মুশফিকুর রহমান
কয়েক সপ্তাহ আগে সুযোগ হয়েছিল কক্সবাজার হয়ে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে যাবার। কয়েক বছর আগে একবার সেখানে গিয়েছিলাম। এবার গিয়ে দু’রাত থাকার সুযোগ হলো সাফারি পার্কের ভেতরে। সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক মাযহারুল ইসলামের আন্তরিক আতিথেয়তা এ যাত্রায় সেখানে মনে রাখার মতো কিছু সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছে। সাফারি পার্কে থেকে যাবার আমন্ত্রণে বেশ একটা রোমাঞ্চের হাতছানি ছিল। সেখানে বিশাল প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনের ভেতর, বুনো পশু-পাখিদের আবাসভূমিতে তাদের আশে পাশে দিন-রাত সময় কাটানো এবং কাছ থেকে বন্য পরিবেশ অনুভব করার বিরল সুযোগ সহজে পাওয়ার নয়।
ঢাকার রমনা পার্কে গেলে এখন খেয়াল করা যায়, কৃষ্ণচুড়া, জারুল, সোনালু, স্বর্ণলতা, নাগলিঙ্গম, নাগেশ^র এই শ্রাবণেও ফুটে আছে। প্রকৃতিতে কিছু একটা এলোমেলো ব্যাপার ঘটছে, না হলে বসন্তের ফুল বর্ষায় ফুটবে কেন। কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের প্রবেশ পথে উজ্জ্বল রঙের কৃষ্ণচুড়া, জারুল, কনকচুড়া, সোনালু গাছের সারি দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাচ্ছে। আগের দেখা সেই মলিন ফটক নয়, আধুনিক দৃষ্টিনন্দন কার পার্ক, বিশ্রামাগার, টিকেট কাউন্টার পেরিয়ে পার্কের দৃষ্টিনন্দন নতুন প্রধান ফটক পেরুতেই প্রাচীন বিশালাকৃতি গর্জন গাছগুলো জানান দিল যে, আমরা এক প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনভূমিতে পা রেখেছি। এই সাফারি পার্ক প্রকৃতির পরিবেশে দেশি-বিদেশি পশু-পাখিদের একটি সংগ্রহশালা। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী-শিক্ষার্থী, প্রকৃতি গবেষক ভ্রমণে আসেন। আমাদের সাথে দেখা হলো অসংখ্য দর্শনার্থী, পর্যটকের। তাদের কেউ এসেছেন কাছাকাছি জনপদ থেকে, কেউ দূর অঞ্চল থেকে।
পার্কের সবুজ ঘন বনের ভেতর দিয়ে দুপাশের বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে হেঁটে যাওয়া যায়। আমরাও খানিক পথ হেঁটে পাড়ি দিলাম। হাঁটা পথে গাছের পাতার শব্দের সাথে হঠাৎ ডানা ঝাপটানো কোনো পাখির সশব্দ উড়ে যাওয়া শুনে চমকে উঠতে পারেন। যেতে যেতে বন মোরগ বা বানরের দলের মুখোমুখি হতে পারেন। বুনো হাতি বা বুনো শুকরের মুখোমুখি হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। সাফারি পার্কের ভেতর ঘুরে বেড়ানোর সময় দূর থেকে বাঘ, হাতি বা সিংহের গা হিম করা গর্জন আপনাকে চমকে দিতে পারে।
হেঁটে চলার বদলে সুসজ্জিত বাসে চড়ে সাফারি পার্কের ৯০০ হেক্টরের বিশাল এলাকা ঘুরে দেখা ভালো। পার্কের ভেতরে স্থাপিত উঁচু টাওয়ার থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করলে পার্কের বিস্তৃতি এবং বৈচিত্র্য সহজে বোঝা যায়। এখানে বন্য পশু পাখিদের অধিকাংশরাই উন্মুক্ত এলাকায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করছে। কিছু সংখ্যক হিংস্র প্রাণীকে সংগত কারণে নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতরে রাখা হয়েছে। ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা স্থানীয় অনেক বিরল প্রাণীর যেমন সংগ্রহ রয়েছে, একইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বিরল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীদেরও সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক বাংলাদেশের প্রথম সাফারি পার্ক। গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের বন অধিদপ্তর ডুলাহাজারায় মাত্র ৪২.৫ হেক্টর এলাকা নিয়ে স্থানীয় প্রজাতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করে। মানুষের বিনোদন ও শিক্ষার আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৯৮-২০০১ সময়কালে কেন্দ্রটির পরিসর বাড়িয়ে ৩০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক স্থাপন করা হয়। বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের টেকসই সংরক্ষণ, বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জনসচেতসতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি ও ইকো-ট্যুরিজম প্রসারের লক্ষ্যে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কটির আয়তন বাড়িয়ে পরবর্তীতে ৯০০ হেক্টরে উন্নীত করা হয়েছে ।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে বর্তমানে বেঙ্গল টাইগার, এশিয় ভাল্লুক, সিংহ, হাতি, জলহস্তি, জেব্রা, গয়াল, হরিণ, কুমির, কচ্ছপ, সাপ, শকুন, চিল, ময়ুর, পেলিকন, সারস, মদনটাক, কালিম পাখিসহ ৭৯টি স্তন্যপায়ী, ৬৭টি সরিসৃপ ও উভচর প্রাণী ও ১৪৩ পাখি রয়েছে। তাছাড়া, পার্কে রয়েছে ৩৪০ প্রজাতির উদ্ভিদ। পশু-পাখিদের বেষ্টনী নির্মাণ, প্রয়োজনীয় পানি ও খাদ্যের সরবরাহ, বন্যপ্রাণীর চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের সাথে সাথে সাফারি পার্কে বন্যপ্রাণীদের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে ।
