ডায়রিয়া: কারণ ও করণীয়

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ: বাংলাদেশের রোগগুলোর মধ্যে ডায়রিয়া অন্যতম একটি। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ এতে আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে শিশুদের ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার অনেক বেশি। রাজধানীর মহাখালীর আই.সি.ডি.ডি.আর.বি. তে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে।

জায়গা সংকুলান না হওয়ায় রোগী সামলাতে হাসপাতালের বাইরে অস্থায়ী তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর অনেকেই আবার কলেরায় আক্রান্ত। প্রতিষ্ঠানের ৬০ বছরের ইতিহাসে এত রোগীর চাপ আগে দেখা যায়নি। তবে বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন শহরে গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক হারে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে।

ডায়রিয়া কাকে বলে? মনে রাখতে হবে পায়খানা নরম বা পাতলা হওয়া মানেই যে  ডায়রিয়া হয়েছে, তা নয়। সারাদিনে তিনবার বা তার বেশি নরম বা পাতলা পায়খানা হলে তাকেই সাধারণত ডায়রিয়া বলা হয়। তবে কিছু কিছু রোগীর পানির মতো পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত কিংবা মিউকাছ বা আম মিশ্রিত পায়খানাও হতে পারে।

ডায়রিয়ার কারণ : ডায়রিয়া সংক্রমণের মূল কারণ সাধারণত বিশুদ্ধ পানি পান না করা এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার না খাওয়া। তাই সঠিকভাবে ব্যক্তিগত এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী। গত দুই বৎসরের বেশি হলো করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে জনগণ বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। এমনকি তারা ঘরে বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধসহ জনগণের চলাচল ও জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে, প্রচুর মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন।

বর্তমানে করোনার সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে, জনগণের ভয়-ভীতি কেটে গেছে। এর সাথে স্বাস্থ্যবিধি পুরো শিথিল হয়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার অনেক কিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এখন সবকিছু  পুরোদমে চালু হয়ে গেছে। ফলে জনগণের বিরাট অংশ আর স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এটাও হঠাৎ ডায়রিয়া বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এবারে হঠাৎ করেই গরমের মাত্রাটা একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই জনগণকে বাইরে বের হতে হচ্ছে, সর্বস্তরের লোকজন অর্থনৈতিক কারণে বা পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। গরমের কারণে প্রচুর ঘাম হয় এবং শরীর থেকে পানি লবণ বের হয়ে যায়, দেহের ভেতরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই মানুষ তৃষ্ণার্ত বা পিপাসার্ত হয়। তাই অনেকেই রাস্তা ঘাটের তৈরি শরবত পান করেন, যেমন গুড়ের বা আখের বা লেবুর শরবত এবং অন্যান্য পানীয় যা মোটেই বিশুদ্ধ নয়।

এগুলো পান করেই মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, এমনকি এর থেকে ফুড পয়জনিংও হচ্ছে। অনেকেই আবার রাস্তাঘাটের বা ফুটপাথের খাওয়া-দাওয়া খেয়ে থাকেন। এই খাবারগুলো প্রায়ই উন্মুক্ত বা খোলা থাকে। এগুলোতে মাছি, পোকা মাকর পরে, এমনকি ধুলাবালিসহ অন্যান্য দূষিত পদার্থও মিশ্রিত হয়। এ সমস্ত খাবার খেয়েও অনেকেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

নিজের ঘরের খাবারও যদি ৬-৭ ঘণ্টার বেশি ফ্রিজের বাইরে থাকে, তাহলে সেগুলো অনেকক্ষণ গরমে থাকার ফলে নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য রোগ-জীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হয়, তা খেয়েও ডায়রিয়া হতে পারে। করোনাকালে জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত।  করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসা এবং স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার সাথে সাথে জনগণের মাঝে ঘনঘন হাত ধোয়া এবং সেনিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করার প্রবণতা কমে গেছে। এর ফলেও ডায়রিয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।

অনেক এলাকায় বিশেষ করে বস্তিতে, রেল লাইনের ধারে বা বাসাবাড়িতে নিম্নআয়ের শ্রমিক শ্রেণির যারা বাস করেন, তারা অনেকেই বিশুদ্ধ পানির অভাব বোধ করেন। এমনকি টিউবওয়েলের পানিও দূষিত, অনেক এলাকায় পানির পাইপ ফুটো হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সাথে মিশে গেছে। অনেকেই আবার পানি ফুটিয়ে পান করেন না। এ সমস্ত দূষিত পানি পান করেই ডায়রিয়া বেড়ে যাচ্ছে। বাসা বাড়ির পানির ট্যাংক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করলেও রোগজীবাণু সংক্রমিত হয়ে যাওয়া পানি পান ডায়রিয়া অন্যতম কারণ।

