মাহবুব আলম
সরকার ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছে। বলেছে, এখন থেকে খুচরা বাজারে আলুর দাম হবে প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। আর প্রতি পিস ডিমের দাম হবে ১২ টাকা। ১৭ সেপ্টেম্বর এক সরকারি ঘোষণার এই দাম নির্ধারণ করা হয়। খুব স্বাভাবিকভাবে এই ঘোষণায় ভোক্তাদের মাঝে একটা স্বস্তির ভাব দেখা দেয়। ভোক্তাদের অনেকেই বলতে শুরু করে দেরিতে হলেও ভালো পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাবে। কিন্তু হায়, ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভোক্তাদের এই আশাবাদ, এই প্রত্যাশা হাওয়ার মিলিয়ে যায়। কারণ ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেওয়ার পর দাম কমা তো দূরে থাক বরং দাম আরো বেড়ে গেল।
দাম বেঁধে দেওয়ার আগে বাজারে যে আলুর দাম ছিল প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা তা বেড়ে হয়ে গেল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। একইভাবে যে পেঁয়াজের দাম ছিল ৭৫-৭৬ টাকা তা বেড়ে হয়ে গেল ৮৫-৮৬ টাকা। যে ডিমের দাম ছিল প্রতিটি ১৩ থেকে ১৪ টাকা তা বেড়ে হলো ১৫ টাকা থেকে ১৭ টাকা। এ যেন উল্টা পুরান। উল্টা রথ। কিন্তু কেন? তবে কি সরকার দুর্বল অকার্যকর হয়ে গেছে? না মোটেও তা নয়। সরকার মোটেও দুর্বল অকার্যকর হয়নি। বরং যা হয়েছে তা হলো সরকার মূল্য নির্ধারণ করেছে অমনি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। শুরুতে কিছু না বলে রাতারাতি দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা বুঝিয়ে দিয়েছে, সরকার তুমি তোমার জায়গায় থাকো আমাদের জায়গায় এসো না। তুমি তোমার কাজ করো, আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দাও।
প্রথমে কিছু না বলে দাম বাড়ালেও পরে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেছে, দাম কমানো সম্ভব না। আলু ব্যবসায়ীরা মনগড়া হিসাব দিয়ে বলেছে সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করলে তাদের বিপুল লোকসান দিতে হবে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য, প্রকৃত সত্য মোটেও তা নয়। আমাদের কৃষি দপ্তরসহ তিন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের হিসাব হচ্ছে পাইকারি পর্যায়ে আলুর দাম সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ২০ টাকা হতে পারে। এর বেশি নয়। অথচ ব্যবসারিয়া পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি করছে ৩৭ থেকে ৪০ টাকা করে। উল্লেখ্য কৃষকের কাছ থেকে কেনা ১০ থেকে ১২ টাকা কেজির আলু ৩৭ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করা স্রেফ ডাকাতি। এই ডাকাতি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটা নিঃসন্দেহে ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, শুরুতেই সরকারের এই সৎ উদ্যোগ মাঠে মারা গেছে। কারণ এ বিষয়ে অর্থাৎ বেঁধে দেওয়া দরে বিক্রিতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নমনীয় পদক্ষেপ।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে। জরিমানার পরিমাণ ও ব্যবসায়ীদের যে সংখ্যা জানা গেছে তা হাস্যকর। যেখানে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে থানায় লকআপে ভরার কথা সেখানে নামমাত্র জরিমানায় ব্যবসায়ীরা ঠিক হবে এরকম চিন্তাই তো একটা বিভ্রান্তি। মনে রাখতে হবে, চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। আর এজন্য চাই যেমন কুকুর তেমন মুগুর। ১৭ থেকে আজ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৩ থেকে ১৪ দিন। এ সময় কোনো গ্রেপ্তার নেই। নেই কোনো কোল্ড স্টোরেজে তালা অর্থাৎ সিল করার ঘটনা। তাহলে ব্যবসায়ীরা কেন দাম বাড়াবে না।
এখানে বলা দরকার, দেশে আলুর চাহিদা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টন। সেখানে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। অর্থাৎ কোনো উৎপাদন ঘাটতি নেই। বরং অতিরিক্ত সরবরাহ রয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী চাহিদা ও সরবরাহের উপর বাজার মূল্য ও বাজার ব্যবস্থার তত্ত্বও এখানে অচল। কারণ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট এতো শক্তিশালী যে অতি উৎপাদন ও অতিরিক্ত সরবরাহের উপর বাজার নির্ভর করে না। বাজার নির্ভর করে সিন্ডিকেটের অতি মুনাফার সন্তুষ্টির উপর।
আলুর মতো পেঁয়াজের বাজারে চিত্র একই। সরকার নির্ধারণ করেছে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকায়। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ ও ৯০ টাকায়। যা অভিযানের আগে ছিল ৭৫ টাকা। অর্থাৎ আলু ব্যবসায়ীদের মতো পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়েছে, পারলে কমাও দেখি। আলুর চাইতে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ একটু কঠিন। কারণ দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে ঘাটতি আছে। আর এই সুযোগ নিয়ে প্রতিবছর পেঁয়াজ সিন্ডিকেট কয়েক হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত মুনাফা করে। একে মুনাফা না বলে লুট বলা ভালো। প্রতিবছর বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট করে নিচ্ছে নীরবে নিভৃতে। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক অদৃশ্য কারণে সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলেও অবাধ আমদানির সুযোগ দেয় না। এ এক রহস্যজনক অধ্যায়।
