দেয়ালে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

সংশপ্তক হাসান

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিল ছাত্র-জনতা। তাদের সমর্থন দিয়েছিল শ্রেণি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষজন। ফলে আন্দোলন দাউ দাউ করে জ্বলতে সময় লাগেনি। সেই আগুনে পুড়ে গেছে শেখ হাসিনার সরকার। গত পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের মাধ্যমে বিজয় হয় ছাত্র-জনতার। বিজয়ের পর তা স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল রঙিন হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের অঙ্কনে। তবে এর বিষয়বস্তু নিছক ফুল পাখি নয়। ছাত্র আন্দোলন ও নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়াই এর লক্ষ্য।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে দেয়ালে। শিক্ষার্থীরা রঙ তুলি দিয়ে দেয়ালগুলোর গায়ে এঁকেছে ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের প্রতিকৃতি। লাঠি হাতে অসীম সাহসে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা সাঈদের সে দেয়াল চিত্রে যে কারও নজর আটকে যাবে। আন্দোলনে জ্বালানির যোগান দিয়েছিল শহীদ মীর মুগ্ধর সংলাপ, পানি লাগবে কারও, পানি। সরকারের ঘাড়ে যেন তলোয়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কথাটি। বীর মুগ্ধর ছবি সমেত ডায়ালগটি দেয়ালে জায়গা নিয়েছে। শুধু রাজপথ না, সামাজিকমাধ্যমের গল্পও উঠে এসেছে। জুলাই বিপ্লবকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা সমর্থন দিয়েছেন তাদের সম্মান দেখানো হয়েছে। টকশোয়ে উপস্থাপক দীপ্তি চৌধুরী আবু সাঈদকে নিয়ে প্রশ্ন করে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন বিচারপতি মানিকের কাছে। এতে মানিক যেমন হয়েছিলেন নিন্দিত দীপ্তি তেমনই হয়েছিলেন নন্দিত। এই উপস্থাপককেও জায়গা দেওয়া হয়েছে দেয়ালে। উপস্থাপকও তাকে নিয়ে করা দেয়াল চিত্রটি শেয়ার দিয়েছেন নিজের টাইমলাইনে। এছাড়া বিভিন্ন সেøাগান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেয়ালগুলোতে। এসব সেøাগানের মধ্যে আছে ‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান’, ‘আজ থেকে মুছে ফেলো সংখ্যালঘু তত্ত্ব, সবাই মোরা বাংলাদেশি এটাই চিরসত্য’, ‘মহাকালের সাক্ষী হলো বাংলাদেশের নাম, যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে বিজয় নিয়ে এলাম’, ‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’ ইত্যাদি।

দেয়াল চিত্রে শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে অবদান রাখা সব শ্রেণির মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। বাদ যায়নি সেই রিকশাওয়ালাও। যিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন করে স্যালুট জানিয়েছিলেন হাত উঁচিয়ে। তার ছবি সড়কের দেয়ালে এঁকে দিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। নিজের প্রতিকৃতি নজরেও পড়েছে ওই রিকশাওয়ালার। দেখে বেশ আনন্দিত তিনি। উচ্ছ্বসিত হয়ে শিক্ষার্থীদের বলেছেন, মামা, এটা তো আমি। নিজেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আবিষ্কার করতে পেরে গর্বে বুকটা ভরে উঠেছে এই দেশপ্রেমিক রিকশাওয়ালার। গণ অভ্যূত্থানে সম্পৃক্তদের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি আরও বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে দেয়াল চিত্রে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উক্তিগুলো চোখে পড়ছে। কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী পংক্তি। জানা গেছে কাজটি পরিকল্পনামাফিক করছেন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রঙ তুলি নিয়ে নেমে পড়া ছাত্রছাত্রীরা শহর জুড়ে বেশ কয়েকটি টিমে বিভক্ত হয়ে দেয়াল রাঙিয়েছেন।