বাসি খাবার, পচা খাবার, অস্বাস্থ্যকর জীবাণুযুক্ত খাবার, অনেকক্ষণ গরমে থাকার ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার খেলে ফুড পয়জনিং হওয়ার কারণে ডায়রিয়া হতে পারে। খাবার আগে হাত ভালোভাবে না ধোয়া এবং খাবারের জন্য ব্যবহৃত থালা বাটি ভালোভাবে না ধোয়ার ফলেও এ সমস্যা হতে পারে। ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ খাদ্যে নানা ধরনের পানিবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।

অনেক ডায়রিয়া রোগীর পায়খানা পরীক্ষা করে কলেরার জীবানু পাওয়া যাচ্ছে। পাতলা পায়খানা হলে যদি তা চাল ধোয়া পানির মতো হয়, তবে সেটা কলেরার লক্ষণ। এর সঙ্গে তলপেটে ব্যথা হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, ঘন ঘন পায়খানায় যাওয়া এবং শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া এ রোগের উপসর্গ। শিশুদের ডায়রিয়া সাধারণত রোটা নামক ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে।

ডায়রিয়ার লক্ষণ : ঘনঘন পানির মতো পাতলা পায়খানা হওয়া, পায়খানা লাগলে দ্রুত টয়লেটে যাওয়া বা অপেক্ষা করতে না পারা, পায়খানা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা। এমনকি অনেক সময় পোশাকে পায়খানা লেগে যেতে পারে। তলপেটে কাঁমড় বা তীব্র ব্যাথা, বমি-বমি ভাব এমনকি অনেক সময় বমিও হতে পারে এবং  আস্তে আস্তে পানি শূন্যতার কারণে শরীর দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে।

ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোন রোগ-জীবাণুর কারণে  ডায়রিয়া হলে আরও কিছু লক্ষণ থাকতে পারে, যেমন পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া, জ্বর হওয়া, শরীর ব্যথা এবং প্রচন্ড দুর্বল অনুভব করা, বমি হওয়া বা বমি-বমি ভাব থাকা ইত্যাদি। তীব্র ডায়রিয়া হলে দেহ থেকে খুব দ্রুত প্রচুর পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায়। ফলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর এই পানিশূন্যতা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে এবং সময়মত এই ঘাটতি পূরণ করা না হলে বা দ্রুত চিকিৎসা না করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

তাই ডায়রিয়ার প্রথম চিকিৎসা হলো পানিশূন্যতা পূরণ করা। পানিশূন্যতার লক্ষণ :পানিশূন্যতার প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে— মুখ শুকিয়ে আসা, পিপাসা লাগা, চোখ কোটরাগত, চামড়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, তৃষ্ণা বৃদ্ধি, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া। এক পর্যায়ে ব্লাড প্রেসার কমে যায়, হৃদ্স্পন্দন বৃদ্ধি এবং খুব দুর্বল নাড়ি  পরিলক্ষিত হয়। প্রচণ্ড ক্লান্তি এবং রোগী নিস্তেজ হয়ে শকে চলে যেতে পারে।

ডায়রিয়ার চিকিৎসা : ডায়রিয়ার গুরুতর জটিলতা হলো পানিশূন্যতা, তাই শরীর থেকে বের হয় যাওয়া পানি ও লবণ দ্রুততম সময়ে পূরণ করতে হবে। রোগীকে খাওয়ার স্যালাইনের পাশাপাশি বেশি বেশি তরল খাবার, যেমন—ডাবের পানি, চিড়ার পানি, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে এবং স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। এক প্যাকেট স্যালাইন আধালিটার পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। বড়দের (১০ বছরের বেশি বয়সি) ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর এক গ্লাস (২৫০ মিলি) খাওয়ার স্যালাইন খেতেহবে। শিশুদের ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর শিশুর যত কেজি ওজন, তত চা চামচ বা যতটুকু পায়খানা হয়েছে আনুমানিক সেই পরিমাণ খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।

শিশু বমি করলে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে, যেমন—চার পাচ মিনিট পর পর এক চা চামচ করে খেতে দিন। খাওয়ার স্যালাইনের পাশাপাশি  অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাবে এবং শিশুকে কোনো অবস্থায়ই বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না। ছয় মাসের অধিক বয়সি বাচ্চাকে খাওয়ার স্যালাইনের পাশাপাশি সব ধরনের স্বাভাবিক খাবার খাবে। ডায়রিয়ার শুরুতেই কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক খাওয়া একদমই উচিত নয়। আবার অনেকে দ্রুত ডায়রিয়া বন্ধ হওয়ার জন্য ওষুধ খায়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কোন কোন ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক, মেট্রোনিডাজল বা বমির ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা খেতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।

