কখন কবে/মেঘের সাথে মিল হলো ক্যান/হোক অযথা এসব কথা/তাল না হয়ে তিল হলো ক্যান/কুয়োর তলে ভীষণ জলে/খাল না হয়ে ঝিল হলো ক্যান/ধুত্তরি ছাই মাছগুলো তাই/ফুল না হয়ে চিল হলো ক্যান/হোক কলরব ফুলগুলো সব/লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান।

রাজিবের পোস্ট করা শেষ কবিতা

রাজীব আশরাফ ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট করেছিলেন এই কবিতাটি। তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগের লেখা এই কবিতার প্রতিটা লাইন যেন কথা বলে। তার জীবনের মান অভিমান, লড়াইয়ের গল্প বোনা প্রতিটা চরণে। কবিটির বক্তব্য অন্য এক জগতে নিয়ে যায় আমাদের। তুলে ধরা হলো কবিতাটি: ‘এইসব ঘর এই সব বাড়ি/ ছোট হয়ে যায় কতো তাড়াতাড়ি/ ছোট হতে হতে পিঁপড়ার বাসা/ তার মাঝে আমাদের ভালোবাসা/ থাকা না থাকার মতো করে থাকে/ কখনো হৃদয়ে কখনো শরীরের বাঁকে/ শরীরের বাঁকে আজ দিতে গিয়ে সাড়া/ শুনলাম বাড়িওয়ালা বাড়িয়েছে ভাড়া/ প্রেম উবে যায় আমি ডুব দেই মনে/ এ জীবন ধরে রাখা কার প্রয়োজনে/ নিজের না অন্যের না এ দেশের/ জীবন দিয়েও কিছু মিলবে কি শেষে/ না মিলুক এখন আমি প্রেমিকের বেশে/ বৌকে জড়িয়ে ধরি চোখ টিপে হেসে।

রাজীবকে নিয়ে বন্ধু সিনা হাসান

রাজীব আশরাফের দীর্ঘদিনের সহচর ‘বাংলা ফাইভ’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সিনা হাসান। রাজিবের মৃত্যুর পর একটি গণমাধ্যমে বন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন তিনি। সেই লেখার কয়েকটি লাইন তুলে দেওয়া হলো: ‘রাজীব বলতো, কীভাবে সে শামসুন্নাহার হলে আন্দোলন করেছে, সে ছিল দপ্তর সম্পাদক, মিরপুর ছাত্র ইউনিয়নের। তার নেতা আসাদুজ্জামান মাসুম। রাজীবের মৃত্যুর পর মাসুম ভাই ঠিক ওকে কবর দেওয়ার আগে উপস্থিত হন। আর আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মাসুম ভাই ওর মুখটা দেখে ডান হাত ওপরে তুললেন। আমার কানে স্পষ্ট বেজে উঠল রাজীবের কণ্ঠ, ‘আমার লিডার ছিল মাসুম ভাই।’ আরও দুজনকে মানতো বলে প্রায়ই বলতো তাঁদের নাম। আরাফাত মহসীন নিধির বাবা-মা যথাক্রমে সামসুজ্জামান আকন্দ সাজন ও মাহমুদা বেগম আপন। রাজীবের কাছে কোনো কিছু চাইতে গিয়ে খালি হাতে কেউ ফিরে এসেছে, এমন হয়নি। হয় তাকে নাগালেই পায়নি, নইলে যা চেয়েছে, তা পেয়েই ফিরে এসেছে। রাজীবের শেষকৃত্যে আসা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এ জীবনে যা চিনেছি, যাঁদের চিনেছি, সবকিছুর মাধ্যম ওই লোকটা, ওই যে শুয়ে আছে। কত ফ্রেশ, ঠিক যেভাবে ঘুমাত, একটু থুতনিটা উঁচু করে, ওইভাবেই। ঘুমাচ্ছে। এই যে এত এত গল্প বুকে নিয়ে ঘুরি, ১০ পার্সেন্টও তো বলতে পারি না। যেটুকু পারি, তার জন্য অবদান একজনের, রাজীব আশরাফ। আমি ওর বেশ অনেকটা সময়ের চ্যালা থাকলেও তার ‘জলচর’ আর ‘একুরিয়াম’ সিনেমা দুটো আমার আগে বানানো। মুগ্ধ হয়েছিলাম ও দুটো দেখে।’

বোকা চাঁদের দেশে রাজিবের ঘুম

দীর্ঘদিন ধরে বক্ষব্যাধি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন রাজীব আশরাফ। ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর খবরটি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন তার বড় বোন আয়েশা বেগম কনক। কনক জানান, ‘রাজীব আশরাফ ছোটবেলা থেকেই অ্যাজমাটিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তাই সব সময় চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতেন। ৩১ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরের পর তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এরপর নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক তার চেম্বারে দেখে পরামর্শ দেন হাসপাতালে ভর্তির। এরপর তাকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করা হয়।’

কনক আরও বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা তাকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানে ভর্তির মতো ব্যবস্থা না থাকায় ফিরে আসতে হয়। অ্যাম্বুলেন্সে করে আরেকটি হাসপাতালে যাই। সেখানেও ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। এরপর অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে আমরা বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। রাত ১১টায় ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শুক্রবার সকাল ১১টায় তো আমরা ভাইটা মারাই গেল। সবাই আমার ভাইটার জন্য দোয়া করবেন।’

শুক্রবার মিরপুর ১০ নম্বর কবরস্থানে বাদ আসর তাকে সমাহিত করা হয়। মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? আমরাতো আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রিয়জনদের খুঁজি। জোছনা ছড়াচ্ছে বোকা চাঁদ। দূরে অনেকগুলো তারা। ওই তারাগুলো একটি হয়তো রাজীব। আমরা আর কাছে পাবো না তাকে। কালো মখমল জীবনের কলোরব থামিয়ে বোকা চাঁদের দেশে রাজিবের ঘুম হয়তো ভালোই হচ্ছে। ওপারে ভালো থাকুক রাজীব আশরাফ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × 4 =