জেন-জি’র হাত ধরেই এগিয়ে যাবে প্রযুক্তি

আশফাক আহমেদ

প্রতিটি প্রজন্মই আগের প্রজন্ম থেকে এগিয়ে থাকে। আর কিছুতে না হলেও প্রযুক্তিতে অবশ্যই। একটি প্রজন্মের তারুণ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া বলতে ছিল রেডিও। এরপর টেলিভিশন, ভিসিআর, ডেক্সটপ কম্পিউটার, বোতাম টেপা মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ থেকে ধীরে ধীরে যতোই সময় গড়িয়েছে নতুন প্রজন্মের হাতে উঠেছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন। বিশ্বের নানা তথ্য চোখের সামনে তুলে ধরতে সহায়তা করেছে, ইন্টারনেট, গুগলের মতো নানা সার্চ ইঞ্জিন ও বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম। আর এখনতো চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই’র যুগ। সন্তানের প্রযুক্তিজ্ঞানের কাছে বহু বাবা-মা যেন শিশু।

সাম্প্রতিক সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরছে একটি শব্দ তা হলো জেন-জি। জেনারেশন জেডকে সংক্ষেপে এভাবেই ডাকা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ‘জেড’ কে ‘জি’ বলা হয়। আগে বলা হতো ‘এ টু জেড’। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বলা হয় ‘এ টু জি’। সময় পরিবর্তনের নায়ক হয়ে উঠেছে এই প্রজন্ম। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে শুরু; সরকার পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রাখার মতো বড় সাফল্য দেখিয়েছে এই প্রজন্ম। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত যাদের জন্ম, তারাই মূলত জেন-জি। তাদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। আগের যেকোনো প্রজন্মের তুলনায় সার্বিকভাবে প্রযুক্তিতে এগিয়ে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা। এর অন্যতম কারণ, জেন-জি এমন এক সময়ে বেড়ে উঠেছে যখন বিশ্বজুড়ে ঝড়ের গতিতে চলছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অন্য প্রজন্মগুলোর তুলনায় প্রযুক্তি বিষয়ে জেন-জি অনেক বেশি সাবলীল। সবচেয়ে প্রযুক্তিবান্ধব প্রজন্ম হিসেবে তারা খুব সহজেই বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে পারে এবং এই দক্ষতা খুব সহজেই কর্মক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যেতে পারে। যা দেশের প্রযুক্তি খাতকে আরো সমৃদ্ধ ও আর্থিকভাবে সফল করতে ভূমিকা রাখবে।

মিলেনিয়াল নামে পরিচিত জেন-জির আগের প্রজন্ম। তাদের মধ্যেও পূর্বসূরিদের কিছু প্রথাগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু মিলেনিয়াল আর জেন-জির মধ্যে বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। যোগাযোগ দক্ষতা থেকে শুরু করে নিজেকে প্রকাশের ভঙ্গিতেও জেন-জি অনন্য। এরইমধ্যে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সাথে তাদের অংশগ্রহণ আরো বাড়বে। কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান ও সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে জেন-জি প্রজন্ম সম্পর্কে জানাশোনা ও বোঝাপড়া বাড়ানো জরুরি। জেন-জি আগের প্রজন্মের চেয়ে বেশি বাস্তববাদী এবং অল্প বয়সে দ্রুত পরিপক্ব। এ প্রজন্মের মাঝে ক্যারিয়ার নির্ধারণে সতর্কতা, শিক্ষা বা ডিগ্রি অর্জনের হারও বেড়েছে। সবশেষে কোভিড মহামারিও এ প্রজন্মকে নতুন করে প্রভাবিত করেছে। প্রযুক্তি তাদের কাছে সুবিধা নয়, মৌলিক চাহিদা। মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড তাদের বিরামহীন বিনোদন ও তথ্যের প্রবাহে যুক্ত করে রাখে। এতে অনেক ক্ষেত্রে মনোযোগের ঘাটতি, ধৈর্যের স্বল্পতা ও অল্পতেই উত্তেজনার মতো বৈশিষ্ট্য তাদের চরিত্রে লক্ষ্য করা গেলেও, স্বতঃস্ফূর্ততা ও গতিই তাদের শক্তি। একক নেতৃত্ব মানতে নারাজ স্বকীয় অস্তিত্বে বিশ্বাসী এই প্রজন্ম।

প্রথাগত যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন ইমেইল বা টেলিফোনের চেয়ে জেন-জির পছন্দ ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপসহ ডিজিটাল যোগাযোগের অন্যান্য পদ্ধতি। এটাও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ। সø্যাক, মাইক্রোসফট টিমস ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে খুব সহজেই তারা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতে পারে। তা ছাড়া স্বভাবগত কারণেই তারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পছন্দ করে। এতে সুবিধা হলো গঠনমূলক মতামত দেওয়া যায়, সংলাপের জন্য উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করা যায় এবং নতুন কিছু শেখার মানসিকতা থাকার কারণে খুব সহজেই তারা যেকোনো কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে মানিয়ে যেতে পারে। বেশিরভাগ জেন জি-ই প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকার পাশাপাশি নিজেদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব এবং সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতন।

জেন-জির তরুণরা কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পছন্দ করে। এ কারণে প্রতিদিনের রুটিন নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। যেন সেটা তার ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত না করে। ফলে হাইব্রিড বা সুবিধামতো স্থানে বসে অফিসের কাজ করার দিকে ঝুঁকছে জেন-জি, যেখানে বাঁধা-ধরা সময়ে নয়, বরং তারা নিজেদের সুবিধামতো সময়ে কাজ করতে পারবে। জেন-জি’র বড় অংশ কঠোর নিয়মানুবর্তিতার উল্টোদিকে হাঁটে। তারা এমন পদ্ধতিতে কাজ করতে পছন্দ করে যেখানে তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা যায়। যেন তারা সেরাটা দিতে পারে। জেন-জির দলগতভাবে কাজ করার দক্ষতাও দারুণ। যার প্রমাণ এরইমধ্যে পেয়েছে দেশের মানুষ। নিজেদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ব্যাপারে তারা খুবই স্পষ্টবাদী। বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও মতামত প্রকাশে তারা দ্বিধাহীন। যুক্তিতর্কের বিষয়ে তারা অনেক বেশি উদার।

জেন জি-র সঙ্গে অন্যদের এই যে দূরত্ব, তা পূরণে কর্মক্ষেত্রেই সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, এমন কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে উদার হতে হবে। যেকোনো বয়সের মানুষের কাজকে মূল্যায়ন করা হবে, যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে হবে। এমন পরিবেশ তৈরিতে সব প্রজন্মেরই চেষ্টার প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে পুরোনোদের আগে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল জেন-জি পুরোনোদের কাছ থেকে শিক্ষা নেবে না, বরং পুরোনোরাও নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে শিখবে। জেন-জির বয়স কম বলে তাদের অবজ্ঞা করা যাবে না।

আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রতিষ্ঠানের জন্য জেন-জি অপরিহার্য। কেবল এজন্য নয় যে তারা বর্তমান সময়টাকে বুঝতে পারে। বরং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতেও জেন-জিদের প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রগুলো যত বিকশিত হবে, যত গতিশীল হয়ে উঠবে, প্রতিষ্ঠানকে তত বেশি পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। যদি ইতিহাস থেকে আমরা কিছু শিখে থাকি, তাহলে প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই উন্নয়নের জন্য জেন-জির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে আমাদের এখন মনোযোগী হতে হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিক, ব্লক চেইন, ইন্টারনেট অব থিংসের মতো প্রযুক্তির দিকে। ২০১৮ সালে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রপ্তানি আয় ছিল ১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালে এসে এই খাতের আয় এসে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত পাঁচ-ছয় বছরে এই সেক্টর থেকে আয় আশানুরূপ বাড়েনি। এর একটি

বড় কারণ হতে পারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের টেকনোলজিগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগী না হওয়া। তাই আমাদের এখন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে আর ট্রেনিং প্রোগ্রাম ডিজাইন করতে হবে এসব প্রযুক্তিকে সামনে রেখেই।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন টিম-বিল্ডিং অ্যাকটিভিটি বা দলগতভাবে করা যায় এমন কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে বয়স্ক ও তরুণরা একসঙ্গে মিলে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ করবেন। এর ফলে কেবল যে তাদের প্রজন্মের বাইরে গিয়ে দলগত কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে তা-ই নয়, বরং স্টেরিওটাইপ বা কারও সম্পর্কে কাঠামোবদ্ধ ধারণা ভেঙে দেবে।

আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, যে নতুন শক্তিশালী অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছি, সেখানে পোশাকশিল্পের পাশাপাশি আরো অনেক শিল্প নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি বিশেষত রপ্তানি খাত বলতে গেলে পুরাটাই পোশাক শিল্প নির্ভর। কোনো একটি বিশেষ খাতের ওপর একটি দেশের অর্থনীতি নির্ভর হয়ে থাকা যে কতটা ভয়ের ব্যাপার, এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ মুহূর্তে প্রয়োজন, অর্থনীতির আরো অনেক স্তম্ভ তৈরি করা। আর সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ হতে পারে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত। দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া সেক্টরটি হতে পারে অর্থনীতির জন্য গেম চেঞ্জার। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই মুহূর্তে দক্ষ মানবসম্পদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশ এবং ইন্ডাস্ট্রির ব্র্যান্ডিং। ইন্টারনেট ও ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ থাকায় এই শিল্পে যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, এমনটা যাতে আর না হয়। এই সেক্টরের আগামী ১৫-২০ বছরের রোডম্যাপ জেন-জি প্রজন্মের হাত ধরেই তৈরি হোক, সেই প্রত্যাশাই থাকলো।

লেখাটির পিডেএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 7 =