মাহবুব আলম
কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধুর অফিসে এক পরিচিত অতিপরিপাটি ভদ্রলোককে দেখলাম উষ্কখুষ্ক চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কেমন জানি মনমরা ভাব নিয়ে বসে আছে। সামনে চা’য়ের কাপ, চা ঠান্ডা পানি হয়ে যাচ্ছে সে দিয়ে কোনো খেয়াল নেই। চোখে কেমন যেন একটা উদাস ভাব। মুখে রীতিমতো আতঙ্কের ছাপ। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার আপনার এই অবস্থা কেন?
ভদ্রলোক আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ ভাই মনটা খারাপ। আমার ৭ বছরের ভাগ্নিটাকে বাঁচাতে পারলাম না। ডেঙ্গুর সাথে লড়ে মাত্র ৩ দিনের মাথায় গতকাল চলে গেল। ওর মা’র অবস্থাও ভালো না। এখন কি হয় একমাত্র আল্লাহই জানে।
শুনে কি বলবো মুখে কোনো ভাষা এলো না। এই সময় আমার বন্ধুটি (যার অফিসে গিয়েছি) সে বললো, তামিম ভাই ভেঙে পড়লে চলবে না। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার উপরেই নির্ভর করছে আপনার বোনের পুরো পরিবার। আপনার বোন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। বোনের স্বামীও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এইমাত্র শুনলাম আপনার আরেক বোন আর ছেলেরও ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। এই অবস্থায় আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনি শক্ত না হলে ওদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে কে? এই কথা বলে আমার বন্ধুটি বলল, তামিম ভাই আমাকে দেখেন দিব্যি অফিস করছি। জানেন, আমার অবস্থা কি? আপনার মতো আমার পুরো পরিবারও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। আমার মা স্কয়ারে, ছোট ভাই আর বড় ছেলে আনোয়ার আদ দ্বীনে। সকাল-বিকাল-রাত যখন সময় পাচ্ছি হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে। সত্যি বলতে কি ডেঙ্গু যে এত ভয়াবহ আগে বুঝিনি। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি ডেঙ্গু কি জিনিস।
এই হলো আমাদের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ডেঙ্গুর চিত্র। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী আর শোকের মাতম।
৩১ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এদিন ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে এ বছর মৃত্যু সংখ্যা দাঁড়ালো ২৬১ জন। আর সারাদেশে সর্বমোট আক্রান্ত ৫৪ হাজার ৪১৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩০ হাজার ৩৩১ ও ঢাকার বাইরে দেশের অন্যত্র আক্রান্ত ২৪ হাজার ৮৬। এই আক্রান্তদের মধ্যে আমাদের জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটারও রয়েছেন। তিনি হলেন হাসান মাহমুদ।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু এই সংখ্যা হচ্ছে সরকারি ভাষ্য। প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। কারণ অধিকাংশ হাসপাতাল সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও নিয়মিত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানায় না। যেসব হাসপাতালে স্বাস্থ্য দপ্তরকে নিয়মিত তথ্য দেয় এদের মধ্যে দেশের নামকরা হাসপাতালগুলো আছে। ১ আগস্ট প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এগুলো হচ্ছে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল, কমফোর্ট নার্সিং, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মনোয়ার হাসপাতাল, ঢাকা হেলথ কেয়ার, আদ দ্বীন, ব্যারিস্টার রফিক উল হক হাসপাতাল, আলোক হাসপাতাল, মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ইত্যাদি।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে হাসপাতালগুলোতে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। চিকিৎসা দিতে ডাক্তার ও নার্সরা হিমশিম খাচ্ছে। আবার কোথাও বেড নেই অর্থাৎ অনেক হাসপাতালে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। সেই সাথে টাকা নেই তো চিকিৎসা নেই। ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩ মাস ২০ দিন বয়সি ডেঙ্গু রোগীকে দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা গাড়িচালক বাবা আইসিইউ-এর খরচ যোগাবে কিভাবে। ৩০ জুলাই ভর্তি হবার পর থেকেই তার চিকিৎসার জন্য আইসিইউতে নেওয়ার কথা কিন্তু নেওয়া হয়নি। নেওয়া যায়নি। ডাক্তার জানায়, ছোট্ট শিশু আয়েশার নাড়ির স্পন্দন নেই, চোখও খুলছে না।
ডেঙ্গু ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় ১৭৭৯ সালে। এর পরবর্তী বছর ১৯৮০, ৮১ ও ৮২ সালে ডেঙ্গু মহামারী রূপ নেয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় সেই হিসেবে ডেঙ্গুর বয়স প্রায় সাড়ে তিনশ বছর। এই দীর্ঘ সময়েও ডেঙ্গু প্রতিরোধের কোনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। অবশ্য, এটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের রোগ না হয়ে শীত প্রধান ইউরোপের রোগ হলে কি হতো তা নিয়ে নানা কথা আছে।
১৭৮০-৮২ এর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আবারো ডেঙ্গু বৈশ্বিক মহামারী রূপ নেয়। এই রোগের উৎস চিহ্নিত হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। এবং বলা হয়, মশক নিধনই প্রতিরোধের প্রধান উপায়। ১০০ বছর পরেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একই দাওয়াই দিচ্ছে। বলছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধনের বিকল্প নেই। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা গাইডলাইনও তৈরি করেছে। ওই গাইডলাইন ফলো করে পশ্চিমবঙ্গ সুফল পেয়েছে। সুফল পেয়েছে কলকাতাবাসী। কিন্তু ঢাকায় সেই গাইডলাইন অনুসরণ করা হচ্ছে না। এক কথায়, ঢাকাসহ বাংলাদেশে মশক নিধন কার্যক্রমে গলদ আছে। অন্যদিকে এডিস মশা প্রতি বছর দ্বিগুণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বংশবৃদ্ধি করছে।
বাংলাদেশের জন্য ভারতে যেতে করোনার মতো ডেঙ্গু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে ভারত সরকার।
উল্লেখ্য, এটা মূলত বর্ষার সময়ের রোগ। বর্ষাকালে নারিকেলের খোল, ঘরের টব, নির্মাণাধীন বাড়িতে জমা পানিসহ বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার জন্ম হয়। আর এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে।
ভাগ্য ভালো ডেঙ্গু করোনার মতো ছোঁয়াচে নয়। ছোঁয়াচে হলে কি যে হতো তা বোঝার জন্য একটু চোখ বন্ধ করলেই যে কেউ শিউরে উঠবে। কারণ এই মৌসুমে আক্রান্ত এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি।
আজ থেকে দেড়শ বছর আগে ১৮৭২ সালে কলকাতা শহরে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এবং কলকাতা শহরে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। এতে পুরো শহরে আতঙ্ক দেখা দেয়। বিশেষ করে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও পরিবারে।
সেসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ডেঙ্গুর বিপদ থেকে বাঁচতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে শহর থেকে অনেক দূরে গঙ্গার ধারে তাদের পরিচিত দুজন জমিদারদের বাগানবাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ১২ বছর। কবিগুরু তার স্মৃতি কথায় এই তথ্য জানিয়ে গেছেন।
দীর্ঘ বছর পর স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকার ধনীরা আগামী বছরগুলোর বর্ষার মৌসুমে কয়েক মাসের জন্য ঢাকা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিবে। এটা কম বেশি হলফ করে বলা যায়। এমনিতেও ধনীরা বছরের বিভিন্ন সময় বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে বের হয়। আগামীতে এই প্রমোধ ভ্রমণের সময় নির্ধারণ করবে ডেঙ্গুর মৌসুম দেখে। এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রশ্নটা বাঁচা-মরার।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক