দেখবো এবার জগৎটাকে

প্রভাষ আমিন

নন্দলালের মতো মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, যারা দুর্ঘটনার ভয়ে ঘরে বসে থাকবে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মনে একেকজন পর্যটক বাস করে। যারা ঘুরে ঘুরে পৃথিবীটাকে দেখতে চায়। ইবনে বতুতা বা কলম্বাসের মতো না হলেও সৃষ্টির সৌন্দর্য্য দেখার আকাক্সক্ষা কমবেশি সবার মধ্যেই থাকে। আগের মতো পায়ে হেঁটে বা জাহাজে চড়ে আবিষ্কারের নেশায় বেরিয়ে পড়ার ঝুঁকি হয়তো এখন নেই। কিন্তু ঘুরতে গেলে পকেটে টাকা থাকতে হয়। তবে প্রথম থাকতে হয় ইচ্ছা। অন্যদের কথা বাদ দিন, বাংলাদেশের একাধিক নারী পর্বতারোহী বা পর্যটক বিশ্বের সব উঁচু পাহাড়ে চড়েছেন বা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ভ্রমণ করেছেন। তারা নিশ্চয়ই কেউ কোটিপতি নন। তা-ও ইচ্ছা ছিল বলেই ঘুরতে পেরেছেন। বেরিয়ে পড়াটাই আসল। পথে নামলেই পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

বিশ্বে পর্যটন এখন বিশাল শিল্প। বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যাদের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনের ওপর। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই; আমাদের কাছের দেশ মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাশের দেশ ভারতও পর্যটন থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন করে। সে তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বলা ভালো, পর্যটনের দিকে আমাদের নজর নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও পর্যটন বিকাশে তাদের অবদান সামান্য। বরং বেসরবকারি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশকে অনেক বেশি তুলে ধরেছেন।

দেশকে ভালোবেসে আমরা গেয়ে উঠি, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। আমরা আবেগে গাই বটে। কিন্তু কথাটা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। কিন্তু আবার এটাও তো ঠিক, মা যত গরীবই হোক, দেখতে যেমনই হোক, যার যার কাছে তার তার মা-ই সেরা। তাই আমার কাছে আমার দেশই সেরা। পাশের দেশ ভারত তো রীতিমতো ভূ-ভারত। সবকিছুই আছে তাদের ভান্ডারে। আমাদের দেশে জলপ্রপাত নেই, মরুভূমি নেই, বরফ নেই। কিন্তু আমাদের যা আছে, সেটাও কি আমরা বিশ্বের কাছে ঠিকঠাক তুলে ধরতে পেরেছি? আমাদের কক্সবাজার আছে, সেন্ট মার্টিন আছে, সুন্দরবন আছে, পার্বত্য এলাকা আছে, জালের মতো ছড়ানো নদী আছে, বিস্তীর্ণ হাওর আছে, চা বাগান আছে। আমাদের সৌন্দর্য্য একেবারে কম নেই। সমস্যা হলো পরিকল্পনায়, সমস্যা হলো সেই সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলায়।

আপনি ঠিকমতো পরিকল্পনা করতে পারলে ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা বা নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা দেখতেও মানুষ ছুটে আসবে। কক্সবাজার বা সেন্ট মার্টিনের মতো সাগরের সৌন্দর্য্য কিন্তু বিশ্বে খুব বেশি নেই। কিন্তু সেন্ট মার্টিনকে কি আমরা মালদ্বীপের কোনো একটা দ্বীপের মতো আকর্ষণীয় করে তুলতে পেরেছি? বিদেশ থেকে ছুটে আসা মানুষ কক্সবাজারে তিন ঘণ্টা সমুদ্র দেখার পর বাকি ২১ ঘণ্টা কী করবে? অনেকে ধর্মের দোহাই দেন। কিন্তু মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো ইসলামী দেশও তো পর্যটন বিকাশে শীর্ষে রয়েছে। আমাদের ইচ্ছার অভাব, পরিকল্পনার অভাব।

