দ্রৌপদীর হাত ধরে এসেছে ফুচকা

হাসান নীল

পান্ডবদের নির্বাসিত দিনের কথা। বনবাসে থাকাকালীন পঞ্চ পাণ্ডবের স্ত্রী হয়ে এসেছিলেন দ্রৌপদী। শ্বশুর বাড়ি এসেই রান্নার ভার পড়ে তার ওপর। নির্বাসনের দিনগুলোতে স্বল্প কিছু দিয়েই নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতেন পাণ্ডবরা। এই সুযোগে পরিকল্পনা আটেন পাণ্ডব মাতা কুন্তী। সীমিত যোগাড় যন্ত্র দিয়ে সংসার কতটা সামলাতে পারবেন দ্রৌপদী তা যাচাই করে নিতে চাইলেন। পরিকল্পনামাফিক আগের দিনের বেঁচে যাওয়া সামান্য কিছু আলু সবজি ও ময়দার ময়ান তুলে দিলেন নববধূর হাতে। বললেন যা আছে তাই দিয়েই যেন সবাই পেট ভরে খেতে পারেন। ওদিকে দ্রৌপদী ছিলেন পাকা রাঁধুনি। ফলে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। বুদ্ধি খাটিয়ে ময়দার ময়ানগুলোকে সমানভাগে গোল গোল করে ভাগ করলেন। তার ভেতরে ভরে দিলেন আলুর সবজি। এরপর উনুনে চাপালেন কড়াই। ভর্তি করলেন তেলে। ফুটতে শুরু করতেই ছেড়ে দিলেন গোল করে রাখা ময়দার খামিগুলো। ডুবো তেলে মুহূর্তেই তা ফুলেফেঁপে  উঠল। ভাজা শেষে উনুন থেকে নামিয়ে সমান ভাগে ভাগ করে দিলেন তা পাঁচ পাণ্ডব ও মাতা কুন্তিকে। শাশুড়ি ও পাঁচ স্বামীর দারুন পছন্দ হলো খাবারটি। পেট পুরে খেলেন তারা। কুন্তি এতটাই আনন্দিত হলেন নববধূর হাতের খাবারকে এই বলে বর দিলেন যে আলু সবজির পুর দিয়ে তৈরি এই খাবারটি অমরত্ব লাভ করবে। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে উপমহাদেশের মানুষের কাছে ফুচকার জনপ্রিয়তা যেন তারই প্রমাণ। প্রাচীন উপকথানুযায়ী এভাবেই মহাভারতের দ্রৌপদীর হাত ধরে উৎপত্তি হয় মুখরোচক খাবার ফুচকার।

পানি জীবাণুমুক্ত করতে ফুচকার মশলা

তবে সবাই উপকথায় ভরসা পান না। ফুচকার উৎপত্তি নিয়ে তাদের রয়েছে দ্বিমত। কারো মতে যমুনা নদীর পানি জীবাণুনাশক করতে ফুচকার উৎপত্তি। ঔপন্যাসিক জ্যাক ও’ইয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ফুচকার মসলা জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তিনি তার ‘ডাইজেস্টিং ইন্ডিয়া: আ ট্র্যাভেল রাইটারস সাবকন্টিনেন্টাল অ্যাডভেঞ্চারস উইথ দ্য টামি’ বইয়ে বলেছেন মধ্যযুগে যমুনার নদীর পানি ছিল দূষিত। একে বিভিন্ন রোগের বাহক ও কারণ বলে মনে করা হতো। যমুনার পানি থেকে নিস্তার পেতে দিল্লির রাজ পরিবারের চিকিৎসক এক ধরনের ডায়েটের ধারণা দেন। যা ছিল মসলা সমৃদ্ধ। ঐ দূষিত পানির জীবাণুনাশক হিসেবে তৈরি ওই মসলা সমৃদ্ধ ডায়েটকেই আমরা আজ ফুচকার মসলা হিসেবে জানি।

