টেকসই জ্বালানী নিরাপত্তার জন্য বার্ককে শক্তিশালী করা অপরিহার্য

বাংলাদেশের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়াদি মনিটরিং করার জন্য বার্ক এক্ট ২০০৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নামের স্বাধীন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়.মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্বালানী বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কর্মরত সরকারি এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের জন্য সমতা মূলক কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা ,একক যোগাযোগ কেন্দ্র হিসাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, সরকারের সকল এক্ট ,পলিসি রেগুলেশন যেন সকল প্রতিষ্ঠান মেনে চলে সেটি নিশ্চিত করা. এছাড়া সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের উপস্থিতিতে গণ শুনানী করে স্বচ্ছতার সঙ্গে বিদ্যুতের ট্যারিফ এবং জ্বালানীর মূল্য নির্ধারণের একক দায়িত্ব বার্কের উপর অর্পিত হয়. বলা বাহুল্য কর্তৃত্ববাদী সরকার শুরু থেকেই সংস্থাটিকে সহজ ভাবে মেনে নেয় নি. সরকারগুলোর দূরদৃষ্টির অভাবে প্রতিষ্ঠানটি এক্ট অনুযায়ী স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে নি. কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ সময়ে সরকার অনভিজ্ঞ আমলাদের নিয়োগ দিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ নতজানু প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে. এর মাঝেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বার্ক কিছু অর্জন করে. অনেকের মতে বার্ক এক্টের সংশ্লিষ্ট ধারা সমূহের আলোকে প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিক জনবল সংস্থান করে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিলে জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের বর্তমান লেজে গোবরে অবস্থার সৃষ্টি  হত না. যাহোক জুলাই আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সরকার পূর্ববর্তী সরকার আমলের শেষ দিকে সরকার কর্তৃক প্রণীত বার্ক এক্ট সংশোধনী বাতিল করে জ্বালানি বিদ্যুৎ মূল্য নির্ধারণের একক দায়িত্ব সংস্থাটিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে একজন দক্ষ ,অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আমলাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নিজেদের কাজে অভিজ্ঞ ব্যাক্তি বর্গকে সদস্য হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বার্ক।

বার্ক সৃষ্টির পটভূমি

২০০০ থেকেই বাংলাদেশে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে ব্যাপক ভাবে সম্প্রসারণ শুরু হয়। সুলভ গ্যাস বিদ্যুৎ প্রাপ্তি এবং সুলভ শ্রমের সুবিধা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ,দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে অনেক শিল্প বাংলাদেশে আসতে শুরু করে. জামেতীক হরে বাড়তে থাকে জ্বালানী বিদ্যুৎ চাহিদা /

বাংলাদেশে তখন সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশি বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। দাতা এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে আসছিলো। এমনকি কয়েকটি দাতা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের কোভেন্যান্ট হিসাবে বিষয়টি জুড়ে দিয়েছিলো। ওই সময় সবেমাত্র জ্বালানি সরবরাহ সংকট মাথা চারা দিয়ে উঠছে। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানীর মহাব্যবস্থাপক ( পরিকল্পনা হিসাবে আমি তখন কর্মরত। দেশে কর্মরত জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় দেশী বিদেশী কোম্পানি ,উন্নয়ন সহযোগী বিশ্ব ব্যাঙ্ক , এডিবি , ইউএসএইড ,জাইকা প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণ করি. সরকারের  শীর্ষ পর্যায়ের আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের সুযোগ হয়. নিজের আনুসন্ধিসু অভিলাষ থেকে বিভিন্ন দেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের কার্যক্রম নিয়ে বিশ্লেষণ করি. উন্নয়ন সহযোগী বিশ্ব ব্যাঙ্ক ,এডিবির আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ইউএসএইডের আমন্ত্রণে নেপাল ,শ্রীলংকা এবং ভারতে সার্ক এনার্জি গ্রিড সৃষ্টির নানা আলোচনায় অংশ নিয়েছি। যেকোন অন্যানো দেশের আদলে বাংলাদেশের জন্য এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয় তখন আমাকেও সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়. মনে আছে ইউএসএইডের আমন্ত্রণে সরকারের চার সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় সফর করার সুযোগ হয়েছিলো। পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ সাজেদুল করিম ছিলেন দলনেতা। ওপর দুই সদস্য ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শহিদুল হক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টৰ সালেহ আহমেদ। সফরকালে আমরা ফেডারেল এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ,বিশ্বব্যাংক ,আইএফসি ,ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স , কানাডিয়ান রেগুলেটর এনইবি ,কানাডিয়ান এনার্জি রিসার্চ কাউন্সিল এবং শীর্ষ স্থানীয় জ্বালানি বিদ্যুৎ কোম্পানীসমূহের কিছু স্থাপনা পরিদর্শন করি. এই সকল সংস্থা সমূহের কাজ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করি. আমাদের সুযোগ হয় পরবর্তীতে বার্ক একটু প্রণয়ন কালে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর। যাহোক পি এ কনসালটেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান বার্ক এক্টের খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করে. কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অধিকাংশ আলোচনায় অংশ গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। মনে আছে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে একবার এবং যমুনা নদীর পাড়ে একবার তৎকালীন জাতীয় সংসদের সর্বদলীয় সাংসদদের একটি দলের সামনেও বার্ক এক্টের চুম্বক অংশ ব্যাখ্যা করছিলাম। যাহোক মুক্ষ ভূমিকা ছিল শহীদুল হকের যিনি আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে চাকুরী করার পর এখন অবসরে আছেন। ২০০৩ সালে অনেক সংশোধন এবং বিয়োজনের পর এক্ট পাশ হয়. অনেক বাধা বিপত্তি এবং চ্যালেঞ্জের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বার্ক এখন অনেকটাই পরিণত।

বার্ক এক্টের মূল ধারাসমূহ

প্রথমেই বলে রাখি বার্ক কিন্তু এক্ট অনুযায়ী একটি স্বায়ত্বশাসিত স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। এক্টের ধারা অনুযায়ী জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্টান দেশে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বার্কের কাছে ( লাইসেন্স নিয়ে)  দায়বদ্ধ ,প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে বিদ্যমান সকল এক্ট ,পলিসি ,রেগুলেশন সঠিক ভাবে মেনে চলছে কিনা সেটি মনিটরিং করার অধিকার একক ভাবে বার্কের উপর অর্পিত। এছাড়া বার্ক নিদৃস্ট বিরতিতে বিদ্যুতের ট্যারিফ এবং সকল জ্বালানীর মূল্য নির্ধারণ করার জন্য একক ভাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত।  অপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সকল কোম্পানির দক্ষতা এবং স্বচ্ছ কার্যক্রম নির্ধারণ। বার্ক এনার্জি এবং ম্যানেজমেন্ট অডিংয়ের মাদ্ধমে জ্বালানি বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।

বলা বাহুল্য ২০০৩ থেকে ২০২৪ কোনো সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় নি. কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ আমলাদের পদায়ন করে প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের আজ্ঞাবহ নতজানু প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়।  সবকিছু ছাড়িয়ে যায় পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।  দ্রুত জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ এক্ট ২০১০র অধীনে অস্বচ্ছ এবং জবাদিহিহীন ভাবে কোটি কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করে সরকারী সংস্থাগুলোকে আর্থিক ভাবে পঙ্গু করা হয়. এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে বার্কের মতামত প্রদানের অধিকার সংরক্ষিত থাকলেও উপেক্ষা করা হয়. সর্বশেষ এক্ট সংশোধন করে এক পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণের বিষয়টিতেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ভাগ বসায়। অথচ বিদ্যুৎ ,জ্বালানি সেক্টরের মেগা প্রকল্প সহ অন্যানো প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা পর্যায়ে বার্ক সম্পৃক্ত থাকলে অনেক অপ্রোজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল না. বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে কিন্তু জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা নাই, বিদ্যুৎ কেন্দ্র সমূহ অলস রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো যেত.

যা হোক  নতুন ব্যাবস্থাপনার অধীনে নতুন ভাবে শুরু করা বার্ক নিয়ে আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ আছে. চেয়ারম্যান মহোদয় জ্বালানি সেক্টরে দীর্ঘ দিন সুনামের সাথে কাজ করেছেন, পেট্রোবাংলার অন্যতম সফল চেয়ারম্যান ছিলেন, বিচার কাজ করেছেন ,প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে. প্রখর ব্যাক্তিসম্পন্ন চেয়ারম্যান মহোদয়কে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হলে এবং সংস্থাটিকে প্রয়োজনীয় জনবল দেয়া হলে ৩ বছরের মধ্যে সংস্থাটি বর্তমান চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি থেকে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরকে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে বলে আস্থা রাখা যায়.

যা করতে হবে

জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে নতুন যে কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পটভূমি ,প্রেক্ষাপট ,কারিগরি এবং আর্থিক উপযোগিতা বার্কের কাছে পেশ করে অনুমোদন বাধ্যতামূলক করতে হবে.

প্রতিটি কোম্পানিকে সরকারের বিদ্যমান সকল এক্ট ,পলিসি ,রেগুলেশন মেনে চলতে হবে এবং এই বিষয়ে বার্ক নির্ধারিত ফর্মে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রদান করতে হবে. বার্ক অডিটরদের মাদ্ধমে নিয়মিত এনার্জি এফিসিয়েন্সি এবং ব্যাবস্থাপনা দক্ষতা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করবে।

বিদ্যুৎ ট্যারিফ এবং সকল জ্বালানীর সঠিক বাস্তব সম্মত মূল্য অংশীজনের সঙ্গে গণ শুনানির মাদ্ধমে বার্ক নির্ধারণ করবে।  তবে বার্ক সরকারী এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে ব্যায় সংকোচন নিশ্চিত হলে অকারণে মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না.

বার্ক জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের কোম্পানি সামূহের অপচয় ,সিস্টেম লস কঠোর অনুশাসনের মাদ্ধমে জবাবদিহিতার আওতায় আনলে সকল পক্ষ উপকৃত হবে.

দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ আহরণ ,উত্তোলন বিষয়ে বার্কের সৃষ্ট গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সুষ্ঠু ব্যবহার তদারকী করা প্রয়োজন।  তহবিলটি যথেচ্ছ অপব্যাবহার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে.

অস্ট্রেলিয়ান এনার্জি রেগুলেটর ,ভারতের পিজিআরবি কার্যক্রম দেখার এবং জানার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি দেশগুলোতে কিভাবে সংস্থাগুলো বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের সুযোগ আছে নিজস্ব পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী এগিয়ে যাবার। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি গতিশীল বার্ক গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবী।

আশা করি বর্তমান সরকারের কার্যকালে বার্ক প্রয়োজনীয় সঠিক যোগ্য জনবল নিয়োগ করে দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে শুরু করতে পারবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × one =