তৃণমূল পর্যায়ে জলবায়ু সুশাসন শক্তিশালীকরণে স্থানীয় জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে

তৃণমূল পর্যায়ে জলবায়ু সুশাসন শক্তিশালীকরণে টপ-ডাউন এপ্রোচের কারণে জনগণের অংশগ্রহণে সুযোগের অভাব, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। সেজন্য জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি, বটম-আপ এপ্রোচের বাস্তবায়ন এবং জেন্ডারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।আজ ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, সোমবার ঢাকার সিরডাপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দিনব্যাপী জাতীয় পর্যায়ের নাগরিক সংগঠন ওয়েভ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘জলবায়ু সুশাসন সিম্পোজিয়াম-এ বক্তারা এসব বলেন।ওয়েভ ফাউন্ডেশন এবং ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট-এর সহযোগিতায়, বাংলাদেশে তৃণমূল জনগণের অংশগ্রহণে জলবায়ু সুশাসন শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে প্রকল্পটি বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ৪টি উপজেলা ও ৩২টি ইউনিয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে এ অনুষ্ঠিত এ সিম্পোজিয়ামে প্রকল্প এলাকায় পরিচালিত একটি সামাজিক নিরীক্ষায় জলবায়ু সুশাসন শক্তিশালীকরণে তৃণমূল পর্যায়ের গ্যাপগুলো চিহ্নিত করা এবং এতে জলবায়ু পরিবর্তন, স্থানীয় উন্নয়ন, জনঅংশগ্রহণ, নীতিমালা বাস্তবায়ন ও জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য সম্পর্কিত সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি বেশকিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। দিনব্যাপী এ সিম্পোজিয়ামে বিষয়ভিত্তিক দু’টি আলোচনাসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কার্যক্রমের প্রদর্শনী এবং শেষাংশে সমগীত সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়।

দিনের শুরুতে ‘স্থানীয় অংশীদারিত্ব উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন অধিশাখা) শাহানারা ইয়াসমিন লিলি।এতেপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ (সিএসআর)-এর গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান, প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত পরিচিত ও অর্জন তুলে ধরেন ওয়েভ ফাউন্ডেশন এর উপ-নির্বাহী পরিচালক নাসিফা আলী সূচনাএবং সঞ্চালনা করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা। দিনব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য এ সিম্পোজিয়ামে আরও উপস্থিত ছিলেনবিষয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মী, স্থানীয় পর্যায়ের অংশীজন এবং যুব প্রতিনিধিবৃন্দ।

প্যানেল আলোচনায় বিশেষ অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন অধিশাখা) শাহানারা ইয়াসমিন লিলি বলেন, গ্রামে-গঞ্জে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দূর করতে সরকার তার আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। তবে নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়বদ্ধতা আছে। নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে এবং দায়িত্ব নিতে হবে। সম্মানীয় অতিথি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এর সহকারী প্রকল্প পরিচালক নাহীদ সুলতানা বলেন, দেশে সবুজায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সিআরপিডি-র প্রধান নির্বাহী মো. শামছুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু সুশানের দুটি দিক রয়েছে, একটি হলো সঠিক পরিকল্পনা এবং অন্যটি হলো বাস্তবায়ন। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু সংক্রান্ত যে সকল পরিকল্পনা রয়েছে তার সাথে আমাদের সমন্বয় করতে হবে। আমাদের মূল সমস্যা হলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য যে পরিকল্পনা তৈরি হয় তার সাথে বাস্তবায়ন টিমের সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব আছে। যার ফলে বাজেটেরও স্বদব্যবহার হয় না। এক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষ নজর দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদকে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেজ্ঞসমূহ মোকাবেলায় ন্বনির্ভর করার বিকল্প নেই। যা জাতীয় পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শিলা রাণী দাস বলেন, আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চল দূর্যোগের দিক থেকে বেশি ঝুকিপূর্ণ। তবে পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় আমাদের দেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা অনেক বেশি।

প্যানেল আলোচনার শেষে সভাপতির বক্তব্যে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীবলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জায়গা থেকে সারা পৃথিবীতে আমরা সপ্তম ভুক্তভোগী। এর জন্য যে সকল দেশের দায় বেশি, তারা তেমন দায়িত্ব নিচ্ছে না। যাই হোক, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের যতটুকু বাজেট রয়েছে, তারও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত বাজেট বৃদ্ধিকরাসহ তারযথাযথ ব্যবহার। একইসাথে কাজের জবাবদিহিতা এবংমনিটরিং সঠিকভাবে করা গেলে জাতীয় পর্যায়েও এর ভাল প্রভাবপাওয়া যাবে।

সিম্পোজিয়ামের দ্বিতীয় পর্বে ‘জলবায়ু অভিবাসন ও ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা’ শীর্ষক বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় সম্মানীয় আলোচক যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার রায়হান ফিরদৌস বলেন, ‘জলবায়ু অভিবাসন’ শব্দটা আমাদের আইনে নেই। অভিবাসন শব্দটিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। একইসাথে বৈশ্বিক পর্যায়ে ফান্ড সংগ্রহে তরুণদের প্রকল্প প্রণয়নে পরিবেশ নিয়ে কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।ওয়াটার ডট ওআরজি-দক্ষিণ এশিয়ার পোর্টফোলিও লিড আবু আসলাম বলেন,সকল মানুষের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে পরিবেশগত অনেক বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়ের সঞ্চালনায় এই বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় হেলভাটাস সুইস ইন্টারকোঅপারেশনবাংলাদেশ এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ফারহানা আফরোজ, ব্লাস্ট এর ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিসপ্লেসমেন্ট অ্যাডভাইজার আহমাদ ইব্রাহীম এবং বরগুনা ও পটুয়াখালী হতে ইউপি চেয়ারম্যান মো: শওকত হোসেন ও মাইশা ইসলাম অংশগ্রহণ করেন।

সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপিত সামাজিক নিরীক্ষার ওপর প্রবন্ধেজনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি, বটম-আপ এপ্রোচের বাস্তবায়ন এবং জেন্ডারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। জলবায়ু ন্যায্যতা এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচারের বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও কার্যকরী এবং জনগণের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলবে। প্রবন্ধে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো: ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিত ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থপনা কমিটির সভা ও ওয়ার্ড সভা আয়োজনের জন্য একটি স্থায়ী পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে জনগণ বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করতে পারে; উন্মুক্ত বাজেট সভা আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে জনগণ তাদের মতামত, চাহিদা এবং প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে; অবকাঠামোগত উন্নয়নে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে প্রকল্পগুলো স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী ভাগ করা উচিত এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা উচিত;  টপ-ডাউন এপ্রোচের পরিবর্তে বটম-আপ এপ্রোচ প্রয়োগ করা উচিত যাতে স্থানীয় জনগণের মতামত এবং প্রস্তাবনা প্রকল্পের শুরু থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়;  ত্রাণ ও সহায়তা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং প্রাপ্তি দ্রুততার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ দ্রুত সহায়তা পায়; নারী এবং প্রান্তিক জনগণের জন্য পৃথক নীতিমালা এবং প্রকল্প তৈরি করা উচিত, যাতে তাদের বিশেষ চাহিদা পূর্ণ হয়; বিশ্বাসযোগ্য ও যুগোপযোগী পুনর্বাসন নীতিমালা এবং ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে সমাজের প্রান্তিক জনগণ সঠিকভাবে সহায়তা পায়; দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর স্থায়ীত্ব এবং পরিবেশগত ক্ষতি রোধ নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ইত্যাদি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × two =