উৎপত্তিস্থল নিয়ে দ্বিমত

ফুচকার উৎপত্তিস্থল নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। কারও মতে দক্ষিণ বিহারের মগধে ফুচকার উৎপত্তি। এটি মূলত ছিল পানিপুরি। যা ফুচকার আরেকটি সংস্করণ। আবার কেউ কেউ মনে করেন বারানসি থেকেই প্রথম উদ্ভব হয় ফুচকার। এর পেছনে শক্ত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জার্নাল অব ইন্ডিয়া ফুচকার যে বিশদ বিবরণ দিয়েছে সেখানে বারানসিকেই এর আঁতুর ঘর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এই তথ্য হেলায় ফেলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে উৎপত্তিস্থল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ফুচকা যে ভারতীয় খাবার এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ফুচকার ইতিহাস

অনেকের মতে প্রাচীনকাল থেকেই ভোজনরসিকদের সঙ্গে ফুচকার সম্পর্ক। সে কথা লেখা আছে প্রাচীন গ্রিসের পর্যটক মেগাস্থিনিসের লেখা বইয়েও। ইন্ডিকা নামের সে বইয়ে ফুচকার উৎপত্তি কাল নিয়ে লিখেছেন তিনি। জানা যায়, আজ থেকে ২১০০ বছর আগেও ফুচকা খাওয়া হতো। তবে সে ফুচকার চেহারা এখনকার মতো ছিল না।

সময়ের সাথে পরিবর্তন

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার লুচি। এই খাবারের মিশে আছে তাদের আবেগ। ফুচকাকে লুচির ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে দাবি করা হয়। লুচির এই ছোট সংস্করণকে সে সময় মচমচে করে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছিল। ওই জায়গা থেকেই মূলত ফুচকার উৎপত্তি। এদিকে মোগলদের ভোজন রসিকতা নিয়েও আলাদা গল্প রয়েছে। ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা খাবার মোগলদের রসুই ঘরে গিয়ে অন্যরূপ পেয়েছে। হয়েছে পরিবর্তিত কিংবা পরিবর্ধিত। ভারতীয় খাবার ফুচকার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মোগলদের সংস্পর্শে এসে এর যেমন গঠনগত পরিবর্তন হয়েছে। শক্ত লুচি পরিণত হয়েছে মসলাদার কুড়মুড়ে ফুচকা ও পানিপুরিতে।

নামের ভিন্নতা

ফুচকার বিভিন্ন সংস্করণের মতো রয়েছে নামের ভিন্নতা। অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। কেউ ডাকে গোলগাপ্পা কেউ ফুলকি। কেউ কেউ টিক্কি, পানিকে বাতাসে বলেও সম্বোধন করে থাকে। এছাড়া গুপচুপ, বাতাসি পাকারা পানিপুরিসহ অনেক নাম রয়েছে। নামকরণের গল্পগুলোও বেশ কৌতুহল জাগায়। এই যেমন গোলগাপ্পা। গাপ্পা অর্থ মুখ। গোল একটি ফুচকাকে এক গাপ্পায় অর্থাৎ মুখে পুরে নেওয়া যায় গোলগাপ্পা বলা হয়। পাকিস্তান, নয়াদিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশেও এই নামে ডাকা হয় ফুচকাকে। তবে তেলেঙ্গানা, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, হায়দরাবাদের অনেক অঞ্চলে এটি গুপচুপ বলে পরিচিত। বাংলাদেশের মতো নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও বেশ জনপ্রিয় ফুচকা। তবে সেখানে আদি নাম ফুলকিতেই পরিচিত। ফুচকাকে পানিপুরি বলারও রয়েছে কারণ। ফুচকার ভেতর টক ঝাল মিষ্টি পানি দিয়ে খাওয়া হয় বলেই একে পানিপুরি বলা হয়। তবে পানিপুরির আগে একে ফুলকি নামে ডাকা হতো।

