রোদের তাপে জনজীবন এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গরমের প্রভাব পড়ছে আমাদের শরীর ও ত্বকে। এই সময়টা নিজের এবং ত্বকের বাড়তি যত্ন নেওয়া উচিত। নীলাঞ্জনা নীলার প্রতিবেদনে জেনে নেওয়া যাক তীব্র গরমে কিভাবে ত্বকের যত্ন নেওয়া যাবে।
গরমে ত্বকের সমস্যা
ব্রণ: গরমে অতিরিক্ত ঘাম হয়। ফলে রোমকূপ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া গরমে ত্বক থেকে অতিরিক্ত সিবাম নিঃসৃত হয়। এ কারণে গরমের সময় ব্রণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত মুখে ব্রণ উঠে থাকে। তবে গরমে পিঠ, কাঁধ, পেট বিভিন্ন স্থানেও ব্রণ উঠে। এসব ব্রণ অনেক সময় ব্যথাযুক্ত হয়ে থাকে।
ছত্রাক সংক্রমণ: কিছু ছত্রাক মানব দেহে ইনফেকশন সৃষ্টির জন্য দায়ী। গরমের সময় এসব ছত্রাক বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের সংক্রমণ দেহের যেকোনো স্থানেই হতে পারে। ইনফেকশনের ফলে লালচে ভাব, ফোসকা, জ্বালা ভাব, চুলকানি ইত্যাদি নানা ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। ছত্রাক সংক্রমণ ছোঁয়াচে রোগ। দেখা যায় পরিবারের একজনের হলে খুব সহজেই তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কখনও এই ইনফেকশন জটিল আকার ধারণ করে। গরমে অনেক বেশি ঘেমে গেলে এবং ঘামে ভেজা পোশাক পরে থাকলে ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে। তাছাড়া আবহাওয়া উষ্ণ থাকার কারণে খুব সহজেই শরীরে সংক্রমণ ঘটতে পারে।
ত্বকে পোড়া দাগ: কড়া রোদে সরাসরি গেলে ত্বকে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়তে পারে, অনেক সময় লাল হয়ে তা ফুলে যায় ও ব্যথা করে। সরাসরি সূর্যের আলো ত্বকের উপর পড়লে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে অবহেলা করেন। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ত্বকের। ঘাম ও সরাসরি সূর্যের আলোর প্রভাবে ত্বকে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়ে থাকে। ত্বক পুড়ে গেলে সেখানে র্যাশ ও চুলকানির মতো সমস্যা হতে পারে। র্যাশ ও সান বার্নের ফলে জ্বর কিংবা বমির মতো সমস্যাও হয়ে থাকে। ত্বকের এই পোড়া ভাব বছরের যেকোনো সময়ে হলেও গ্রীষ্মে এর প্রবণতা বেড়ে যায়।
৪. এলার্জি: কিছু মানুষ সারা বছরই এলার্জির সমস্যায় পড়লেও গরমের সময় এর প্রবণতা বাড়ে। এর কারণ অতিরিক্ত তাপ ও তার ফলে সৃষ্ট হওয়া ঘাম। এছাড়া গরমকালে যেকোনো পণ্য ও মেকআপ সামগ্রী অসচেতন ভাবে ব্যবহার করলেও এলার্জি সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রীর রাসায়নিক পদার্থ সূর্যালোকের উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া করে। এছাড়া গরমের মধ্যে পানি কম খাওয়া ও অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার কিংবা জাংক ফুডের কারণেও শরীরের এলার্জি হতে পারে। দেখা যায় কিছু খাবার খেলে হয়তো সারা বছর তেমন সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু তীব্র গরমে খেলে ত্বকে র্যাশ কিংবা এলার্জির সমস্যা হচ্ছে।
ত্বকের রুক্ষতা: প্রচলিত ধারণা গরমকালে সবার ত্বক তৈলাক্ত ও তেলচিটে হয়ে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে আবহাওয়া আর্দ্রতা হারায় বলে অনেকের ত্বক তখন রুক্ষ ও মলিন হয়ে যায়। কারো কারো ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয় এবং চামড়া খসখসে হয়ে যায়। শুধু মুখ নয় পুরো শরীরের ত্বক তখন রুক্ষ হতে পারে। গরমকালে ঘাম হয় ফলে শরীর থেকে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। শরীরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু অনেক সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা হয় না। ফলে শরীর ভেতর থেকে হাইড্রোডেড না থাকার ফলে ত্বক রুক্ষ হয়ে পড়ে।
গরমে ত্বকের যত্ন