বিশ্বের অনেক দেশেই বিমানবন্দরে নামলেই আপনি সে দেশ সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার মতো অনেক কিছু পাবেন। দিল্লী বা মুম্বাইয়েও হোটেলে হোটেলে এতো প্যাকেজ মনে হবে কয়েকমাস ঘুরলেও শেষ হবে না। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। শুধু পুরান ঢাকাই হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য। বিশ্বের অনেকে দেশেই তাদের পুরোনো শহর সংরক্ষণ করে রাখে পর্যটকদের জন্য। আর আমরা প্রতিযোগিতায় নেমেছি ধ্বংসের। রূপলাল হাউসের মতো অসাধারণ একটি স্থাপনা এখন নাকি মশলার আড়ত। রূপলাল হাউস দেখতে মানুষ ছুটে আসবে, মশলার আড়ত দেখতে নয়। পুরান ঢাকার শাখারি বাজার বা এমন অনেক রাস্তা আছে যেখানে ঢুকলে মনে হবে এখানে ইতিহাস কথা কয়। ঢাকার কাছে সোনারগাঁও তো হতে পারে পর্যটন আকর্ষক। কিন্তু পুরান ঢাকা বা সোনারগাঁওকে চেনানোর মতো গাইড কই? পুরান ঢাকার ইতিহাস কই। বরং পুরান ঢাকাকে নতুন ঢাকা বানানোর প্রতিযোগিতা আমাদের। প্রায়ই শুনি, রাতের আঁধারে পুরোনো কোনো ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার; বাংলাদেশে কেউ নতুন ঢাকা বা পূর্বাচল দেখতে আসবে না, আসলে পুরান ঢাকাই দেখতে আসবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন ভাবনাও অনেক আকর্ষণীয় হতে পারে। কাশ্মীর গেলে আমরা সবাই ডাল লেকে হাউস বোটে রাত কাটাই। কিন্তু কাপ্তাই লেক বা ভরা হাওর কি ডাল লেকের চেয়ে কম সুন্দর। ভরা বর্ষায় উত্তাল পদ্মায় রাত কাটানোর মতো এক্সাইটিং প্যাকেজ আপনি কয়টা পাবেন। ইদানীং হাওর বা কাপ্তাই লেকে হাউস বোটে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হচ্ছে। এটাকে আরো নিরাপদ, আরো সাশ্রয়ী, আরো আরামদায়ক করতে হবে। সুইজারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছা যাদের, তারা তো সাজেকে গিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারেন। শুধু সাজেক নয়, বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় আরো কত অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য্য আছে, আমরা হয়তো জানিই না। পার্বত্য এলাকায় অনেক আকর্ষণীয় ও এক্সাইটিং ট্রেইল আছে। অতকিছু দরকার নেই, চা বাগান বা সুন্দরবন বা লাউছাড়ার বিস্তীর্ণ সবুজ সামনে রেখে বৃষ্টি দেখার মজাটাও কি কম। অথচ সৌন্দর্য্যরে আধার পার্বত্য এলাকাকে আমরা এখনও পুরোপুরি নিরাপদই করে তুলতে পারিনি। বাংলাদেশের মানুষ তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে না গিয়ে দার্জিলিং ছুটে যায়।

বাংলাদেশে পাহাড় এবং সমতল মিলে অনেক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠির বাস। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব কৃষ্টি, ঐতিহ্যবাহী খাবার ও পানীয়। সেই আদিবাসী গ্রামে বা চা শ্রমিকদের সাথে থাকাও হতে পারে পর্যটনের বিশেষ আকর্ষণ। কিন্তু আমরা তো আমাদের আদিবাসীদের স্বীকৃতিই দিতে চাই না। তাদের বিশ্বের সামনে তুলে ধরা তো অনেক পরের কথা।

বাংলাদেশের মতো ঋতুবৈচিত্র্য বিশ্বের কয়টি দেশের আছে? এখানে প্রত্যেকটি ঋতুর আলাদা রূপ আছে। আপনি প্রতিটি ঋতু আলাদাভাবে অনুভব করতে পারবেন। একজন ভিনদেশির কাছে সেই সৌন্দর্য্য কি আমরা পুরোপুরি তুলে ধরতে পেরেছি? বিদেশ থেকে আসা মানুষ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আতিথেয়তা আর সারল্যে মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে তৈরি নই।

সরকারের পরিকল্পনাহীনতা, মনোযোগের অভাব তো আছেই; নানা চেষ্টা সত্ত্বেও বেসরকারি খাত পুরোপুরি বিকষিত হয়নি। আমি খুব ঘুরেছি, তা নয়। কিন্তু অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি বাংলাদেশ অনেক ব্যয়বহুল। কক্সবাজারের হোটেল ভাড়া অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। এটা জানার জন্য আপনাকে সব জায়গায় যেতেও হবে না। ইন্টারনেটে বসেই তুলনাটা করতে পারবেন। দাম বেশি, কিন্তু সেবার মান যাচ্ছেতাই। পর্যটনের মূল সাফল্য হলো, একবার গেলে বারবার যাওয়ার আকাক্সক্ষা তৈরি হওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক জায়গা সৌন্দর্য্যে এগিয়ে থাকলেও সেবায় এতটাই পিছিয়ে থাকে, কেউ দ্বিতীয়বার যাওয়ার সাহস পান না।

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি বা সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’ গদগদ আবেগের এই গান দিয়ে আমরা পর্যটক টানতে পারবো না। এ জন্য চাই প্রয়োজনীয় নীতিমালা, সমন্বিত পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। চাই অবকাঠামো, নিরাপত্তা এবং প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলা। আমাদের দেশের অনেকেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ান পর্যটক হিসেবে। কিন্তু চলুন আগে নিজের দেশটা দেখি।

‘বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে

বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে

দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,

দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিষের উপরে

একটি শিশিরবিন্দু।

এই শিশিরবিন্দুর সৌন্দর্য্য দেখেই তো কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকটা সময়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − 10 =