দই পাঁচালি

মাসুম আওয়াল

১.

দাওয়াতের বাড়ি লোক সারি সারি খাবারের ছড়াছড়ি,

থালার উপরে পোলাও মাংস রোস্ট খায় গড়াগড়ি।

চেটে পুটে খেয়ে ফের থাকে চেয়ে ওই দেখো মজা ওই যে,

এক লোক বলে, যাবেন না উঠে সব শেষে আছে দই যে।

কী আজব কথা খাওয়া দাওয়া শেষে দই ছাড়া কিছু জমে না,

প্যান্ডেলে লোকজন বসে থাকে দই না মিললে কমে না।

শেষে আছে দই এই ভেবে লোকে কোনো কিছু খেতে ছাড়ে না,

সংস্কৃতিটা এমন, বাঙালি দইয়ের পিছুই ছাড়ে না।

দুধ পচে দই, নেই হই চই জেনে বুঝে লোকে খাচ্ছে,

হজম করবে তেল জল নুন, শুনে খুব হাসি পাচ্ছে

খেতে ভালো লাগে অতিথি আসলে ভালো লাগে তাকে খাওয়াতেও,

দই পাওয়া যায় বগুড়া জেলায়, দই পাওয়া যায় মাওয়াতেও।

দই পাওয়া যায় রাজশাহীতেও দই পাওয়া যায় ঢাকাতে,

দই ভালোবাসে রাজা বাদশারা, ভালোবাসে মামা কাকাতে।

দই খেতে ভালোবাসে না এমন কোথাও কী আছে কেউ,

দই ইতিহাস আজ লেখা হবে আমাদের ছড়াতেও।

বাঙালির প্রিয় দই কী প্রথম দেশেই হয়েছে বানানো,

প্রিয় বন্ধুরা নড়ে চড়ে বসো সেই সব হবে জানানো।

অবাক লাগবে শুনে এই দেশে দইয়ের জন্ম হয়নি,

কবে কোন দেশে দই এলো আহা সেই কথা কেউ কয়নি!

২.

বুলগেরিয়ায় প্রথম নাকি দই হয় আবিষ্কার,

দেখতে দেখতে হয়েছে চার হাজার বছর পার।

সবাই জানে দই মানে দুধ-ব্যাকটেরিয়ার খেলা,

দইয়ের কথা জানতে জানতে কাটুক তোমার বেলা।

বুলগেরিয়ায় এক যাযাবর জাতি ছিলো ঠিক,

সেই যাযাবর জাতিটার নাম ছিলো ‘নোমাডিক’।

জন্মেছে দই বুলগেরিয়ায় তাদেরই হাত ধরে,

জন্মেছে সে নিজে নিজেই সবার অগোচরে।

দই এসেছে দারুণ রকম কাকতালীয় ভাবে,

কেউ বোঝেনি এ দই সবার ঘরে পৌঁছে যাবে।

‘নোমাডিক’দের পাত্র ছিলো চামড়া দিয়ে গড়া,

সবাই জানে চামড়া মানেই ব্যাকটেরিয়ায় ভরা।

পাত্রে রাখা দুধগুলো সব একাই যেতো জমে,

নোমাডিকদের মাথাতে হাত ব্যাবসা যেতো কমে।

ধীরে ধীরে বুঝলো ওরা নয় রে গোলক ধাঁধা,

খেতে মজা এ দুধগুলোও হোক তা জমাট বাঁধা।

বুলগেরিয়ার বিজ্ঞানি স্টামেন গ্রিগোরভ,

প্রথম দইয়ের রহস্য সে জানতে পারে সব।

নয় বেশি দিন আগের কথা উনিশশো চার সালে

দই নিয়ে খুব গবেষণা চালান আপন তালে।

তখন তিনি জেনেভাতে মেডিকেলের ছাত্র,

সঙ্গে ছিল ‘রুকাটকা’ নামের মাটির পাত্র-

এ পাত্রতে ভরা ছিলো তার বানানো দই,

এক বছরের গবেষণা তার পরে হই চই।

গ্রিগোরভ ঠিক একটা বছর গবেষণার পর,

কীভাবে দই বানানো হয় দিলেন সে উত্তর।

দুধ থেকে দই বানাতে কোন ব্যাকটেরিয়া লাগে,

কেউ জানেনি বুলগেরিয়ান গ্রিগোরভের আগে।

‘ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ’ বীজাণুটির নাম,

এই তথ্য দেন গ্রিগোরভ ঝরিয়ে মাথার ঘাম।

বুলগেরিয়ার ত্রার্নে যদি কাটাও অবসর,

দেখবে আছে দই নিয়ে এক আজব জাদুঘর!

গ্রিগোরভের কথা যেন সবার মনে থাকে,

এই জাদুঘর গড়ে রাষ্ট্র সম্মান দেয় তাকে।

বুলগেরিয়ার সব খাবারেই থাকে নাকি দই,

দই বলে যায় হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বাংলাদেশি নই।

৩.

দইয়ের বাড়ি যেখানে হোক কী এসে যায় তাতে,

এ বাংলারই বগুড়ার দই খেয়ে বিশ্ব মাতে।

দেড়শ বছর আগের কথা বগুড়ার শেরপুরে,

গড়া হলো দইয়ের রাজ্য আসবে নাকি ঘুরে!

নীলকণ্ঠ ঘোষের হাতে তৈরি হলো দই

স্বাদে গুনে আজও সে দই আছে অনন্যই।

শ্রী গৌর গোপাল পালকে চেনো নাকি কেউ

নীলকণ্ঠের রাস্তা ধরে দই বানালো সেও।

বগুড়ার নওয়াব ছিলেন আলতাফ আলী তখন,

পাশে দাঁড়ান শ্রী গৌর দই বানালো যখন।

শ্রী গৌর গোপাল পালের দোকান আজও আছে,

বর্তমানে বগুড়াতে নওয়াব বাড়ির কাছে।

তার দু’ছেলে বিমল চন্দ্র-স্বপন চন্দ্র পাল,

আজও ধরে আছেন প্রাচীন সেই দোকানের হাল।

পার্লামেন্টেও এ দই ছিলো সবার প্রিয় তখন,

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী যখন।

উনিশশো আটত্রিশে এ দই ইংল্যান্ডেও যায়,

বিদেশিরাও এ দই খেয়ে দারুণ মজা পায়।

বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন,

বগুড়াতেই দই খেয়ে তার প্রথম ভরে মন।

বগুড়ার দই গর্ব এখন সব বাঙালির জন্য

বগুড়ার দই খ্যাতির চূড়ায় এখন জিআই পণ্য।

দই কারিগর জিয়াউল হক এখন সবার চেনা,

চাঁপাইনবাবগঞ্জে করেন দইয়ের বেচা কেনা।

এমন আরও অনেক জেলায় দই তো পাওয়া যায়,

তবে দইয়ের জন্য সেরা আজও বগুড়াই।

নিজে নিজে ঘরে বসেও দই বানানো যাচ্ছে,

হাত বাড়ালেই দই বানানো মেসিন সবাই পাচ্ছে।

জানি জানি সবাই পারে বানাতে টক দই,

শোনেন তবে মিষ্টি দইয়ের রেসিপিটা কই।

দুধ চিনি আর একটুখানি দই লাগবে মিষ্টি,

মাটির পাত্রে দই জমাবেন আসলে কুটুম ইষ্টি।

প্রথমে দুধ ভালো করে ফুটিয়ে নিতে হবে,

ঘন হয়ে আসলে সে দুধ থামতে হবে তবে।

নাড়তে হবে বারে বারে সর যাতে না পড়ে,

এমন করেই দইয়ের জন্য দুধ প্রস্তুত করে।

এক বাটিতে পানি মেশান অল্প চিনির সাথে,

জ্বাল দিলে ক্যারামেল হবে রঙ হবে দইটাতে।

বাকি চিনি ঢেলে সেটা আরও ফুটিয়ে নিন,

এবারে দুধ নামিয়ে সেটা ঠান্ডা হতে দিন।

এক চামচ দই মাখান এবার মাটির পাত্র মাঝে,

ঠান্ডা করা দুধ ঢেলে দিন ডাকে পাত্রটা যে।

ভালো করে নেড়ে করুন পাত্রের মুখ বন্ধ,

কাপড় দিয়ে বন্ধ করুন রাখুন আপন ছন্দ।

দই তৈরি হতে লাগবে সাত থেকে আট ঘণ্টা,

নিজে হাতে দই বানালে ভালো হবে মনটা।

মিষ্টি মিষ্টি দইয়ের সাথে দিন কেটে যাক বেশ,

বাড়াচ্ছি না কথা আমার দই পাঁচালি শেষ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − one =