দক্ষিণ দুয়ার খোলা…

সালেক সুফী: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে খুলে গেলো দক্ষিণের দুয়ার। সুবাতাস বইতে শুরু হয়ে গাছে।  ২৫ জানুয়ারি ২০২২ দিনটি বাংলাদেশের জন্য জীবনে সোনার অক্ষরে খচিত দুর্লভ হীরকখণ্ড হয়ে থাকবে।  ২১ দক্ষিণ জেলার ৬ কোটি মানুষ সংযুক্ত হলো ঢাকা এবং সমগ্র দেশের সঙ্গে।

অনুভব করুন কাল ২৬ জুন থেকে ঢাকা-খুলনা, ঢাকা -বরিশাল যাতায়াত কত নির্বিঘ্ন হবে। কলকাতা থেকে ঢাকা যাতায়াতে কোনো ফেরি পার হতে হবে না। আর হয়তো ২ বছর পর রেলপথেও টেকনাফ, তেঁতুলিয়া থেকে পায়রা যাতায়াত করা যাবে। মংলা, পায়রা সাগর সংযুক্ত নদীবন্দর, ভোমরা, বেনাপোল স্থলবন্দর সংযুক্ত হলো সরাসরি সড়ক যোগাযোগে সারা দেশের সঙ্গে। বাঁচবে যাত্রাপথের বিড়ম্বনা, বাজবে অমূল্য শ্রম ঘণ্টা।

দিনে দিনে ঢাকা বৃহত্তর ফরিদপুর ঢাকা যোগাযোগ করা যাবে। পণ্য পরিবহনে ঝামেলা থাকবে না। ঈদ পার্বণে দক্ষিণ বাংলার মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন হবে। বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গাছে, ৩-৫ বছরের মধ্যে গ্যাস বিতরণ হবে দক্ষিণ বাংলার ঘরে ঘরে।

আমি মনে করি ৫১ বছরের স্বাধীনতায় পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সেরা অর্জন পদ্মা সেতু। ১৭ কোটি জনগণ এবং বিশেষ করে দক্ষিণবাংলার ৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের বলিষ্ট নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জাতির জনকের কন্যাকে প্রাণ খোলা অভিনন্দন।

এখন থেকে সড়কপথে ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান আর কবরস্থান পরিদর্শন অনায়াস লব্ধ হলো। যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন গ্যাস শিখা জ্বালানোর সময় উপস্থিত থাকবো। যার অনুপ্রেরণায় ১৯৭১ তরুণ বয়সে যতটুকু পেরেছি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছি,  কেমি প্রকৌশলী হয়ে গ্যাস সেক্টরের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছি। দেশ বিদেশে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছি।  এখনো নীরবে নিভৃতে থেকেও নিবেদিত থাকছি বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তায়।

দেশে আর প্রবাসে থাকা ১৭ কোটি বাংলাদেশিদের কাছে নিবেদন বাংলাদেশের গর্ব আর অহংকারের প্রতীক  পদ্মা সেতুকে নিজের ভাবুন, নিজেদের ভাবুন। বিধাতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন কার হাতে সেতুর চাবি। ইতিহাস যাদের বরণ করে নেয় তাদের কেউ দূরে রাখতে পারে না।

আজ মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় প্রয়াত ড.  জামিলুর  রেজা চৌধুরীর  কথা। মৃত্যুর আগের দিনেও ডিজিটালি সংযুক্ত হয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছেন সেতুর বিষয়ে। খুঁটিনাটি জেনেছি স্যারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে তাকওয়া মসজিদ থেকে রবীন্দ্রসরণি প্রাতঃভ্রমণ কালে। আজ অনেক ভালো লাগতো স্যার যদি প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অভিনন্দন পরামর্শক প্যানেল প্রিয় শিক্ষক ড. সামসুজ্জামান বসুনিয়া, ড. আইনুন নিশাত , ড. সফিউল্লাহ,  কেবিনেট সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ( মিলু ভাইকে) সেতু বিভাগের সচিব থাকা কালে সমন্বয় করার জন্য। অভিনন্দন বুয়েট অনুজ প্রকল্প পরিচালক, দেশে বিদেশ থেকে সংযুক্ত সকল প্রকৌশলী, কর্মবীরদের। সর্বোপরি বাংলাদেশের সকল মানুষদের।

