দেশি ফ্যাশনে লাল-সবুজ ট্রেন্ড

ময়ূরাক্ষী সেন: চলছে স্বাধীনতার মাস। কয়েক বছর আগেও ২৬ শে মার্চ ঘিরে আলাদা কোনো পরিকল্পনা থাকত না। তবে এখন চিত্র ভিন্নরকম। এই দিনটিকে ঘিরে দেশজুড়ে থাকে নানা আয়োজন। দেশে এখন এই দিন সবাই উদ্যাপন করে দেশপ্রেম প্রকাশ করতে। বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি। যেকোনো আয়োজনই তারা নিজেদের সাজিয়ে তোলে নানারূপে। স্বাধীনতা দিবস ঘিরেও তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। এই দিনটার প্রভাব পড়ে আমাদের পোশাকে ও সাজে। পুরো দেশ সেজে উঠে স্বাধীনতার রঙে। গোটা শহর হয়ে ওঠে রঙিন আলোয় আলোকিত। সবাই জড়িয়ে নেয় পতাকার লাল-সবুজ রঙ! পথেঘাটে শিশু থেকে তরুণ সবাইকে দেখা যায় লাল সবুজের ফ্যাশনে। অনেকে আবার নতুন জামা পরে পরিবার-বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে বের হয়।

সকলের কথা মাথায় রেখে দেশের ফ্যাশন হাউজগুলো সেজে উঠে লাল সবুজের ছোঁয়াতে। ফ্যাশন ডিজাইনাররা দেশি ফেব্রিকের সঙ্গে দেশের প্রতি প্রেম নিপুণ ছন্দে যুক্ত করছেন। স্বাধীনতার এই মাসে যেকোনো ফ্যাশন হাউজে গেলেই দেখা যাবে লাল সবুজের পসরা। ঢাকার বেইলি রোড ও ওয়ারী এলাকায় এক সন্ধ্যায় ঢুঁ মারতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেল। এ বছর ফ্যাশন হাউজগুলো ঘুরে দেখা যাচ্ছে ২৬ শে মার্চ ঘিরে তাদের কালেকশনে রয়েছে অতীতের তুলনায় ভিন্নতার ছোঁয়া। পোশাক-আশাকে দেশপ্রেমের প্রকাশ চোখে পড়ার মতো। লাল সবুজ পোশাকের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধের সূর্যসন্তানদের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে।

পোশাকের মধ্যে নারীদের শাড়ি, টপস, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি, ওড়নায় ব্যবহার করা হয়েছে পতাকার রঙ। ছেলেদের জন্য জাতীয় পতাকার রঙে টি-শার্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি-পায়জামা, ফতুয়া ইত্যাদি বেশ বিক্রি হচ্ছে। শাড়ি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, কুর্তা, টি-শার্ট ইত্যাদিতে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা সেøাগান। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য বিক্রি হচ্ছে শাড়ি, ফতুয়া, ফ্রক, স্কার্টসহ নানা ধরনের পোশাক। শাড়িতে দেখা যাচ্ছে ভিন্নতা, আঁচলে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি প্রিন্ট করা হচ্ছে। এবার সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে টাই-ডাই, ব্লক, বাটিক, অ্যাপ্লিক, কাটওয়ার্ক, স্ক্রিন ইত্যাদি। মার্চ মাসে গরম আবহাওয়া থাকবে। তাই স্বস্তির কথা চিন্তা করে বেশিরভাগ পোশাক সুতি কাপড়ে তৈরি করা হচ্ছে। সুতি কাপড় পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কারণ অন্যান্য কাপড়ের তুলনায় সুতি কাপড় পরিধান করা অনেক আরামদায়ক।

সুতি জামা আকর্ষণীয় করে তুলতে দরকার নতুন আর আকর্ষণীয় ডিজাইন। সুতির উপর বিভিন্ন সুই সুঁতার কাজ করা হচ্ছে। যেকোনো উৎসবে নারীদের পছন্দের তালিকায় থাকে শাড়ি। তাই বিভিন্ন ধরনের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে দেশি ফ্যাশন হাউজগুলোতে। তাঁতের রেশম, সুতি, ঢাকাই বেনারসি, রাজশাহী রেশম, টাঙ্গাইল, পাবনা, তসর, মণিপুরী এবং কাতানসহ নানা শাড়ির মেলা। কিন্তু এবছর সবচেয়ে বেশি চাহিদা মণিপুরি ও তাঁতের শাড়ির। শাড়ির আঁচলে আঁকা হয়েছে শহিদ মিনারের ছবি কিংবা জাতীয় সংগীতের লাইন। এসব শাড়ি স্বাধীনতার মাসে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

