জ্বালানি সংকট মোকাবিলার কিছু জরুরি কৌশল

সালেক সুফী

বাংলাদেশের চলমান জ্বালানি বিদ্যুৎ সমস্যা এবং আসন্ন নিবিড় সেচ মৌসুম, রোজার মাস এবং গ্রীষ্মকালের বর্ধিত চাহিদা বিষয়ে অবহিত সবাই জানে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত। ২০২৪র মতো এবারও কিন্তু তীব্র খরা এবং উষ্ণ গ্রীষ্মকাল আসতে পারে প্রকৃতিতে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের মতে মার্চ থেকে আগস্ট সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ১৭৫০০-১৮০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২৭,৭৯০ মেগাওয়াট  গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশ সাধারণ বিবেচনায় গ্রীষ্মকালের বিদ্যুৎ চাহিদা মোকাবিলা করার কথা। কিন্তু সমস্যা হলো প্রয়োজনীয় মাত্রায় প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ মেটানো।

অনেকের ধারণা দেশের গ্যাস উৎপাদন সীমাবদ্ধতা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার এবং টাকার সীমাবদ্ধতার কারণে এবারের গ্রীষ্মকালে ১৬,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তীব্র গরমের সময় ২৫০০-৩০০০ মেগাওয়াট লোড শেডিং করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী জ্বালানির মিশ্রণ হলো গ্যাস এবং এলএনজি (১১,৯৯৭ মেগাওয়াট – ৪৩.১৭%) , ফার্নেস অয়েল (৫,৮৩৫ মেগাওয়াট -২১.৬০%), কয়লা (৫,৬৮৩ মেগাওয়াট-২০.৪৬%), বিদ্যুৎ আমদানি (২,৬৫৬ মেগাওয়াট-৯.৫৬%), নবায়নযোগ্য জ্বালানি (৭৬৩ মেগাওয়াট-২.৭৬%), ডিজেল (৬২৬ মেগাওয়াট-২.২৬%) এবং জলবিদ্যুৎ (২৩০ মেগাওয়াট-০.৮৬%)।

কিন্তু গ্যাস এবং এলএনজি সরবরাহ সঙ্কট হবে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ সর্বোচ্চ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে হলে দৈনিক ২৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ প্রয়োজন। দেশের  গ্যাসক্ষেত্র সমূহের উৎপাদন ক্ষমতা এখন ১,৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ১,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজি যোগ করে গ্যাস গ্রিডে সর্বোচ্চ গ্যাস প্রাপ্তি ৩,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

গ্যাস দিয়ে সার উৎপাদন হয়, শিল্প কারখানাগুলোতে কাঁচা মাল এবং জ্বালানি যোগান দেওয়া হয়, সিএনজি খাতে ব্যাবহৃত হয়, গৃহস্থালি এবং বাণিজ্যিক জ্বালানি চাহিদার একটি অংশ মেটায়। কোনোভাবেই ২০২৭ শেষ বা ২০২৮ র আগে দেশের গ্যাস উৎপাদন বা এলএনজি আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধির সুযোগ নেই।

তাই এবারের গ্রীষ্মে কোনোভাবেই পেট্রোবাংলার পক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১,১৫০-১,২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভম নয়। এই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে জ্বালানি দক্ষ গ্যাস বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো চালু রেখে সর্বোচ্চ ৬,৫০০-৭,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সেটি করতে হলেও বড়জোর একটি বা দুটি সার কারখানা চালু রেখে বাকিগুলো বন্ধ রাখতে হবে, সিএনজি এবং শিল্প এলাকায় গ্যাস রেশনিং করতে হবে। আবার এলএনজি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান থাকতে হবে।

এবার আসুন কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে। নিজেদের একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লা দিয়ে খনিমুখে সর্বোচ্চ ২৫০-৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভারতের আদানির ঝাড়খন্ড বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমদানি, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নোরিনকো বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী এবং বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি স‍াপেক্ষে এবং কারিগরি বিভ্রাট না হলে সর্বোচ্চ ৫,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারবে। গ্যাস এবং কয়লা মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৭,০০০+৫,০০০=১২,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সম্ভব।

