দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের ভূমিকা

ড. মো. মারুফ নাওয়াজ

একজন মানুষ যদি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কর্মমূখী শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারে তাহলে ঐ ব্যক্তি দেশের জন্য সম্পদে পরিণত না হয়ে সমাজ পরিবার তথা নিজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সে না পারে নিজের প্রত্যাশা পূরণ করতে  না পারে পরিবার সমাজ তথা দেশের প্রত্যাশা পূরণ করতে । জাতীয় অর্থনীতিতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখা তার জন্য সম্ভব হয় না । একবিংশ শতাব্দিতে এসে আর ঝিমিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়েই দক্ষ মানব সম্পদের প্রয়োজনীতা দিনদিন বেড়েই চলছে। গত পাঁচ দশকের বাংলাদেশের যাত্রায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও অদক্ষ জনবলেই মূল ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের লক্ষ এখন ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল  দেশের কাতারে শামিল এবং ২০৩১ সালের মধ্যে SDGs বাস্তবায়ন । দক্ষ চৌকষ পেশাদার জনবল গড়েতুলার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ বিণির্মানে এগিয়ে যাওয়া। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ফলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে দক্ষতায় ঘাটতি দেখা দিবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিণির্মানে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার পাশাপাশি সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ ।

সবর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী বক্তৃতা এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম; এই ডাকে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্রত নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। অবশেষে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনে গণমাধ্যমের অনেক বড়ো ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে এদেশের গণমাধ্যম অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। শুধু লেখনী আর শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নয় এদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য গণমাধ্যম কর্মী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু এদেশের গণমাধ্যম কর্মীদের রক্ত বৃথা যেতে দেননি। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এ দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রদান, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন পরিদর্শনকালে এদেশে শক্তশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ করে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার গুরুত্বারোপ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নানাবিধ পদক্ষেপের মধ্যে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট(এনআইএমসি)এর প্রতিষ্ঠা অন্যতম।

গণমাধ্যমের সঙ্গেযুক্ত কর্মীদের দক্ষজনবল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট নিয়মিত নানা রমক প্রশিক্ষনের আয়োজন করে থাকে। এনআইএমসিতে বেতার-টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও প্রকৌশল বিষয়সমূহ,তথ্য সার্ভিসের পেশাগত প্রশিক্ষণ, চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কোর্স, রিপোর্টিং এবং তথ্য ও উন্নয়ন যোগাযোগের উপর প্রশিক্ষণ পাঠ্যধারা পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া, বেসরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি যাঁরা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারেন। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, তথ্য অধিদফতর এবং গণযোগাযোগ অধিদপ্তরে কর্মরত সম্প্রচার ও যোগাযোগ কর্মীদের দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞানদানের মাধ্যমে সম্প্রচার, চলচ্চিত্র ও গণযোগাযোগ কর্মকাণ্ডের উন্নতি সাধন জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মূল উদ্দেশ্য।

প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ও চলচ্চিত্র মাধ্যমের সময়োপযোগী উন্নয়ন এ ইনস্টিটিউটের মূল দায়িত্ব। উন্নয়ন যোগাযোগকে আরও গতিশীল ও বস্ত্তুনিষ্ঠ করে তোলা এর অন্যতম কর্তব্য। সম্প্রতি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিভি ও বেতার চ্যানেল এবং কমিউনিটি রেডিও  ইনস্টিটিউটের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে, এর প্রেক্ষিত ও পরিধির গুণগত ও পরিমাণগত তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ইনস্টিটিউটের অভিজ্ঞ ফ্যাকাল্টিবৃন্দের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলি, বেসামরিক ও সামরিক আমলাগণ, বিখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ববর্গ এখানে বিভিন্ন কোর্সের সেশন পরিচালনা করে থাকেন।

সাধারণত জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন ২৭টি প্রশিক্ষণ কোর্স, প্রযুক্তিগত ও নন্দনতত্ত্বগত মিডিয়া বিষয়ে পরিচালনা করে, যেখানে কর্মকর্তা এবং মিডিয়া কর্মীরা অংশ নিয়ে থাকে। এছাড়াও জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউট নিয়মিতভাবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর বেশ কিছু সেমিনার, কর্মশালা, সভা-সংলাপের আয়োজন করে থাকে।

কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দক্ষ মানবশক্তি ছাড়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়৷ জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট গত ৪৩ বছর ধরে সরকারি, বেসরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মরত কর্মকর্তা ও মিডিয়া প্রফেশনালসদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে৷ জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বিশেষায়িত প্রক্রিয়ায় পরিকল্পিত, যাতে করে প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যথাযথ ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে সমর্থ করে তোলে৷ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, বাংলাদেশ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ভিশন-২০২১ ও ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে লক্ষণীয়ভাবে সঙ্গতিপূর্ণ৷

জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে, ২০১৬ সালে কার্যকর হওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোতে চলমান থাকবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল লক্ষ্য হলো, দারিদ্র্যমোচন ও ধরিত্রী রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে করে সকল মানুষ শান্তি ও প্রগতির মাঝে বসবাস করতে পারে। গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পন বলা হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সম্পর্কিত সমস্যার উপর আলোকপাত করে, মিডিয়া সেক্টরে অবদান রাখতে ইচ্ছুক মিডিয়ার কর্মী, কর্মকর্তাদের ধারণক্ষমতার বিকাশ ঘটাবে নিমকোর প্রশিক্ষণ৷ সর্বপরি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে ১৯৮০ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মানব সম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে আছি আমরা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে তা না হলে আমরা পিছিয়ে পড়বো। গণমাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কি মাত্রায় এ প্রভাব বিস্তার করবে তা আমরা জানিনা। গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়র কারণে অনেক জায়গায় হুমকির সম্মক্ষিন হচ্ছে। গণমাধ্যম এসব সমস্যার সমাধানে প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলাতে বাধ্য হচ্ছে এবং নতুন নতুন ফরমেটে নিজেকে বিকশিত করছে।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম কর্মীদের নিজেকে হালনাগাদ করতে হচ্ছে।  প্রযুক্তি এখানে একটি বিরাট রোল প্লে করছে। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট মূলত গণমাধ্যমের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করে তা দৃঢ়করণ এবং এ সেক্টরে আগামীর চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের চাহিদার প্রয়োজনেই গণমাধ্যম কর্মীরা নিজেদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য জাতীয়গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে সময়োপযোগী কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণ করে তাদের নিজেদের দক্ষ করে করে তুলছে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three + thirteen =