গরমে ত্বকের সমস্যা থেকে রেহাই পেতে প্রথমে সচেতন হতে হবে আমরা যেসব পণ্য ব্যবহার করছি সে বিষয়ে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে ফেলা উচিত ব্যবহার করা পণ্য, যা অনেকেই করেন না। কারণ সব পণ্য সব ঋতুর জন্য মানানসই নয়। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় স্কিন কেয়ার পণ্য ময়েশ্চারাইজার। অনেকেই মনে করেন ময়েশ্চারাইজার গ্রীষ্মকালে ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয় বারোমাস।
গরমে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দেখতে হবে তা অয়েল ফ্রি কি না। অয়েল বেইজড ময়েশ্চারাইজার গরমকালে ব্যবহার করার ফলে ত্বক আরো তৈলাক্ত হয়ে যাবে। এতে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিবে। গরমের জন্য উপযুক্ত একটি ময়েশ্চারাইজার বেছে নিলে ত্বকের তৈলাক্ত ভাব নিয়ন্ত্রণে থাকবে ও ত্বক ময়েশ্চারাইজ থাকবে। স্কিন কেয়ারে অনেকেই এড়িয়ে যান টোনার। কিন্তু টোনার ত্বকে পিএইচ লেভেল ব্যালেন্স করে এবং ত্বক হাইড্রাইডেড রাখতে সাহায্য করে। তবে গরমে ব্যবহার করা টোনারটি যাতে জেইল বেইজড হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গরমে নিত্যদিনের বন্ধু করে নিতে হবে সানস্ক্রিনকে। সরাসরি রোদে যাবার আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। সানস্ক্রিন সূর্যের ক্ষতিকারক আলো থেকে ত্বককে রক্ষা করে। এছাড়া সানস্ক্রিন ত্বকে বলিরেখা পড়তে বাধা দেয়।
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করে ত্বকের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আপনি ঘরোয়া বিভিন্ন সহজ পদ্ধতিতেও ত্বকের যত্ন নিতে পারেন। যেমন শসা ও টমেটোর রস হতে পারে প্রাকৃতিক টোনার। শসা কিংবা টমেটোর রস বের করে তা ফ্রিজে কিছুক্ষণ রেখে ঠান্ডা করে একটি তুলা দিয়ে পুরো মুখে লাগিয়ে নিন। এরপর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর তা ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। গরমকালে ছত্রাক সংক্রমণের প্রবণতা খুব বেশি বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে কাঁচা হলুদ কিংবা নিম পাতা বাটা। কাঁচা হলুদ এবং নিমপাতা ছত্রাকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। কাঁচা হলুদ বেটে তা সরাসরি মুখ এবং দেহের অন্যান্য স্থানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গোসল করে ফেলুন। এতে চুলকানির সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা কমে যাবে। পোড়া দাগ কমাতে ব্যবহার করা যেতে পারে আলুর রস কিংবা আলু কিউব করে কেটে মুখে ঘষলেও পোড়া দাগ অনেকটা কমে যায়। গরমে মুখের তৈলাক্ত ভাব দূর করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো বরফ থেরাপি। দিনের যেকোনো সময় বরফের টুকরা নিয়ে টাওয়ালে পেঁচিয়ে তা মুখে ঘসুন। এতে মুখের তৈলাক্ত ভাব দূর হবার পাশাপাশি ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। ত্বক ভালো রাখার জন্য নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার করতে হবে। এজন্য ত্বকের ধরন বুঝে ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। গরমের সময় নিয়মিত বডি ওয়াশ ব্যবহার করে গোসল করতে হবে।
তীব্র গরমে অবশ্যই লাইফ স্টাইলের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের লাইফ স্টাইলের প্রভাব ত্বকের উপরেও পড়ে থাকে। গরমের সময় যতটা সম্ভব বাইরের খাবার এড়িয়ে ঘরে তৈরি খাবার খেতে হবে। কারণ বাইরের খাবারে অতিরিক্ত তেল মশলা ব্যবহার করা হয়, যার ফলে ব্রণ হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। খাবারের তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। নিয়মিত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছের তেল, মাংস, দুধ, ডিম বিভিন্ন শাকসবজি ফলমূল ইত্যাদি খেতে হবে। এছাড়া শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পানির পাশাপাশি ডাবের পানি, ফলের রস, স্যালাইন ইত্যাদি পান করতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী