জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার

ময়ূরাক্ষী সেন

এশার বয়স ২৩। সে খুব অল্পতেই অস্থির হয়ে যায়। জীবনের কোনো পরিবর্তন বা দুর্ঘটনাকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে সে ভেঙে পড়ে। সব বিষয়ে তার ভাবনা নেতিবাচক। যখন সে কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে তার মনে হয় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ও বুক দড়ফড় করছে। মূলত এশার যা হচ্ছে তাকে বলা হয় অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ। শুধু এশা নয় এখন অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত এ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

উদ্বেগ কি?

উদ্বেগকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। মানুষ নানা রকম ঘটনায় দুশ্চিন্তা করবে, অস্থির হবে; এটি একটি খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন কেউ দুশ্চিন্তার জন্য অসুস্থ হয়ে যায় এবং জীবনের যাবতীয় বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে যার কোনো ভিত্তি নেই, তাকেই উদ্বেগ বলা হয়। উদ্বেগ রোগের লক্ষণ সাধারণত ১৮ বছরের পর দেখা দেয়। তবে এর আগেও কারো মধ্যে দেখা দিতে পারে। পুরুষের তুলনায় নারীরা এ রোগে আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, উদ্বেগে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পায় না। আপনি বা আপনার আশেপাশে কেউ উদ্বেগ রোগে আক্রান্ত কি না তা জানার জন্য লক্ষণগুলো জেনে রাখা জরুরি।

দমবন্ধ অনুভূতি

উদ্বেগ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এটি একটি কমন লক্ষণ। শুরুর দিকে অনেকে মনে করে তার হয়তো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এবং ফুসফুসের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর দেখা যায় ফুসফুস সংক্রান্ত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটা বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লাগে যে সমস্যাটা আসলে শারীরিক নয় মানসিক। চিকিৎসকের কাছে এসে অনেক রোগী অভিযোগ করে যে, তার মনে হয় তার বুকের উপর কেউ বসে আছে।

অস্থিরতা

উদ্বেগ রোগে আক্রান্ত রোগীদের এটি আরেকটি অন্যতম সমস্যা। তাদের সারাক্ষণ অস্থির লাগতে থাকে। কোনো কিছু করেই তারা শান্তি পায় না। মন শান্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের মাথায় নানারকম চিন্তা এলোমেলো ভাবে ঘুরতে থাকে। এই অস্থিরতার কারণে তারা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। তাদের মন তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই অস্থিরটার সময় তারা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না। অনেকের মধ্যে দাঁত দিয়ে নখ কাটার প্রবণতা দেখা দেয়।

ঘুমের সমস্যা

অধিকাংশ ইনসোমনিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষণ পাওয়া যায়। উদ্বেগ থাকার ফলে তাদের মস্তিষ্ক সারাক্ষণ সচল থাকে। তাই ঘুমানোর চেষ্টা করার সময়ও নানা ধরনের চিন্তা চলে আসে। ঘুমের মধ্যেও তারা ভাবতে থাকে। ঘুম আসলেও সে ঘুম শান্তিপূর্ণ হয় না, মাঝ রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগের মাত্রা রাতেই বেশি বেড়ে যায়, তখন ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। দিনের পর দিন পরিপূর্ণ ঘুমের অভাবে উদ্বেগের সমস্যা আরো বেড়ে যেতে থাকে।

ক্ষুধা কমা কিংবা বেড়ে যাওয়া

উদ্বেগের কারণে অনেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। আবার অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলে। উভয়ই শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

মনোযোগ কমে যাওয়া

তারা কোনো কিছুতে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এতে ব্যক্তিজীবনে তাদের নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তার আশেপাশের মানুষ তাকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন যে অহেতুক বিষয় নিয়ে চিন্তার কিছু নেই; তা-ও সে কিছুতেই তার চিন্তায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এতে তার কাজের ক্ষতি হতে থাকে। উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ছোট ছোট বিষয় ভুলে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। সাধারণ অনেক বিষয় তারা খেয়াল রাখতে পারে না। অনেক সময় এতে তাদের বড় ক্ষতি হয়ে যায়।

মৃত্যু ভয়

মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়। কিন্তু তাদের মধ্যে এ ভয়ের মাত্রা এতো বেশি থাকে যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তাদের সামান্য জ্বর হলেও আতঙ্কে ডাক্তারের কাছে ছুটতে থাকে। একের পর এক টেস্ট করতে থাকে। হাসপাতালের ডাক্তার যদি বলে আপনার কিছু হয়নি, তাহলে তাকে বিশ্বাস না করে আরেক চিকিৎসকের কাছে যায়। সর্বদা তার মনে হয় সে হয়তো কোনো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। কারো মৃত্যু সংবাদ শুনলেও তারা আতংকিত হয়ে যায় ও স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না।

উদ্বেগের ফলাফল

উদ্বেগের মাধ্যমে কোনো বিপদ বা সমস্যার সমাধান করা যায় না। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করলে অনেক ধরনের বিপদ কাটিয়ে ওঠা যায়। যারা সব সময় উদ্বেগে থাকে তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। কোনো কাজের আগেই তাদের মনে নেতিবাচক চিন্তা চলে আসে। ফলে তারা সমাজ ও বন্ধুবান্ধব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া শুরু করে। অতিরিক্ত উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপর তার আশেপাশের মানুষরাও কিছুটা বিরক্ত থাকে। এতে তারা হীনমন্যতায় ভুগে ও সামাজিকতা এড়িয়ে যেতে চায়। যাদের মধ্যে রোগ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে তারা একের পর এক টেস্ট ও বার বার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্মজীবন, পড়ালেখা, পারিবারিক এবং সামাজিক সব স্থানেই তাদের ঘিরে সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে।

উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণের উপায়

মেডিটেশন: মেডিটেশনের রয়েছে অনেক উপকারিতা। নিয়মিত মেডিটেশনের ফলে মন শান্ত হয় ও অস্থিরতা কমে। তাই উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন মেডিটেশন করা উচিত। মেডিটেশনের জন্য শান্ত ও শব্দহীন পরিবেশ বেছে নিতে হবে। প্রথম দিকে মেডিটেশনে মনোযোগ দিতে কিছুটা কষ্ট হবে। কিন্তু নিয়মিত করার ফলে এটি অনেকটাই আয়ত্তে চলে আসবে।

নিশ্বাসের ব্যায়াম: এটি আমাদের ব্রেইনকে শিথিল রাখতে সাহায্য করে। তাই অস্থিরতা অনুভব হলে নিশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। প্রথমে জোরে দম নিতে হবে, এরপর কিছু সময় আটকে রাখতে হবে। কয়েক সেকেন্ড পর ধীরে ধীরে নিশ্বাস ছাড়তে হবে। এমন করে ১০ বার করতে হবে। এটির ফলে বুক কিছুটা হালকা অনুভব হবে।

প্রযুক্তি থেকে দূরে: চেষ্টা করতে হবে দিনের কিছুটা সময় মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন সবধরনের প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকতে। প্রযুক্তি আমাদের উদ্বেগ প্রবণতা অনেক বেশি বাড়িয়ে তোলে। তাই সময় কাটাতে বই পড়া, নতুন কিছু রান্না করা বা ছাদে কিংবা বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা যেতে পারে। প্রযুক্তির সাথে সময় কাটানো কমাতে পারলে উদ্বেগের সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।

শারিরীক পরিশ্রম: প্রতিদিন কিছুটা সময় শারিরীক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় এমন কাজ করতে হবে। যেমন লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। কিংবা রিকশায় না উঠে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। এছাড়া নিয়ম করে ৪০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করা যেতে পারে। শারিরীক পরিশ্রমের ফলে আমাদের শরীরে ডোপামিন হরমোন রিলিজ হয় যা মন ভালো রাখতে সাহায্য করে।

সুস্থ জীবনধারা: উদ্বেগ কমাতে আমাদের প্রতিদিনের খাবার এবং জীবন যাত্রারও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। খাবারের তালিকায় পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে। ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পানি পান করতে হবে। চিনি ও প্রসেসড খাবার কমাতে হবে। ঘন ঘন চা কফি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। কারণ ক্যাফেইনযুক্ত খাবার উদ্বেগের প্রবণতাকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। রাত জাগার অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করে দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি করতে হবে।

ছুটি নিন: যান্ত্রিক ও একঘেয়ে জীবন অনেক সময় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। তাই মাঝে মধ্যে একঘেয়ে রুটিন থেকে কিছুটা বিরতি নিয়ে প্রিয় মানুষদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে হবে বা ভালো লাগে এমন কোনো কাজ করা যেতে পারে।

উদ্বেগের চিকিৎসা: অনেক সময় উদ্বেগ ঘরে বসে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখন মনোবিদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। চিকিৎসক অবস্থা বুঝে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকে। উদ্বেগে আক্রান্ত রোগীদের প্রথমে কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়। এতে রোগের বেশ উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে উদ্বেগ রোগ সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × 4 =