কখন হাসপাতালে নিতে হবে :রোগীর অবস্থার উন্নতি না হলে বা বেশি খারাপ হলে, বেশি মাত্রায় বমি হলে, মুখে খেতে না পারলে, প্রচন্ড পেটে ব্যথা ও পায়খানার সাথে রক্ত গেলে এবং ব্লাড প্রেসার কম ও প্রস্রাব বন্ধ হয়ে  যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কলেরায় খুবই দ্রুত শরীরে পানি শূন্যতা তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে রোগী দ্রুত নিস্তেজ হয়ে  এবং শকে চলে যেতে পারে। তাই কলেরার রোগীকে হাসপাতালে নিতে কোনভাবেই দেরি করা যাবে না।

ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয় ও সতর্কতা : অবশ্যই সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও ফুটানো পানি পান করতে হবে। অত্যধিক গরম আবহাওয়ার কারণে অধিক  পিপাসা লাগাই স্বাভাবিক। চেষ্টা করতে হবে নিরাপদ পানি সাথে বহন করা। পানি টগ বগ করে ফুটিয়ে সেই পানি পান করতে হবে এবং ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।

রাস্তার পাশে অনেক খোলা পরিবেশে লেবুর শরবত, গুড়ের শরবত, আখের রস, জুস বা ফল কেটে বিক্রি করা হয়। এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। রাস্তার পাশে, ফুটপাথে বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি করা হয়, এগুলো প্রায়ই খোলামেলা থাকে কীটপতঙ্গ সহ ধুলাবালি এই খাবারগুলোকে দূষিত করে। উন্মুক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিবেশন করা এমন খাবার পরিহার করতে হবে। খাদ্যগ্রহণের আগে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত দয়ে নিতে হবে । তৈরি করা খাদ্যসামগ্রী এবং পান করার নির্ধারিত পানি ঢেকে রাখতে হবে। নয়তো বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ খাবারে বসে জীবাণু ছড়াতে পারে।

পরিষ্কার পানিতে আহারের বাসনপত্র, গৃহস্থালি ও রান্নার জিনিস এবং কাপড়চোপড় ধোয়া সম্পন্ন করতে হবে এবং প্রয়োজনে সাবান ব্যবহার করতে হবে। ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হচ্ছে খাবার প্রস্তুত, স্পর্শ করা, পরিবেশন করা ও খাবার খাওয়ার আগে, বাইরে থেকে ফিরে এসে হাত ধুয়ে নেয়া। কারণ হাত দিয়েই মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে।

অবশ্যই টাটকা এবং ভেজালমুক্ত খাবার খেতে হবে। অনেক দিন ফ্রিজে রাখা খাবার খাওয়াও ঠিক না। দুধ, কলা, ফলমূল বেশি দিন পুরনো হয়ে গেলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, সেগুলো না খাওয়াই ভালো। পিতা মাতা বা যেসব অভিভাবক শিশুকে খাওয়ান, তাঁরা শিশুকে খাওয়ানোর আগে এবং শিশুর মলত্যাগের অথবা পায়খানা পরিষ্কার করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। ফিডারে দুধ খাওয়ালে ফোটানো পানি ও সাবান দিয়ে ভালো ভাবে ফিডারটি ধুয়ে নিতে হবে এবং ফিডারের নিপলের ছিদ্রটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। শিশুদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে, শিশুরা বাইরে খেলাধুলা করে, যে কোন জিনিস হাতে নিয়ে মুখে দেয়। তাই মাঝে মাঝে তাদের হাত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

পায়খানার জন্য সব সময় স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করা উচিত। মলত্যাগের পরে টয়লেট থেকে বের হয়ে, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। রান্নাঘর ও বাথরুমের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয়। যদি পানি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা যেমন পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা পানি আসা ইত্যাদি দেখা দেয়, তবে ওয়াসা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যোগাযোগ করে পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে । ছোট বড় সবার ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সহ হাতের নখ কেটে সব সময় ছোট রাখা উচিত। যাঁরা গ্রামে বসবাস করেন, তাঁদের যেখানে-সেখানে বা পুকুর-নদীর ধারে মলত্যাগের অভ্যাস পরিহার করতে হবে। খালি পায়ে বাথরুমে বা মলত্যাগ করতে না গিয়ে স্যান্ডেল বা জুতা ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

ডায়রিয়া নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ও করণীয় :মূলত গরমকালে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। ঠিকভাবে পানি ও লবণ পূরণ করা হলে এটি কখনো গুরুতর আকার ধারণ করে না। বেশির ভাগ ডায়রিয়া এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইন, খাওয়া এমনকি এর চিকিৎসা নিয়ে এখনো রয়ে গেছে কিছু ভুল ধারণা:

যাদের উচ্চ রক্তচাপ, তারা ওরস্যালাইন খেতে পারবেন কিনা? উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন রোগীরা ডায়রিয়ার আক্রান্ত হলে ওরস্যালাইন খেতে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। কেননা স্যালাইনে লবণ আছে, তাদের আশঙ্কা ওরস্যালাইন খেলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। এটি গুরুতর ভুল ধারণা। প্রতিবার পাতলা পায়খানার সঙ্গে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ বের হয়ে যায় এবং তা যথাযথভাবে পূরণ করা না হলে রোগীর পানিশূন্যতা, লবণশূন্যতা এমনকি রক্তচাপ কমে গিয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে মৃত্যুও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে ওরস্যালাইন খেতে নিষেধ নেই।

ডায়াবেটিসের রোগীরা কি ওরস্যালাইন খেতে পারবেন না? ওরস্যালাইনে চিনি বা গ্লুকোজ থাকে, তাই ডায়াবেটিস রোগীরা ওরস্যালাইন খেতে ভয় পান। মনে করেন, ওরস্যালাইন খেলে ডায়াবেটিস বাড়তে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওরস্যালাইনে যে সামান্য চিনি বা গ্লুকোজ আছে, তা অন্ত্রে লবণ শোষণের কাজে ব্যয়িত হয়। সুতরাং ডায়রিয়ার সময় ডায়াবেটিস রোগীরা নির্দ্বিধায় ওরস্যালাইন খেতে পারবেন।

কিডনি রোগীরা কি ডায়রিয়া হলেও মেপে পানি খাবেন? যারা কিডনির জটিলতায় ভোগেন তারা অনেকেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন, কারণ স্বাভাবিকভাবে তাদের নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি মেপে খেতে বলা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ডায়রিয়ার অধিক পরিমাণ পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, ফলে পানিশূন্যতার ফলে কিডনি রোগ আরও বাড়তে পারে। সুতরাং প্রয়োজনে অতিরিক্ত তরল গ্রহণ করতে হবে।

ডায়রিয়ার রোগীরা কি স্বাভাবিক খাবার খাবেন অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভোগেন, ডায়রিয়া হলে স্বাভাবিক খাবার খেতে পারবেন কিনা। আসলে ঘরে তৈরি পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত সব ধরনের স্বাভাবিক খাবারই খেতে মানা নেই। ভাত, মাছ, সবজি ইত্যাদি স্বাভাবিক ও সহজপাচ্য খাবার খেতে কোনো বাধা নেই। তবে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য না খাওয়াই ভালো। স্তন্যপানরত শিশুরা কোনো অবস্থাতেই বুকের দুধ খাওয়া বন্ধ করবে না। সারা দিনে এক প্যাকেট স্যালাইন খেলেই চলবে?

স্যালাইন কতটুকু খেতে হবে তা নির্ভর করবে কতবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে বা কতটুকু পানি হারাচ্ছেন তার ওপর। ডায়রিয়ার কারণে একজন মানুষ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এক দেড় লিটারের বেশি পানি হারাতে পারেন। সবচেয়ে সহজ হিসাব হলো প্রতিবার পায়খানা হওয়ার পর স্যালাইন খাওয়া এবং অল্প অল্প করে সারা দিন বার বার খাওয়া। এর বাইরে সারা দিন পানি ও তরল খাবার যেমন স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে হবে।

বমি বা পাতলা পায়খানা দ্রুত বন্ধের জন্য ওষুধ সেবন প্রয়োজন কিনা?অনেক সময় ফুড পয়জনিংয়ের কারণে বমি বা পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতই ফার্মেসি থেকে বমি বা পাতলা পায়খানা দ্রুত বন্ধের জন্য ওষুধ খান, যা একেবারেই ঠিক নয়। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ খাওয়া ঠিক হবে না, কারণ পয়জনিংয়ের ক্ষেত্রে বরং কিছু সময় বমি ও পাতলা পায়খানার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পয়জন বের হয়ে যায়। অ্যান্টিবায়োটিক কি জরুরি? সব ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক জরুরি নয়। প্রয়োজন হলো, দেহের লবণ ও পানিশূন্যতা পূরণ। দরকার হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যেতে পারে।

শিরায় স্যালাইন নিতেই হবে? অনেকে শিরায় স্যালাইন নিতে ভয় পান। কিন্তু ডায়রিয়ায় মাত্রা যদি তীব্র হয় তাহলে শুধু মুখে স্যালাইন পান করে শরীরে সৃষ্ট পানিশূন্যতা পূরণ করা সম্ভব না। তাই হাসপাতলে ভর্তি হয়ে প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন নিতে হবে। মনে রাখতে হবে ডায়রিয়া থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র প্রতিকার এবং প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থাসহ সচেতন থাকা।

লেখক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − 5 =