শিক্ষার্থীরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রঙ তুলিতে বাংলা সাজাই প্রতিপাদ্যে পুরো শহরে কয়েকটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ করছেন তারা। দেয়াল চিত্রগুলোতে অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমাজ-রাষ্ট্রের সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাক্স্বাধীনতা, সম-অধিকার থেকে শুরু করে সব রকমের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি এবং এগুলোকে প্রতিফলিত করে এমন নানান চিত্র। আছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের কথাও। শুধু সড়কের দেয়াল নয় বিভিন্ন স্থাপনায় লেখা হচ্ছে নতুন এ গণঅভ্যুত্থানের কথা। পুলিশ চেকপোস্টেও লেখা হচ্ছে ইতিহাস। তবে শুধু বাংলায় নয় আরবি ভাষাও স্থান পাচ্ছে। আরবি ভাষার ক্যালিগ্রাফি দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এরকম চিত্র দেখা গেছে বেশ কয়েকটি জায়গায়। আরবি ক্যালিগ্রাফি দিয়ে আঁকা হচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্রও। সামাজিকমাধ্যমেও প্রশংসিত হয়েছে ক্যালিগ্রাফিগুলো। পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নিয়েও হয়েছে ইতিবাচক আলোচনা। দেয়াল লিখন ও চিত্রে রয়েছে অপরাজনৈতিক সংস্কৃতিও। যদিও কেউ কেউ ভিন্ন ভাষার আগ্রাসন বলে মনে করছেন একে। তবে এমন আপত্তি ধোপে টিকছে না। ভোট চুরির চিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল চিত্র ও লিখনে। প্রহসনের নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে  ঘৃণা জানানো হয়েছে রাতের ভোটকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়াল লিখন ও অঙ্কনের কার্যক্রম চলমান।  কিশোরগঞ্জে দেয়াল চিত্র আঁকা শিক্ষার্থী আব্দুল হালিম, আশরাফ আলী সোহান, মুফতি হাসিবুল হাসান, আরেফিন ইফাজ বলেন, এই বাংলাদেশ আমার, আমাদের সবার। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই দেশকে ভালোবাসি। আমৃত্যু ভালোবেসে যেতে চাই। আগের দিনগুলোতে দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ ছিল না। যারাই দেশ সুরক্ষার আওয়াজ তুলেছেন, ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে তাদের। তারা মনে করেন নতুন এই বাংলাদেশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে সকল শ্রেণির মানুষকে। নিজেদের জায়গা থেকে যার যার মতো করে করতে হবে কাজ। জনসচেতনতা তৈরিতে সবাই মিলে কাজ না করলে প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হবে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন বিনোদন অঙ্গনের তারকারা। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া না, রাস্তায়ও সক্রিয় ছিলেন তারা। আন্দোলনের পর কেউ দাঁড়িয়েছিলেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আবার কেউ তাদের জন্য এনেছেন খাবার।  দেয়াল চিত্র অঙ্কনেও অংশ নিয়েছিলেন তাদের কয়েকজন। শহরের দেয়ালে যখন আঁকা হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস, লেখা হচ্ছে জেন জিদের কথা; তখন তা দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আগ্রহ প্রকাশ করেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী পারসা ইভানা। নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন তিনি। আগ্রহ প্রকাশ করেন দেয়াল চিত্র অঙ্কনে অংশ নেওয়ার। এরপর যোগ দেন নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি অঙ্কনে।

বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে বাসায় বসে থাকতে পারছিলাম না। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পথে নামতে চাইছিলাম। এজন্য পোস্টও দিয়েছিলাম। অবশেষে আমার ইচ্ছে পূরণ হলো। রাস্তায় নামলাম। দেয়ালে দেয়ালেও ছবি আঁকলাম। নতুন বাংলাদেশের ছবি আঁকছি। সেই দুপুর ১২টায় বেরিয়েছি, এখন বিকেল ৫টায় ফিরলাম।’ আঁকাআঁকিটা মায়ের কাছে শেখা পারসার। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতে শুরু করেন তিনি। এবার দেয়াল রাঙাতে সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়েছেন অভিনেত্রী। নতুন রঙে উত্তর নামের একটি সংগঠন থেকে রঙ তুলি হাতে নিয়েছিলেন অভিনেত্রী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই পারসা সরব ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সময়ও খাবার নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীর। দেয়াল চিত্র অংকনে তার উপস্থিতি দেখে খুশি নেটিজেনরা। প্রশংসায় ভাসিয়েছেন অভিনেত্রীকে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন রাস্তায় নেমেছিলেন অভিনেতা আরশ খান। প্রতিবাদ করেছিলেন নিরীহ ছাত্রদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। শিল্পকলা একাডেমির সামনে তার সেই উপস্থিতি নজরে পড়েছিল সবার। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলেছেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে। দেয়াল চিত্র অঙ্কনেও অংশ নিয়েছেন আরশ। নিজের ফেসবুকে সেসব ছবি প্রকাশ করে অনুসারীদের জানান তিনি। যেখানে দেখা গেছে দেয়াল চিত্র আঁকায় ব্যস্ত তিনি। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে যখন চলছে ভাঙচুর অগ্নি সংযোগ তখন সরব ছিলেন এই অভিনেতা। সহিংসতা বন্ধের ডাক দিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন, সকল ছাত্রদের প্রতি আহ্বান নিজ নিজ অঞ্চলের জানমালের হেফাজত করো ভাইয়া আপুরা। সংখ্যালঘুদের পাশে থাকো। দায়িত্ব এখনও শেষ হয়নি। শেষে লিখেছিলেন, আমরা বাঙালি। একজন বাঙালির যদি ক্ষতি হয় সেটা আমাদের দেশের ক্ষতি। লংমার্চে সবাই ছিল কোনো ভেদাভেদ দেখিনি। এখনও যেন না হয়। এছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানেও ছিলেন এ অভিনেতা। আরশের কার্যক্রম নেটিজেনদের কাছেও হয়েছিল বেশ প্রশংসিত। এভাবে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষের সম্মিলিতি প্রচেষ্টায় দেয়াল চিত্রে ফুটে উঠেছে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 − five =