ফ্যাশন হাউজগুলো এবছরের কালেকশনে খাদি কাপড়ের ভারী ওড়না রাখছে, ওড়নায় মুক্তিযুদ্ধের থিমের উপর কাজ করা হয়েছে। এইসব ওড়না যেকোনো পোশাকের সাথে বেশ নজর কেড়ে নেয়। কারো পোশাকে দেখা যাচ্ছে জাতীয় পতাকা, কারো পোশাকে কবিতা বা গানের লাইন, কারোবা মানচিত্র। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পোশাকে।

শাড়ির সঙ্গে বাহারি ডিজাইনের ব্লাউজ দেখা যাচ্ছে। এছাড়া লাল-সবুজ সংমিশ্রণে ব্লাউজ বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। অনেক ফ্যাশন হাউজগুলোতে সাইজ অনুযায়ী রেডিমেড ব্লাউজের কালেকশনও রয়েছে।

ছেলেদের পাঞ্জাবি কালেকশনে দেখা যাচ্ছে সুতিসহ লিনেন, হাফসিল্ক, জর্জেট, নেট, মসলিন, বলাকা সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক ইত্যাদি কাপড়। হরেক রকমের নকশা থাকলেও এবছর ছেলেদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে এক রঙের পাঞ্জাবি। কিছু ফ্যাশন হাউস বাবা-ছেলের জন্য একই রঙ ও নকশার পাঞ্জাবি তৈরি করেছে। ক্রেতাদের মাঝে এটির এখন বেশ চাহিদা রয়েছে। শপিং মলগুলো ঘুরে দেখা গেল অধিকাংশ পাঞ্জাবি তৈরি করা হয়েছে সুতি কাপড়ে।

একেক ফ্যাশন হাউজ একেক পোশাকের উপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। যেমন কোনো ফ্যাশন হাউজ নানা থিমের শাড়ি এনেছে, কেউ কাজ করেছে ফতুয়া নিয়ে আবার কেউবা টি-শার্ট। এছাড়া অনেকে কালেকশনে এনেছেন কটি, কটির ডিজাইনে ফুল। পাতা ও কাঁথা ফোঁড় সেলাইয়ের মাধ্যমে ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উৎসব যাই হোক না কেন অনেকে ক্যাজুয়াল পোশাক পরতে বেশি ভালোবাসেন। সেক্ষেত্রে ছেলেরা বেছে নিতে পারেন লাল অথবা সবুজ রঙের টি-শার্ট, মেয়েরা সুতির টপ অথবা ফতুয়া। টি-শার্ট এর উপর মানচিত্র ডিজাইন এখন বেশ ট্রেন্ডি। এছাড়া টি-শার্ট এর বুকে দেখা হচ্ছে দেশাত্মবোধক গানের লাইন, যা ক্রিন প্রিন্ট ও ব্লক প্রিন্টের মাধ্যমে বসানো হচ্ছে।

শুধু পোশাকেই থেমে নেই লাল সবুজ। দেশপ্রেমের ছোঁয়া লেগেছে অলংকারেও। নারীর যেকোনো পোশাকের সাথে চাই অলংকার। এবার দেখা যাচ্ছে সুতা দিয়ে হাতে তৈরি অলংকার। এইসব অলংকারে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রঙের সুতা। তবে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে এবার লাল সবুজ সুতা দিয়ে অলংকার বেশি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে কাঠের মালা ও চুড়ি। কাঠের উপর জাতীয় পতাকা এঁকে বানানো হচ্ছে মালা। এসব অলংকার শাড়ি, কামিজসহ যেকোনো পোশাকের সাথে খুব দারুনভাবে মানিয়ে যায়। অলংকার পাওয়া যাবে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যেই। এছাড়া অনেকেই শাড়ির সাথে মেটালের গয়নাও পরে থাকেন।

বড়দের পোশাকের পাশাপাশি ছোটদের পোশাকেও একই ধরনের ডিজাইন করা হয়েছে। ডিজাইনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পতাকার রঙ। বাচ্চাদের পোশাকে ফ্যাশনের চাইতে আরামকে প্রাধান্য দিতে হবে। ফ্যাশন ডিজাইনাররা পোশাকের ক্যানভাসে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাবা-মায়েরা তার সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে চেষ্টা করেন। বাড়ির ছোট সদস্যকে এদিন এমন পোশাক কিনে দেওয়া হয় যাতে করে সে স্বাধীনতার মর্ম বুঝে। শিশুদের পোশাকের মধ্যে রয়েছে শার্ট, পাঞ্জাবি ও ফ্রক। লাল সবুজ রঙের কাপড়ের উপর দেশি মোটিফের বিভিন্ন কাজ করা হয়েছে। শিশুদের বেশিরভাগ পোশাক আবহাওয়া ও স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে সুতি কাপড়ে করা হয়েছে। ছোটদের কালেকশনে লাল সবুজ ছাড়াও রয়েছে কমলা, বেগুনি, খয়েরি ইত্যাদি রঙ।

মগবাজার আড়ং আউটলেটে ঘুরে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা স্বাধীনতা দিবস ঘিরে নতুন কাপড় কিনতে বেশ আগ্রহী। রেবেকা সুলতানা পেশায় একজন ব্যাংকার। সারা মাস ব্যস্ত থাকেন কাজ নিয়ে। তাই স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে পরিবার নিয়ে ঘুরবেন। পরিবারের সকলকে সময় দিবেন। তাই বাসার ছোটদের জন্য নতুন কাপড় কেনাকাটা করতে এসেছেন। তিনি জানান, ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারের সাথে উপভোগ করতে চান বলেই স্বাধীনতা দিবস নিয়ে তার এতো আয়োজন। দেশপ্রেম তো বটেই কিন্তু সবার সাথে ছুটির দিনে ভালো সময় কাটানোও মুখ্য বিষয়।
প্রায় প্রতি বছরই ফ্যাশন হাউজগুলো স্বাধীনতা দিবসের থিম রাখেন পতাকার গাঢ় সবুজ আর সূর্য রাঙা লাল! আর কাপড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় সুতি কাপড়। কারণ সুতি গরম আবহাওয়ার উপযোগী আর দামেও অন্যান্য কাপড়ের তুলনায় সাশ্রয়ী। তাই স্বাধীনতা দিবসের বেশিভাগ পোশাক সুতির উপর করা হয়। লাল সবুজের ছোঁয়া থাকবে কিন্তু কাপড় হিসেবে স্থান ঠিকই সুতির। শাড়ির ডিজাইন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ হওয়ায় ভালো।

স্বাধীনতা দিবসের সাজ হওয়া উচিত সাধারণ পরামর্শ দেন রূপবিশেষজ্ঞরা। সুতির শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজের সাথে হালকা মেকআপ মানানসই। বেইজ মেকআপে মশ্চারাইজার দিয়ে ফেইস পাউডার ব্যবহারের পর গোলাপি ব্লাশন দেওয়া যেতে পারে। চোখে মোটা করে কাজল আর মাশকারা দিয়ে চোখের সাজ করা যেতে পারে। বেইস মেকআপ যেহেতু হালকা এ কারণে লাল কিংবা খয়েরি লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙানো যেতে পারে। এতে সাজ ফুটে উঠবে। কপালে লাল টিপ আর হাত ভর্তি কাচের চুড়ি সাজ আরো পরিপূর্ণ করে।

সবধরনের ক্রেতার কথায় চিন্তা করে ফ্যাশন হাউজে কাপড়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতির শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকায় মধ্যে। পাঞ্জাবি ১২০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। সালোয়ার-কামিজ ২০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা। কুর্তি ১০০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। শিশুদের যেকোনো পোশাক ৬০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে কেনা যাবে। দাম নির্ভর করছে ডিজাইন ও কাপড়ের মানের উপর। স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে তৈরি পোশাক যেকোনো দেশি ফ্যাশন হাউজে খুব সহজেই পাওয়া যাবে। যেমন বিশ্বরঙ, আড়ং, অঞ্জনস, দেশাল, রঙ বাংলাদেশ ইত্যাদি। সাশ্রয়ী দামে কিনতে চাইলে নিউ মার্কেট, গাউসিয়া, আজিজ সুপার মার্কেট, গাজী ভবন, মারুফ মার্কেট, ফরচুন ইত্যাদি জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। এছাড়া অনলাইনে বেশকিছু পেইজে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের পোশাক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eight − 3 =