চট্টগ্রামের বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী একই সাথে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের দেখভাল এবং এর চলমান সংস্কার কর্মকাণ্ডের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এর দৈনন্দিন তদারকিও তিনি করছেন। সাফারি পার্কটির সংস্কার এবং সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের কাজ শিঘ্রি শেষ হলে এই পার্ক প্রকৃতি সংরক্ষণে দেশের অন্যতম দৃষ্টান্ত হবে বলে তিনি আশাবাদী ।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে তৃণভোজি প্রাণীদের বিচরণক্ষেত্র। সেখানে হাতি, জেব্রা, গয়াল, ওয়াইল্ড বিস্ট, হরিণ, গয়াল-এর দল বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমিতে ভয়হীন চড়ে বেড়ানো বা ইচ্ছেমতো ছুটে চলার স্বাধীনতা উপভোগ করছে। এই সাফারি পার্কের জলাভূমিতে স্থানীয় এবং পরিযায়ী অসংখ্য জলচর পাখিদের আনাগোনা রয়েছে।
সাফারি পার্ক কেবল আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন নয়, এটি প্রকৃতির একটি সংরক্ষণ কেন্দ্র। প্রকৃতিতে যেমন, একইভাবে এই পার্কে বিচরণকারী পশু-পাখিরাও কখনও কখনও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারিতে আহত হয়। আবার পার্কের বাইরে আহত বা বিপন্ন অবস্থায় উদ্ধার করা বন্য পশু-পাখি আনা হয় সাফারি পার্কে। তাদের চিকিৎসাসেবা, দেখভাল করার জন্য ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে বন্যপ্রাণী চিকিৎসালয় রয়েছে। সেখানে ভেটেনারি অফিসার ডা. হাতেম সাজ্জাত মো. জুলকারনাইনের সাথে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, কেবল পার্কের বেষ্টনিতে থাকা বন্যপ্রাণী নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করে আনা বিপন্ন বন্য পশু-পাখিদেরও ঠাঁই হয় এই পার্কে। ডা. জুলকারনাইন আমাদের দেখালেন ‘যমুনা’ নামের প্রায় ৩ বছর বয়সের এক হাতির বাচ্চাকে। এখন যমুনা’র ওজন প্রায় ৭০০ কিলোগ্রাম। ২০২১ সালে ছোট্ট হাতির বাচ্চাটিকে সাফারি পার্কে আনা হয়েছিল টেকনাফের বন থেকে উদ্ধার করে। সেখানে পাহাড় থেকে পড়ে হাতির মা নিহত হলে হস্তি শাবককে বাঁচাতে এগিয়ে আসে বনবিভাগের কর্মীরা। বাচ্চাটি এখন বড় হচ্ছে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে। এখনও হস্তি শাবকটিকে সময় ধরে নিয়মিত ফিডারে দুধ খাওয়াতে হয়। মানুষের কাছাকাছি থাকতে অভ্যস্ত হওয়া হাতির বাচ্চা ‘যমুনা’ খাওয়া হলে মানবশিশুর মতোই খেলবার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। এমনি অসহায় এক মায়া হরিণকেও দেখলাম পার্কের কর্মীরা ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছেন।
প্রতিবছর ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে পায় ৩ লক্ষ দর্শনার্থী ভ্রমণে আসেন। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ সহায়তায় ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নে নানামুখি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের উদ্যোগে এই সাফারি পাকের্র আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। ইতিমধ্যে পশু-পাখিদের জন্য বেষ্টনী নির্মাণ, প্রয়োজনীয় পানি ও খাদ্যের সরবরাহ, বন্যপ্রাণীদের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে ।
সাফারি পার্কের দর্শনার্থীদের মনে রাখতে হয় যে, জায়গাটি বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ অভয়ারণ্য এবং এটি তাদের জগৎ। মানুষ সেখানে ক্ষণিকের অতিথি। সাফারি পার্কে ভ্রমণের সময় দর্শনার্থীদের পার্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার পাশাপাশি গাছপালা ও বন্যপ্রাণীদের প্রতি সংবেদনশীল থাকতে হয়; যেন মানুষ বন্যপ্রাণীদের কোনো ক্ষতি, বিপন্নতা বা শংকার কারণ না হয়।
ডুলাহাজারা সাফারি পাকে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার মনে হয়েছে, প্রকৃতির এই অসাধারণ সংগ্রহশালায় আমরা কেবল বিরল, বিপন্ন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেখার সুযোগ পাই না, তাদের সান্নিধ্যে প্রকৃতিতে আমাদের পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতার কথাও মনে করার সুযোগ পাই।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