দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরতে এমব্রয়ডারি

নীলাঞ্জনা নীলা

ফ্যাশনের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় না কিছুদিন পর ফিরে আসে। যেমন কিছুদিন আগেও সবাই ফিটিং পোশাক পছন্দ করতো, এখন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নিজের বডি সাইজ থেকে ২ ইঞ্চি ঢোলা ওভার সাইজ পোশাক। একটা সময় বিয়ের পোশাক মানেই ছিল লাল বেনারসি শাড়ি কিংবা জামদানি কিন্তু মাঝখানে ফ্যাশন দুনিয়াতে বিয়ের পোশাকে জায়গা করে নেয় ভারী কাজের লেহেঙ্গা। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্য করা যায় বিয়ের কনেরা এখন পুরানো ধাঁচের সাজ দিতে বেশি পছন্দ করছেন। বিয়ের জন্য তারা বেছে নিচ্ছেন লাল জামদানি কিংবা লাল বেনারসি। আবার ভারী গহনার চেয়ে এখন বিয়েতে সবাই হালকা গহনা প্রাধান্য বেশি দিচ্ছেন।

ফ্যাশনের এই আসা যাওয়া পরিবর্তনের মধ্যে একটি জিনিস প্রায় চিরস্থায়ী তা হলো সুই সুতার কাজ কিংবা এমব্রয়ডারি। যুগ যুগ ধরে ফ্যাশনে সুই সুতার কাজ লক্ষ্য করা যায়। একটা সময় গ্রাম অঞ্চলের নারীরা দুপুরের খাবার খেয়ে চুল বেঁধে বিকেলে সবাই মিলে একসাথে শাড়ি কাঁথায় সুই সুতার কাজ করতে বসতো। তাই ফ্যাশন দুনিয়ায় বরাবরই সুই সুতার কাজের উপর সবার বিশেষ আগ্রহ। কারণ এটি শুধু একটি কাজ নয় এর ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে বাঙালি নারীদের আবেগ। তবে এমব্রয়ডারির কাজ কিছুটা ভারী ও গর্জিয়াস হয়ে থাকে। এমব্রয়ডারি করার কাজে যে সুতা ব্যবহার করা হয় তাকে ভিসকস থ্রেড বলা হয়। এটি সাধারণত স্টেপল ফাইবার হতে উৎপন্ন হয়। এ ধরনের সুতার চাকচিক্য কিংবা উজ্জ্বলতা বেশ অনেকদিন থাকে।

দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো ছাড়াও যারা ওয়েস্টার্ন পোশাক নিয়ে কাজ করে সেসব ফ্যাশন হাউজগুলোতেও ঘুরে দেখা যায় এমব্রয়ডারির জনপ্রিয়তা সকল বয়সের মানুষের কাছে। সবাই এমব্রয়ডারি করা পোশাক বেছে নিচ্ছেন। এমব্রয়ডারি করার ফলে একটি সাধারণ পোশাকও অনেক বেশি রঙিন হয়ে উঠছে। ডিজাইনাররা বিভিন্ন মোটিফে এমব্রয়ডারি করে থাকেন। তবে এমব্রয়ডারির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় ফুল লতা, পাতা ও পাখি। রঙিন সুতার স্পর্শে তৈরি হয় একটি এমব্রয়ডারির কাজ। এছাড়া বিভিন্ন জ্যামিতিক মোটিফ যেমন বৃত্ত, বিন্দু, ত্রিভুজ সরল রেখারও এমব্রয়ডারি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া গতানুগতিক নকশা ছাড়াও বিভিন্ন দৃশ্য, স্থাপনা, ঐতিহ্যবাহী স্থানের এমব্রয়ডারিও করা হয়ে থাকে। তবে নিত্যব্যবহারের জন্য এমব্রয়ডারি পোশাক তেমন কেউ বেছে নিতে চান না। কারণ এমব্রয়ডারি কাজ সাধারণত একটু ভারী হয়ে থাকে। তবে হালকা কাজের এমব্রয়ডারি বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য কুর্তি, টি শার্ট কিংবা টপসে করা হয়ে থাকে।

দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো ঘুরে দেখা যায় তাদের ওয়েস্টার্ন কালেকশনে সুই সুতা কিংবা এমব্রয়ডারির কাজ করে দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে করে সবাই দেশীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে। তবে ডিজাইনারদের মতে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, পূজার মতো বিশেষ উৎসবগুলোতেই ভারী এমব্রয়ডারির প্রতি ঝুঁকে থাকে সবাই। যেসব পোশাক নিত্য ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয় সেসব পোশাকে চেষ্টা করা হয় অল্প কিছু এমব্রয়ডারি কাজ করতে। সেক্ষেত্রে হাতা কিংবা গলায় শুধুমাত্র কাজ করা হয়। এমব্রয়ডারি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রঙ। মূল পোশাকের রঙের সাথে উপরে এমব্রয়ডারি ডিজাইনে রঙের খেলা চলে। সে রঙ যত সুন্দর হয় পোশাকটি তত সুন্দরভাবে ফুটে উঠে। এমব্রয়ডারিতে রঙ ব্যবহার করার আগে ডিজাইনারদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয় যাতে অতিরিক্ত রঙের ব্যবহারে পোশাকটি বেশি হিবিজিবি মনে না হয়।

দেশের কিছু স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউসে ঘুরে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায় সকলেই গর্জিয়াস পোশাকের ক্ষেত্রে এমব্রয়ডারি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সকলেই বিশেষ দিনে একটু ভারী পোশাক পরিধান করতে চান। সেক্ষেত্রে এমব্রয়ডারি করা পোশাকের কালেকশনের প্রতি সবার আকর্ষণ বেশি থাকে। কয়েক বছর ধরে ফ্যাশনের তুঙ্গে রয়েছে সুতির পোশাক। কারণ সুতির পোশাক নিত্যদিন যেমন ব্যবহার করা যায় তেমনি আরামদায়ক। সে জন্য সুতির পোশাকের উপর এমব্রয়ডারি করা হয়, যাতে এটি যেকোনো আয়োজনে পরিধান করা যায়। সুতির পোশাক সাধারণত একটু সাদামাটা হয়ে থাকে। এই সাদামাটা ভাব দূর করার জন্য ডিজাইনাররা সুতির পোশাকে এমব্রয়ডারি করে থাকেন। ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি চাহিদা সুতির মধ্যে এমব্রয়ডারি করা পোশাক। কারণ এ পোশাক পরিধান করে যেমন স্বস্তি পাওয়া যায় তেমন ফ্যাশনেরও কোনো সমস্যা হয় না।

নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া, টপস শাড়ি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এমব্রয়ডারি কাজ লক্ষ্য করা যায়। দেশীয় ফ্যাশন ব্রান্ড আড়ং ঘুরে দেখা যায় কিছু সালোয়ার কামিজে তারা হালকা নকশা রাখলেও ওড়নায় রেখেছে ভারী এমব্রডারির কাজ। এসব পোশাকের মূল আকর্ষণ ওড়না। সুতির কুর্তিতে বুকে কিংবা হাতায় এমব্রয়ডারি লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় সালোয়ারেও করা হয় এমব্রয়ডারির কাজ। শাড়ির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় এমব্রয়ডারি, কিছু ক্ষেত্রে পুরো শাড়ি জুড়ে ভারী এমব্রয়ডারি থাকলেও আবার ভিন্নতা রাখার জন্য শুধু শাড়ির আঁচলে কিংবা কুচিতে এমব্রয়ডারি দেওয়া হয়। শাড়ির এমব্রয়ডারির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন ধরনের ফুল কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যের মোটিফ। এক্ষেত্রে আকর্ষণীয় মোটিফ এমব্রয়ডারি করে ফুটিয়ে তোলা হলে পোশাকের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। এমব্রয়ডারি বলতে অনেকে শুধুমাত্র ফুল কিংবা লতাপাতা মনে করলেও এখন ডিজাইনাররা তাদের নিজস্ব সৃজনশীলতার মাধ্যমে বিভিন্ন নকশার এমব্রয়ডারি করছেন।

এমব্রয়ডারির ধরন মূলত দুইটি। একটি হচ্ছে হাতে আরেকটি মেশিনে। এমব্রয়ডারি পোশাকের দাম কেমন হবে তা নির্ভর করছে এমব্রয়ডারিতে ব্যবহার করা সুতার মানের উপর। সাধারণত হাতের ছোঁয়ায় নিখুঁত এমব্রয়ডারির দাম মেশিন এমব্রয়ডারির পোশাকের তুলনায় বেশি হয়। সাধারণত একটি পোশাকে দুই থেকে চার রঙের সুতার ব্যবহার করতে দেখা যায় নকশার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে পোশাকের কাপড়ের রঙের বিপরীত রঙের সুতার নকশা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়। কখনও আবার একরঙা কামিজের বডিতে একই রঙের কয়েকটি শেডের সুতার কাজ করা হচ্ছে। অনেক সময় আবার পোশাকের রঙের একশেড হালকা বা গাঢ় রঙের সুতার ব্যবহারে ফুটে উঠে আভিজাত্য। সুতির পোশাক ছাড়াও জর্জেট, শিফন, সিল্ক, মসলিন কাপড়ের উপর এমব্রয়ডারি করা যায়। এমব্রয়ডারি পোশাক আরো বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য তাতে যোগ করা হয় চুমকি, স্টোন, কারচুপি, লেইস, পাইপিং ইত্যাদি।

উৎসব ভেদে এমব্রয়ডারির নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। অতিরিক্ত ভারী এমব্রয়ডারি করা হলে পোশাকের ভিতর আলাদা কাপড় ব্যবহার করা হয় যাতে পরিধান করার পর অস্বস্তিকর অনুভূতি না হয়। নারীদের পোশাক ছাড়াও ছেলেদের টি-শার্ট পাঞ্জাবিতে এমব্রয়ডারি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে এমব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবির রয়েছে অনেক জনপ্রিয়তা। তবে ডিজাইনাররা জানান এ যুগে তরুণরা খুব ভারী এমব্রয়ডারির পাঞ্জাবি পছন্দ করেন না। তারা সাধারণত গলায় কিংবা হাতায় হালকা নকশার এমব্রয়ডারি পছন্দ করেন। চাহিদার কথা চিন্তা করে ডিজাইনাররা এমব্রয়ডারি করে থাকেন।

শুধু যে পোশাকে এমব্রয়ডারি করা হয় তা নয় ব্যাগ, জুতা এমনকি সুটকেসেও এখন এমব্রয়ডারি করা হয়। লেদার, ভেলভেট কাপড়ের ব্যাগ আরো বেশি নজরকাড়া করে তোলার জন্য এসব ব্যাগে মেশিন কিংবা হাতের কাজের এমব্রয়ডারি করা হয়। জুতার মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় ফুল কিংবা পাখির বাহারি এমব্রয়ডারি। যেকোনো ফ্যাশন হাউজেই এমব্রয়ডারির কালেকশন পাওয়া যায়। এ ছাড়া অনেকে শখের বসে এমব্রয়ডারি শিখে নিজের পোশাকে নিজেই এমব্রয়ডারি করে থাকেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 4 =