পেঁয়াজের মতো দেশের ডিমের উৎপাদনেও ঘাটতি আছে। দেশে ডিমের দৈনিক চাহিদা প্রায় চার কোটি পিস। কিন্তু উৎপাদন হয় তিন কোটি থেকে তিন কোটি বিশ লাখ পিস। অর্থাৎ দৈনিক চাহিদার ঘাটতি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ১৮ কোটি মানুষের দেশে ডিমের চাহিদা মাত্র চার কোটি। এটা রীতিমত বিস্ময়কর। কারণ ১৮ জনের মাত্র চারজনের ভাগ্যে ডিম জোটে। সংখ্যা তত্ত্বের হিসাবে চারজন ডিম খেলেও কার্যত তিনজনের বেশি ডিম খাওয়া দূরে থাক তারা চোখেও দেখে না। কারণ আমাদের ধনীরা কেউ একটা ডিম খায় না। সকালের নাস্তায় ডিম সিদ্ধ খেলেও ন্যূনতম দুইটি, আর ওমলেট করে খেলেও ন্যূনতম দুইটি। ডাবল ওমলেট ছাড়া ধনীদের তো ইজ্জতই থাকে না। সেই হিসাবে বাংলাদেশের ডিমের চাহিদা খুবই কম। ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করলে এই চাহিদা রীতিমতো হাস্যকর। আর এই কারণেই দেশে পুষ্টিহীনতা অস্বাভাবিক। সে যাই হোক, ডিমের দাম নিয়ে যে তুঘলকি কারবার চলছে সেই বিষয়ে আলো ফেলা যাক।
সরকার ডিমের দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি পিস ১২ টাকা। কিন্তু তারপরেও বাজারে এই ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৭ টাকায়। রীতিমতো সরকারকে কাঁচকলা দেখাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ঠিক যেমনটি দেখাচ্ছে আলু-পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। আলু-পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের মতো ডিম ব্যবসায়ীদেরও সিন্ডিকেট আছে। আর এই সিন্ডিকেটও খুব দুর্বল নয়। তাইতো তারা সরকারের ডিম আমদানির সিদ্ধান্তে শুধু অসন্তোষ নয় রীতিমতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বলেছে, ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত দেশে পোল্ট্রি শিল্পকে ধ্বংস করে ফেলবে। ডিম ব্যবসায়ীদের আমদানি বিরোধিতা নতুন নয়। অতীতে যখনই সরকার ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই ডিম ব্যবসায়ীরা তার বিরোধিতা করে শিল্প ধ্বংসের অজুহাত দাঁড় করিয়েছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলের হিসাব হচ্ছে দেশে একটি ডিমের সর্বোচ্চ উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। এক্ষেত্রে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হতে পারে না। সেখানে ডিম উৎপাদনকারীরা এ বিষয়টিকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। তারা ভোক্তাদের পকেট কাটা থেকে কোনোমতেই বিরত থাকতে রাজি নয়। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, পোল্ট্রির মালিকরা ভোক্তাদের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধ নয়। এমনকি সরকারকেও মানতে রাজি নয়। সরকার নানান সুবিধা দিয়ে এই পোল্ট্রি শিল্প গড়ে তোলা ও রক্ষার কাজ করছে। অথচ পোল্ট্রি মালিকরা ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে রাজি নয়। কেউ বাড়িতে একটা কুকুর পুষলে সেই কুকুর গৃহস্বামীসহ গৃহের সকলের অনুগত হয়। বিপদে গৃহের সবার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু পোল্ট্রি শিল্প মালিকরা ঠিক উল্টা কাজ করে। যে সরকার তাদের এতো সুবিধা দেয় সেই সরকারকেই বিপদে ফেলতে ইচ্ছামতো ডিমের দাম বাড়ায়। এমনকি নির্বাচনের বছরও। এর থেকে অকৃতজ্ঞ আর কি হতে পারে?
সরকার ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ৪ কোটি পিস পরে আরো ৬ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। দৈনিক চাহিদার হিসাবে আমদানি করা ডিম দিয়ে আড়াই দিনের চাহিদা মিটবে। সরকারে এই সিদ্ধান্ত কার্যত ডিম ব্যবসায়ীদের পক্ষেই গেছে। তবে ভোক্তা সাধারণ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও এতো কম সংখ্যক ডিম আমদানির সিদ্ধান্তে হতাশ তারা। কারণ মাত্র দুই-আড়াই দিনের চাহিদা পূরণে ডিমের বাজারে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এক্ষেত্রে ক্রেতা সাধারণের দাবি প্রতিমাসে ডিম আমদানি করা হোক। এবং তা ন্যূনতম ২০ কোটি। তাহলেই কেবল ডিম ব্যবসায়ীরা সাইজ হবে। আর তা না হলে ডিম ব্যবসায়ীদের বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকবে। অব্যাহত থাকবে তাদের পকেট কাটা আর সরকারকে সময়-অসময়ে বিপদে ফেলা।
এই অবস্থায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ী নয়, ক্রেতা সাধারণের কথা জনগণের বিষয়কেই প্রাধান্য দেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আর তা না হলে শুধু ডিম আমদানি নয় একই সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানিও বাড়াতে হবে। এটাই একমাত্র পথ সিন্ডিকেট ভাঙা ও ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করার। মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীদের প্রতি আবেদন নিবেদন করে কোনো লাভ হবে না। আর তাইতো বাংলা প্রবাদ আছে ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি।’ আর তার জন্য চাই কঠোর পদক্ষেপ। শুধু জরিমানা নয়, চাই জেল-জরিমানা। প্রয়োজনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তালা-সিলগালা। মনে রাখতে হবে আর এক বাংলা প্রবাদ ‘যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল’।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক