টেস্ট ক্রিকেটে তলানিতে থাকার জন্য দায়ী বিসিবি

সালেক সুফী: ২২ বছরে বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে বাংলাদেশের তলানিতে অবস্থানের মূল কারণ ২০০০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত বিসিবির সকল পরিষদের  ক্রমিক ব্যর্থতা।  পুঞ্জীভূত ব্যর্থতার জঞ্জাল পরিষ্কার করে আগামী এক দশকেও  অন্যান্য ৯ দেশের সঙ্গে সামাল দিতে আগাতে পারবে বলে মনে হয় না।

স্বীকার করতে দ্বিধা নাই ১৯৯৯ আইসিসি বিশ্বকাপ চলাকালে তৎকালীন ক্রিকেট কোচ কিংবদন্তি স্যার গর্ডন গ্রিনিজের মূল্যায়ন উপেক্ষা করে টেস্ট ক্রিকেট দূতিয়ালি করা হিতে বিপরীত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেটে টেস্টক্রিকেট মানসিকতা ছিল না, এখনো সেটি নেই।

বলা চলে, টেস্ট ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টাই হয়নি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু মানুষ চর দখলের মতো দখল করেছে বিসিবি। এর মাঝেও যৎকিঞ্চিৎ অর্জন হয়েছে তার মূলে আছে বিকেএসপির অবদান এবং আশরাফুল, মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লার মতো কিছু বিশ্বমানের ক্রিকেটারদের একসঙ্গে পারফর্ম করা।  স্থানীয় ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা তারকাদের অংশগ্রহণ, নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট অনেক অনুকূল ছিল। কিন্তু এখন যেভাবে বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির লংগার ভার্সন ক্রিকেট খেলা হয়, সেখান থেকে টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য লাভ করা প্রায় অসম্ভব। এখন ক্রিকেট পরিকল্পনার থেকে ক্রিকেট কর্মকর্তারা কথা বলেন অনেক বেশি। ক্ষণে ক্ষণে ক্রিকেটারদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।

মানসম্পন্ন  সেরা ক্রিকেটারদের  ক্যারিয়ারে ধীরে ধীরে গোধূলি ঘনিয়ে আসায় এবং ওদের ফেলে যাওয়া শূন্য স্থানে যোগ্য উত্তরসূরি উঠে না থাকায়  সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। ক্রিকেটের টেকসই উন্নয়নে বিসিবির না আছে লাগসই পরিকল্পনা।  না আছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো যোগ্যতা, দক্ষতা।

একসময় বাংলাদেশের কয়েকজন উদীয়মান ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট একাডেমিতে প্রশিক্ষণে আসতো।  ভারতের আঞ্চলিক ক্রিকেট দল বাংলাদেশে খেলতে যেত। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সব দেশের মানসম্পন্ন বিকল্প জাতীয় দল আছে। তারা নিজেদের মধ্যে সফর বিনিময় করছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, নিউ জিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এখন যোজন যোজন এগিয়ে গাছে। পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাবধান বাড়ছে। নবীন আফগানিস্তান দল টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে গাছে। যেভাবে চলছে সেই ধারায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের সকল পর্যায়ে মানসিকতার পরিবর্তন না হলে গভীর গিরিখাত থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

আমি মনে করি না বাংলাদেশে প্রতিভার কমতি আছে।  ব্যাটসম্যানদের টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। মোমিনুল হকের কথায় ধরা যাক।  একজন ক্রিকেটারের টেকনিকে সমস্যা থাকলে ১১টি সেঞ্চুরি করতে পারে না। স্বীকার করি, অন্তর্মুখী ছেলেটির দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সীমাবদ্ধতা আছে। যদি প্রশ্ন করি কেন তাকে তার প্রিয় পজিশন ৩ নম্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল? কেন বিকল্প থাকা সত্ত্বেও তাকে কঠিন সময়ে অধিনায়ক করা হয়েছিল? এই ধরনের একজন ব্যাটসম্যানের বর্তমান নড়বড়ে ব্যাটিং অবস্থার জন্য ব্যাটিং কোচদের ব্যর্থতা মুখ্য।

কেন নাজমুল শান্তর মতো তরুণ ক্রিকেট প্রতিভাকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত না করে ৩ নাম্বার পজিশনে আগুনের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল? কি কারণে মাহমুদুল্লার মতো মানসম্পন্ন ব্যাটসম্যানকে ৭, ৮ নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হতো? কেন স্থানীয় ক্রিকেটে ক্রমাগত সাফল্যের পরেও ইমরুল কায়েস, এনামুল হক বিজয়, নাঈম ইসলামদের ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে? কেন বাংলাদেশ একজন মানসম্পন্ন লেগ স্পিনার খুঁজে পেলো না? বাংলাদেশ ছাড়া সব টেস্ট দলে এমনকি নেপাল দলে  বিশ্বমানের লেগ স্পিনার আছে।

শুনি আইপিএল, বিগ ব্যাশ ছাড়া অন্য কোনো ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের নাম নাকি শুনেননি বিসিবি কর্তারা।  তাহলে বাংলাদেশ টি২০ ক্রিকেটেও তলানিতে কেন? অর্থের অভাব বলা যাবে না। তাহলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ক্রিকেট আইসিইউতে শয্যাশায়ী কেন?

দেশে ক্রিকেট বোদ্ধার অভাব নেই।  বাংলাদেশ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশ থেকে বেশি বিশেষজ্ঞ দেখা যায়। সবাই খারাপ উপদেশ দেয় বলছি না।  কিন্তু মাঠের ক্রিকেট নিশ্চিত ভাবে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে।  কেন সেটি অনেকেই জানেন। বাংলাদেশের অন্তত এক ডজন ক্রিকেটব্যক্তিত্বর নাম আমি বলতে পারি যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত। বিসিবির বর্তমান পরিষদে ক্রিকেট পরিকল্পনা এবং পরিচালনা করার মতো মানুষদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। উঠ ছেরি তোর বিয়ের মতো এনামুল, শরিফুলকে তাড়াহুড়ো করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাঠানো হলো। শুনছি ইমরুল কায়েসকেও সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে।

আশা করি বোধোদয় হবে সবার। না পারলে দায়িত্ব নিয়ে সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট সমাজকে জেগে উঠতে বলছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × five =