সেতুটি নানা কারণে অন্যান্য যে কোনো সেতু থেকে ব্যাতিক্রম ধর্মী ,অতুলনীয়। শুধু ভারতের ভুপেন হাজারিকা সেতু কোন তুলনা হতে পারে না। এমনকি দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ হংকং-ম্যাকাউ (৪১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ) সেতুর সঙ্গেও। আমাজন অববাহিকার মিসিসিপি নদীতেই শুধুমাত্র পদ্মা যদি থেকে সামান্য বেশি জলপ্রবাহ হয়ে থাকে।

নদী তলদেশের এস্কয়ারিং, সেডিমেনটেশন হয় সবচেয়ে বেশি। তাই এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত নদী শাসন করতে হয়েছে। কিছু কিছু পাইল নদী তলদেশে দুবাই বুর্জ খলিয়ার থেকেও বেশি গভীরে প্রোথিত হয়েছে। ৪৫০ বছরের ভূমিকম্প ডাটা বিবেচনায় নিয়ে ৯ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প সহনীয় সেতুর জন্য প্রতিটি ১০,০০০ টন প্রয়োজনীয় সংখক ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং সংযুক্ত করা হয়েছে। সেতু এবং সংযোগ সড়কের ল্যাম্প পোস্টগুলো ২২০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত ঘূর্ণিঝড়ের দাঁড়িয়ে থাকবে।

সেতুটি দ্বিতল সেতু, উপরের তলায় সড়কপথে চলবে যানবাহন, নিচের তলায় চলবে রেল গাড়ি। সেতুতে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন, ফাইবার অপটিক্স ক্যাবল সংযোজিত আছে। সেতুর সমান্তরালে  নদী বক্ষে আছে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। দুই পারে ঢাকা থেকে জাজিরা পর্যন্ত দেশে প্রথম এলেভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে।  সেতুতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে বিপুল ক্ষতিপূরণ দেয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানের আবাসস্থল গড়ে দেওয়া হয়েছে। যদি এরপরেও সেতুটির বিশেষত্ব নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে তাদের যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত আছি।

সেতু ডিজাইন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আইকম।  একই কোম্পানি জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর, পার্ল হারবার মেমোরিয়াল সেতু, আবুধাবি বিমানবন্দর, সিডনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিঙ্গাপুর মেরিন বে ডিজাইন করেছে।

সেতুটিকে কেন্দ্র করে বিশাল  অর্থনৈতিক করিডোর করার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। ব্যাপক শিল্পায়ন হবে, বন্দরগুলো অন্তআঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে। শুধু মনে রাখতে হবে শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন যেন জনসম্পৃক্ত হয়, পরিবেশ বান্ধব হয়।

ইতিমধ্যেই ২টি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, ১৭টি বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা শুনেছি। পায়রায় বিদ্যুৎ জ্বালানি হাব বাস্তবায়নাধীন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহসাই ২০২৩ জুনের মধ্যে চালু হবে। ভোলার গ্যাস ক্ষেত্র সমূহ ২০২৬ নাগাদ জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত হবে। অচিরে গ্যাস প্রাপ্তির লক্ষ্যে শরীয়তপুরে খনন করবে বাপেক্স। ঢাকা-ভাঙ্গা রেল যোগাযোগ অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হবে। পরের পর্যায়ে রেল সংযোগ পৌঁছে যাবে যশোরে পর্যন্ত। অদূর ভবিষ্যতে বরিশাল, পটুয়াখালী রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটি মধ্যেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিপুল বিনিয়োগের জন্য অভুতপূর্ব সাড়া পড়ে গাছে। আন্তর্জাতিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। অনুরোধ করবো রাজনৌতিক বিভেদ ভুলে সবাই যেন সেতুটি নিয়ে গর্ব করে, আপন করে নেয়। কিছু মানুষের বিরোধিতা ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল। আজ তারা কালের গর্ভে হারিয়ে গাছে। আসুন আমরা বিভেদ ভুলে দক্ষিণ অঞ্চলের উন্নয়নে ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × one =