জীবন্ত কিংবদন্তি সৈয়দ আব্দুল হাদী

মৌ সন্ধ্যা

‘যেও না সাথী, চলেছো একেলা কোথায়’, ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা একদিন খইয়া যাবে’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’, ‘চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে কাঁদিস কেন মন’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো আর কতদিন বলো সইবো’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘এমনও তো প্রেম হয়’, ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’ ‘চোখ বুঝিলে দুনিয়া আন্ধার’সহ অনেক জনপ্রিয় ও কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। গান গেয়ে পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা।

দেশের সংগীতাঙ্গনকে যারা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। সুদীর্ঘ জীবন জুড়ে কত রঙের গল্প আছে তার। এমন একজন মানুষের জীবন সম্পর্কে জানলেও সামনে পথ চলার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। ১ জুলাই তার ৮৩তম জন্মদিন। এই দিনটি আসলেই ভক্ত-শুভাকাক্সক্ষী ভালোবাসার মানুষদের কাছে শুভেচ্ছায় ভাসতে থাকেন তিনি। গুণী এই মানুষটি সম্পর্কে এক ঝলক জেনে নেওয়া যেতে পারে।

বাবার শখের গ্রামোফোন ও সংগীত প্রেম
বাবার শখের গ্রামোফোনে রেকর্ডের গান শুনে কৈশোরে সংগীতের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। তখন থেকেই হাতে-কলমে গান শিখেছেন। ১৯৪০ সালের ১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার শাহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই শিল্পী। বেড়ে উঠেছেন আগরতলা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কলকাতায়। তার বাবা সৈয়দ আবদুল হাই ছিলেন ইপিসিএস (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) অফিসার। হাদীর কলেজ জীবন কেটেছে রংপুর আর ঢাকায়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন বাংলা সাহিত্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

সংগীত ভুবনে পথচলা শুরু
ষাটের দশক থেকে শুরু হয়েছিল সৈয়দ আব্দুল হাদীর সংগীত ভুবনে পথচলা। সেই শুরু এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ক্যাসেট, সিডি প্রতিটি মাধ্যমে ছিল তার বিচরণ। এক জীবনে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। তার বিনিময়ে পেয়েছেন শ্রোতাদের ভালোবাসা ও অনেক পুরস্কার। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়ার সময় সুবল দাস, পি.সি গোমেজ, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ প্রমুখ তাকে গান শেখার ক্ষেত্রে সহায়তা ও উৎসাহ যোগান। সৈয়দ আব্দুল হাদী দেশাত্ববোধক গানের জন্য বিখ্যাত। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গান গাইছেন। আব্দুল হাদীর বেতারে গাওয়া প্রথম জনপ্রিয় গান ‘কিছু বলো, এই নির্জন প্রহরের কণাগুলো হৃদয়মাধুরী দিয়ে ভরে তোলো’।

হাদীর পেশাগত জীবন
সংগীতই ছিলো তার নেশা ও পেশা। তবে সংগীত ছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে আছে তার সংগীত। মানুষ তার অন্য পেশার কথা মনে রাখুক কিংবা না রাখুক; গানের জন্য তাকে ঠিক মনে রাখবে।

প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি
সৈয়দ আব্দুল হাদী আমাদের সংগীতাঙ্গনের বিস্তৃত আঙিনায় হয়ে আছেন বটবৃক্ষের মতো। তার ছায়ায় সুশীতল হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা। সংগীতে অবদানের জন্য শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। চলচ্চিত্রে গান গেয়ে সেরা গায়ক ক্যাটাগরিতে সৈয়দ আব্দুল হাদী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচ বার। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক। এছাড়া বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান থেকে পেয়েছেন আরও অনেক সম্মাননা। ২০২০ সালে বরেণ্য সংগীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আব্দুল হাদী পেয়েছেন ‘শুভজন পদক’। দেশের শিল্প-সংস্কৃতি তথা সংগীতাঙ্গনে অসামান্য অবদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে সৈয়দ আব্দুল হাদীকে এ পদক প্রদানের পাশাপাশি ‘শুভজন’ উপাধিতেও ভূষিত করা হয়। অপ্রাপ্তি বলতে কিছু নেই। তবু একটি ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেছিলেন এই শিল্পী। এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়: পছন্দের এমন কোনো শিল্পী আছে কী, যার সঙ্গে গান করার ইচ্ছা রয়েছে আপনার? উত্তরে সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেছিলেন, ‘আমার একটি ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা পূরণ হওয়া এখন আর সম্ভব না। কারণ তিনি জীবনের ওপারে চলে গেছেন। তিনি হলেন সলিল চৌধুরী। তার সুরে আমার একটি গান করার খুব ইচ্ছা ছিল।’

চলচ্চিত্রের গানে, চলচ্চিত্রের টানে
১৯৬০ সালে ছাত্রজীবন থেকেই চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু। ১৯৬৪ সালে তিনি একক কণ্ঠে প্রথম বাংলা সিনেমায় গান করেন। নাম ছিল ‘ডাকবাবু’। মো. মনিরুজ্জামানের রচনায় সংগীত পরিচালক আলী হোসেনের সুরে একটি গানের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। সালাউদ্দিন জাকি পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রের গানে সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন লাকী আখন্দ। এই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান ‘সখি চলনা, সখি চলনা জলসা ঘরে এবার যাই’- গেয়েছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। এছাড়া আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, আলমগীর, ফারুককসহ মোটামুটি বাংলাদেশের সব নায়কের লিপে ব্যবহার হয়েছে তার কণ্ঠের গান। হুমায়ুন ফরীদির কণ্ঠেও তার গান আছে। তেল গেলে ফুরাইয়া, বাতি যায় নিভিয়া গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল।