এখন আসুন আমদানি নিয়ে। ১,১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের ভারত থেকে। জানিনা নেপাল থেকে বিদ্যুৎ এই সময়ে আমদানি করার হবে কিনা। উপরন্তু ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বকেয়া আছে। ধরে নিলাম ১,০০০ মেগাওয়াট আমদানি হবে। হলো ১৩,০০০ মেগাওয়াট।

এই সময়ে আরো কয়েকটি গ্রিড কানেক্টেড সৌর বিদ্যুৎ প্লান্ট গ্রিড সংযুতি সাপেক্ষে ১,০০০ মেগাওয়াট যোগ করলাম। ১,৪০০ মেগাওয়াট হলো। জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট ধরেও নিয়মিত ভিত্তিতে ১৪,০০০ মেগাওয়াটের বেশি সরবরাহের সুযোগ নাই। ব্যবহার করতেই হবে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক পিকিং প্লান্টগুলো। সেই ক্ষেত্রেও আছে আইপিপি গুলোর কাছে  বিপুল দেনা। অন্তত ৩,৫০০-৪,০০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ নিয়মিত উৎপাদন না করলে দৈনিক ঘাটতির পরিমাণ ৩,০০০-৩,৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে।

পেট্রোবাংলা ২০২৫ শেষ নাগাদ ৫০ কূপ এবং ২০২৮ শেষ নাগাদ  ১০০ কূপ খনন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অত্যন্ত উচ্চ আশাবাদীরা মনে করে ২০২৫ ,২০২৬ এবং ২০২৭ স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন বর্তমান পর্যায়ে ধরে রাখাও বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে। সামিট এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত তৃতীয় এলএনজি ভাসমান টার্মিনাল চুক্তি বাতিলের পর নতুন টেন্ডার করে টার্মিনাল স্থাপন করতে ২০২৮ পর্যন্ত সময় লাগবে। মাতারবাড়িতে ভূমি ভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল ২০৩০ র আগে চালুর সম্ভাবনা নাই। নতুন করে সাগরে টেন্ডার আহ্বান করে সুফল পেতেও ২০৩০ বা তারও বেশি সময় লাগবে।

সম্ভাবনা আছে রূপপুর পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসার।  কিন্তু গ্রিড সিংক্রোনাইজেশনের জন্য অন্তত ১,২০০ মেগাওয়াট স্পিনিং লোড থাকতে হবে বিদ্যুৎ গ্রিডে।  সেটি বর্তমান অবস্থায় একমাত্র সম্ভব গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বাড়তি গ্যাস প্রয়োজন ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ পেট্রোবাংলাকে ১,৪০০-১,৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিদ্যুতের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। এটি হওয়া উচিত গ্যাস বিদ্যুৎ সেক্টরের ২০২৫এর প্রধান চ্যালেঞ্জ।

চিরুনি অভিযান চালিয়ে গ্যাস চুরি সীমিত করে ১০০-১৫০ মিলিয়ন গ্যাস বাঁচানো সম্ভব বলে ধারণা করা যায়। গ্যাস ভিত্তিক ক্যাপটিভ পাওয়ার ব্যাবহারকারী অধিকাংশ শিল্পকে বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ আকষণীয় মূল্যে সরবরাহ করে সেখান থেকেও গ্যাস বাঁচানো সম্ভব।

পেট্রোবাংলা/বাপেক্স তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা গ্যাস ক্ষেত্র সমূহে প্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়নকূপ খনন করে দ্রুত ১০০ মিলিয়ন গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পারে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাথারিয়া, ঝুলদি, সীতাপাহাড় এলাকা সমূহে প্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান করলে ১.৫-২ বছরে নতুন গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা সমুজ্জল। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ২.৫-৩ বছরে ভোলার গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত করা সম্ভব।

এবারের গ্রীষ্মে অন্তত ২,০০০-২,৫০০ মেগাওয়াট লোড শেডিং করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ব্যবহারে কঠোর কৃচ্ছতা পরিকল্পনা করে নিবিড় মনিটরিং করতে হবে।

মোট কথা গ্যাস বিদ্যুৎ সেক্টরের ঘনায়মান সংকট মোকাবেলা করতে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে সঠিক পেশাদারদের সঠিক স্থানে নিয়োগ করে স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। জ্বালানি অবকাঠামো ভেঙে পড়লে অথর্নৈতিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − six =