জীবনের প্রথম সুপার হিরো বাবা

মাসুম আওয়াল
‘হ্যালো হ্যালো ভাই ব্রাদার হ্যালো প্রিয় সিস্টার, বাবাই নায়ক বাবাই সেরা বাবাই সুপারস্টার, বাবার কাছে জিততে শেখা এই জীবনের যুদ্ধ, বাবার কাছেই হয় শেখা রোজ কী ভুল কী যে শুদ্ধ।/ বিপদ আপদ রোদ বৃষ্টি ঝড় ঝঞ্জার ভয়, হাঁটলে বাবার আঙুল ধরে সহজে দূর হয়। বাবা বিশাল সন্তানেরা সবাই বাবার ফ্যান, এই জীবনের সুপার হিরো বাবাই সুপারম্যান।

পৃথিবীর অধিকাংশ সন্তানের কাছে তার বাবা হয়তো এমনই। বাবার বিশালতা বোঝাতে কখনো তাকে তুলনা করা হয় আকাশের সঙ্গে, কখনো তুলনা করা হয় বটবৃক্ষের সঙ্গে। আসলে এসব তুলনা খাটে আক্ষরিক অর্থে। বাবা তার চেয়েও অনেক বড়।

সব মিলিয়ে জীবনের প্রথম সুপার হিরো এই বাবাই। রাস্তা পার হতে শেখা কিংবা ক্রিকেট ব্যাট চালানো, নতুন নতুন পরিবেশে ঘুরতে যাওয়া, প্রকৃতিকে চেনা সবকিছুর হাতেখড়ি বাবার কাছেই হয়। শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর এমনকি যৌবনেও, যখন সন্তান কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়, সে আশ্রয় খুঁজে পায় বাবা ডাকের মাঝে। তাই বাবাদের ভালোবেসে বছরের একটি দিনকে বাবা দিবস হিসেবে পালন করা ভীষণ যুক্তিসঙ্গত। বিশ্বব্যাপী এই দিনটিকে ঘিরে নানা আয়োজন করা হয়। কবে বাবা দিবস, কীভাবেই বা এলো দিনটি। বাবা দিবসের কী প্রয়োজন? এসব নানা বিষয় নিয়ে আজকের আয়োজন।

বাবাদের রবিবার
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় একটি নাটকের নাম ‘আজ রবিবার’। নাটকটি অনেকেই দেখেছেন হয়তো। হাস্যরসে ভরা নাটকটি মন জয় করে আছে কোটি কোটি দর্শকের মনে। বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার হলেও পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে আছে যেখানে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি। সব মিলিয়ে রবিবারের দিনটি বিশেষ হিসেবেই ধরা দেয়। মজার ব্যপার হলো প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ববাসী বাবা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাবার সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোসহ নানা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয় দিনটি। সেই হিসেবে ২০২৩ সালের ১৮ জুন বাবা দিবস। এই রবিবার একান্তই বাবাদের রবিবার। যদিও বাবাকে ভালোবাসা জানানোর জন্য বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন পড়ে না। তবু বছরের একটা দিন যদি বাবাদের জন্যই বরাদ্ধ দেওয়া হয় তাতে ক্ষতি নেই, বরং ভালোই।

কিভাবে এলো বাবা দিবস?
কেমন করে বা কবে থেকে বাবা দিবস পালনের সূচনা, তা আমাদের অনেকেরই অজানা। বিশ্বের কয়েকটি দেশ ভিন্ন মাসের কয়েকটি ভিন্ন তারিখে বাবা দিবস পালন করলেও, একটি বিশাল অংশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চিলি, কলাম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, গ্রিস, হংকং, ভারত, আয়ারল্যান্ড, জ্যামাইকা, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়েসহ আরও কিছু দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালিত হয়।