সব মিলিয়ে অনেক সিনেমা এবং অ্যালবামে বহু কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। তার মধ্যে ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’, ‘এই পৃথিবীর পান্থশালায়’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিড়ে’, ‘এমনও তো প্রেম হয়’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো’, ‘যেও না সাথী’, ‘আমি তোমারই প্রেম ভিখারী’, ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সুর্যাস্তে তুমি’, ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া’, ‘আউল বাউল লালনের দেশে’, ‘মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে’, ছাড়াও রয়েছে অনেক শ্রোতাপ্রিয় গান।

প্রামাণ্য চিত্রে দ্য লিজেন্ড সৈয়দ আব্দুল হাদী
কিংবদন্তি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি প্রামাণ্যচিত্র। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। ‘দ্য লিজেন্ড সৈয়দ আব্দুল হাদী’ শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রটি এখন দেখা যায় ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম বাংলাফ্লিক্স-এ। গুণী কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন নিয়ে ৩৫ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন সাদাত হোসাইন। বাংলা ঢোলের প্রযোজনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটিতে জনপ্রিয় এই শিল্পীর অনেক অজানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।

জীবনের সেরা গানের সংকলন
২০১৬ সালের ১০ আগস্ট প্রকাশিত হয় হাদীর ৪৫টি গানের একটি চমৎকার সংকলন। চারটি সিডিতে প্রকাশ করা হয় এগুলো। ওই চারটি সিডিতে প্রকাশিত হাদীর গানগুলো শোনা যাচ্ছে ৪৬৪৬ নাম্বারে ডায়াল করে। পাশাপাশি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে অ্যালবাম। দেশাত্মবোধক, চলচ্চিত্র ও আধুনিক; এই তিন ধরনের গান দিয়ে সাজানো হয়েছে এই চারটি অ্যালবাম। তার মধ্যে দেশের গান ‘বাংলাদেশের ছবি এঁকে দিও’ শিরোনামের গানটি শ্রোতাদের মনে বেশ দাগ কাটে।

হাদীর কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত
বাঙালি জাতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিবিড়। সংগীতজীবনের শুরু থেকেই রবীন্দ্রসংগীতের সম্পর্ক তার। ২০১১ সালে সৈয়দ আবদুল হাদী রবীন্দ্রনাথের নয়টি গান নিয়ে ‘যখন ভাঙলো মিলন মেলা’ শিরোনামে একক অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালে আবারও কবিগুরুর গান কণ্ঠে তুলেন তিনি। ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’ শিরোনামের এই গানটির সংগীতায়োজন করেন রেজাউল করিম লিমন আর এর ভিডিওচিত্র তৈরি করেন সাদাত হোসাইন। গাওয়ার পাশাপাশি ভিডিওটিতে অংশও নিয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী। সঙ্গে আছে ঋদ্ধিসহ কয়েকজন শিশুশিল্পী।

হাদীর প্রিয় শিল্পী
এক সময় খুব বেশি ইংরেজি গান শুনতেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। উপমহাদেশের মোহাম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মেহেদি হাসান, গোলাম আলি, আশা ভোঁসলে, লতা মুঙ্গেশকরের গান শুনতে পছন্দ করেন। দেশে আলাউদ্দিন খান, মোহাম্মদ আসাফুদ্দৌলা, আবু বকর খান, আব্দুল জব্বার, মাহমুদুন নবী, খন্দকার ফারুক আহমেদ, বশীর আহমেদ ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী তার পছন্দের শিল্পী।

তরুণদের উদ্দেশ্যে হাদীর পরামর্শ
এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেছিলেন, ‘একজন শিল্পী প্রতিনিয়তই শেখে। এক্ষেত্রে নিজের মেধাকে প্রয়োগ করতে হয়, কোনটা নিতে হবে আর কোনটা বাদ দিতে হবে; তা জানা দরকার। বড় পর্দায় জন্য গান করলে সেটা চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে হবে। যার কণ্ঠে গান চলচ্চিত্রে তার যে চরিত্র বা অবস্থান সেটাও শিল্পীকে বুঝতে হয়। যে দু’একজন শিখে এসেছে, তারা টিকে গেছে। অথবা টিকে যাওয়ার পর শিখেছে তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থেকেছে। কিন্তু, যারা হঠাৎ করে তারকা হয়ে গেছে, তাদের তারকা হওয়ার যে তৃপ্তি সেটা পূরণ হয়ে যাওয়ার ফলে তারা টেকেনি। যারা তাড়াতাড়ি এসেছে, তারা তাড়াতাড়ি চলে গেছে।’ এই গুণী শিল্পী আরও বলেন, ‘একজন শিল্পীর জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ভীষণ প্রয়োজন। শুধু শিল্পীদের ক্ষেত্রেই না, প্রত্যেক মানুষেরই নিয়মের সঙ্গে চলা উচিত। তবে এই পেশার সঙ্গে যারা আছেন তাদের সবসময় নিয়মকানুন মেনে চলা সম্ভব হয় না। কিন্তু, তারপরও যতোটুকু সম্ভব তা মেনে চলা প্রয়োজন।’

শেষকথা
সৈয়দ আব্দুল হাদীর বয়স এখন ৮৩ বছর। এখনো সংগীতকে ঘিরেই কাছে তার প্রিয় সময়। অবসরে গান শুনতে পছন্দ করেন। তার জন্য প্রার্থনা গানের সঙ্গেই ভালো থাকুন প্রিয় শিল্পী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

ten + twelve =