গ্রেস গোল্ডেন ক্লেটন প্রথম ব্যক্তি যিনি বাবা দিবসের প্রচলন শুরু করেন। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টবাসী গ্রেস প্রথম বাবা দিবস পালনের জন্য আবেদন করেছিলেন। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর। ভার্জিনিয়ায় ভয়াবহ খনি বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৩৬০ জন পুরুষ। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন সন্তানের বাবা। ফলে প্রায় এক হাজার শিশু পিতৃহারা হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি গ্রেস গোল্ডেন ক্লেটনকে পীড়া দেয়। তিনি স্থানীয় মেথোডিস্ট গির্জার যাজককে শহীদ বাবাদের সম্মানে ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই রবিবার বাবা দিবস হিসেবে উৎসর্গ করার অনুরোধ করেন। ৫ জুলাইকে বাবা দিবস করার দাবি জানানোর কারণ, এটি ছিল গ্রেসের মৃত বাবার জন্মদিন। এরপর ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপক্ষ একটি ঐতিহাসিক ফলক স্থাপনের মাধ্যমে ফেয়ারমন্টকে বাবা দিবসের জন্মস্থান হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে প্রতি বাবা দিবসে গির্জায় বাবা দিবসের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হতো।

বাবা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে রয়েছে আরেক নারীর অগ্রণী ভূমিকা। ১৯০৯ সালের আগে ওয়াশিংটনে বাবা দিবস বলে কোনো বিশেষ দিন ছিল না। সে সময় স্থানীয় গির্জায় সোনোরা স্মার্ট নামে ওয়াশিংটনবাসী এক নারী মা দিবস পালনের কথা শোনেন। মা দিবস পালনের রীতি রয়েছে কিন্তু বাবা দিবস পালনের রীতি নেই জেনে তিনি ভীষণ অবাক হন। তাই বাবা দিবস পালনের আবেদন জানিয়ে তিনি স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সে বছরের ৫ জুন নিজ বাবার জন্মদিনের দিন বাবা দিবস ধার্য করার অনুমতি চান। তবে হাতে কম সময় থাকায় ওই বছরের ১৯ জুন প্রথম এ অঙ্গরাজ্যে বাবা দিবস পালন করা হয়।

সোনোরা তার বাবা উইলিয়াম স্মার্টকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাতেই এ দিনের সূচনা করেন। গৃহযুদ্ধ চলকালীন উইলিয়াম স্মার্ট ছিলেন একজন সৈনিক। ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তার স্ত্রী মারা যান। এরপর শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও ছয় সন্তানকে একাই লালন-পালন করেন উইলিয়াম। পরে, ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন করার একটি বিল আনা হয়। ১৯১৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিলটি অনুমোদন করেন ও তার সাত বছর পর ১৯২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০তম প্রেসিডেন্ট কেলভিন ক্যুলিজ বাবা দিবসকে জাতীয় দিবসের মর্যাদা দেন। সবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন রাষ্ট্রীয়ভাবে জুনের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস বলে ঘোষণা দেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের সব বাবাদের সম্মানে পালিত হয়ে আসছে বাবা দিবস।

বাবা দিবসের আয়োজন
দেখা যায়, আমাদের দেশে মা দিবস যতটা ঘটা করে পালন করা হয়, বাবা দিবসে তেমনটা হয় কম। বাবাকে অনেক ভালোবাসেন কেউ, কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলা হয় না ‘বাবা তোমাকে ভালোবাসি’। বাবা দিবসে ছোট্ট এই কথাটি বলেই বাবাকে চমকে দিতে পারেন। বাবা দিবসে বাবাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে দিতে পারেন। তা হতে পারে একটা চিঠি কিংবা হাতঘড়ি। অথবা চলে যেতে পারেন কোনো এক রেস্টুরেন্টে, বাবার সঙ্গে বসে খেতে পারেন তার পছন্দের খাবার। যাদের বাবা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে তারা বাবার স্মরণে নানা আয়োজন করতে পারেন। বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন কিছুক্ষণ। বাবা দিবসে টিভি চ্যানেলগুলো নানা আয়োজন করে থাকে।

বাবাদের নিয়ে গান
বাবাদের নিয়ে গানের কথা বলতে গেলে শুরুতেই কানের কাছে বেজে ওঠে ‘আয় খুকু আয়’ গানটি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ে গাওয়া সোনালি দিনের সেই গান আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। নগর বাউলখ্যাত জেমসের বাবা গানটিও আমাদের নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে। ‘যেদিন আমি থাকবো না, কি করবি রে বোকা, এ যে রক্তের সাথে রক্তের টান, স্বার্থের অনেক উর্ধ্বে’ এই কথা ও সুরের মধ্যে অন্যরকম জাদু লুকানো। বাবাকে নিয়ে সর্বকালের সেরা এমনই পাঁচটি গানের কথা বলি। ‘বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান কোরো না’ গানটি শুনেছেন নিশ্চয়ই। এ গানটি গেয়েছেন শামীমা ইয়াসমিন দিবা। নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাকে চেনে না! ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’তে তার গাওয়া গানটি ব্যবহৃত হয়। ছবিটির পরিচালক আমজাদ হোসেনই এর কথা লিখেছেন, সুর করেছেন আলাউদ্দিন আলী।

‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’ প্রয়াত সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কালজয়ী সৃষ্টি এটি। কথা, সুর, সংগীত সবই তার। ১৯৮৪ সালে ‘নয়নের আলো’ ছবির এই গান গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। এত বছর পরেও গানটি শ্রোতাদের মুখে মুখে। পর্দায় এতে ঠোঁট মিলিয়েছেন জাফর ইকবাল। তিনিও বেঁচে নেই। ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে’ প্রয়াত নায়ক সালমান শাহের প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ (১৯৯৩) সিনেমার এই গানটি সবশ্রেণির শ্রোতার জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। এর মাধ্যমে প্লেব্যাকে অভিষেক হয় খান আতাউর রহমানের ছেলে আগুনের। এর কথা লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির, সংগীতায়োজনে আলম খান। ‘বাবা কতদিন দেখি না তোমায়’ নগরবাউল জেমসের ‘মা’ গানের মতোই ‘বাবা’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয়। বৈষয়িক হিসাব-নিকাশ ও স্বার্থের টানাপড়েনের ঊর্ধ্বে বাবাকে ভেবে সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি সাজানো। এর গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। ‘হারজিৎ’ অ্যালবামে প্রকাশিত হয় এটি।

‘আয় খুকু আয়’ ভারতীয় বাংলা গান হলেও বাংলাদেশে গানটি জনপ্রিয়তা পায় কাজী হায়াতের ‘দ্য ফাদার’ (১৯৭৯) সিনেমার সুবাদে। এর কথা ও সুর আজও শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়। পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথা ও ভি বালোসারার সুরে এটি গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার।

বাবাকে নিয়ে উক্তি
বাবাকে নিয়ে স্বল্প পরিসরে কতটুকুইবা বলা যায়। মনিষীদের কিছু বাণী পড়া যেতে পারে। ‘একজন বাবা তার সন্তানকে ততটাই ভালো বানাতে চান যতটা তিনি হতে চেয়েছিলেন। -ফ্রাংক এ. ক্লার্ক।’ ‘বাবা হলেন একটি বাড়ির ছাদ, যে নিজে পুড়ে সন্তানদের ছায়া দেয়, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না।’ -রেদোয়ান মাসুদ। ‘বাবা ছেলের ভালোবাসার থেকেই কিছুই বড় হতে পারে না।’ -ড্যান ব্রাউন। ‘বাবার ঋণ কখনও শোধ করতে যেও না, কারণ সাগরের জল সেচে কখনও শেষ করা যায় না। তাই সব সময় একটা কাজ করে যেও; সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবা তোমাকে যেভাবে আগলে রেখেছে তুমি বড় হলে তাঁকে সেভাবেই আগলে রেখো।’ -রেদোয়ান মাসুদ, ‘একজন সফল বাবা তার চেয়েও সফল একজন সন্তানকে তৈরি করেন।’ -পিকচার কোটস।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five − 3 =