ফুচকার সম্মানপ্রাপ্তি

আজ যেভাবে সমাদর করা হয় একটা সময় এদেশে ঠিক সমপরিমাণ অনাদরে ছিল ফুচকা। সে ১৯৪৭ সালের আগের কথা। এদেশে তখন ফুচকাকে দেখা হতো অবহেলার চোখে। সেসময় কাউকে ফুচকা খেতে দেখলে ঘটি বা কোইসা বলে তিরস্কার করা হতো। এদেশে ফুচকার কদর বাড়ে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর। ওই সময় ভারত থেকে পাট গুটিয়ে বাংলাদেশে আসা লোকদের হাত ধরেই সীমান্ত পার হয় ফুচকা। তাদের কাছে বেশ কদর ছিল এই খাবারের। তাদের দেখাদেখি এরাও আস্তে আস্তে ফুচকা ও পানিপুরির দিকে ঝুঁকতে থাকে। এভাবেই ফুচকা বেশ আদরের সঙ্গে জায়গা করে নেয় এদেশের মানুষের কাছে।

স্বাদের তফাৎ

অঞ্চল ভেদে শুধু নামকরণেই ভিন্নতা নেই ফুচকার স্বাদেও আলাদা। পার্থক্যটা বেশি দেখা যায় ফুচকার পুর তৈরিতে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উপাদানে তৈরি হয় এই পুর। জায়গা ভেদে আলুর পুর, সবজির পুর, সালাদের পুর ব্যবহার করা হয়।  ঘুঘনির পুরও দেয় কোথাও কোথাও। কিংবা কেবল টকমিষ্টি পানি ব্যবহৃত হয়। তবে অনেকে আছেন ঝালপুর এড়িয়ে চলেন। সে কারণে কোনো কোনো এলাকায় মিষ্টি জাতীয় পুর ব্যবহার করা হয়। অনেক স্থানে তেতুল পানির পরিবর্তে ধনিয়া পাতার চাটনি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পুদিনা মিশ্রিত পানি, লেবু পানি কিংবা মিষ্টি খেজুর পানিও ব্যবহার করা হয়। তবে আমাদের দেশে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দুই ধরনের ফুচকা। এর একটি হলো দই ফুচকা। এটি টক দই দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এরমধ্যে নানা রকম বুট চানাচুর মেশানো থাকে। এছাড়া মিষ্টি পাপড়ের সঙ্গে বাদাম কুচিও দেওয়া হয়। আর তেতুল পানির পরিবর্তে দেওয়া হয় টক মিষ্টি দই। অন্যটি হচ্ছে তেতুল পানিসহ ফুচকা।

মন ভালো করে ফুচকা

ফুচকা শুধু আড্ডা জমায় না কিংবা নাস্তার কাজই করে না। মন ভালো করতেও বেশ পটু টক মিষ্টি ঝাল এই খাবার। তথ্যটি হেলায় ফেলানোর উপায় নেই। কেননা গবেষকদের কথা। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে ফুচকার স্বাদ খুব দ্রুত মুখের টেস্ট বাডগুলোতে সঞ্চারিত হয়। যার কারণে মন খারাপ থাকলে তা সহজেই ভালো হয়ে যায়।

আছে ফুচকা গ্রাম

ফুচকার নামে গোটা একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে নয়। এটি ভারতে। সেখানকার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় ‘ফুচকা গ্রাম’ নামে একটি গ্রাম রয়েছে।

তরুণদের মন জয় করা স্ট্রিট ফুড

দেশের শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় রাস্তাঘাটের খাবার-দাবারের মধ্যে এর আধিপত্য স্পষ্ট। দুকদম এইগুলোই দেখা যায় ভ্যানে বা ছোট টং দোকানে ফুচকা বিক্রি করে সারতে পারছেন না দোকানে। আর ক্রেতাদের লাইনে অধিকাংশই স্কুল কলেজ পড়ুয়া তরুণ তরুণীদের ভিড়। এ থেকে বোঝা যায় সব ধরনের মানুষের কাছে প্রিয় হলেও তরুণ সমাজের কাছে বেশি সমাদৃত ফুচকা।

মন জয় করেছে বিদেশিদের

উপমহাদেশের সীমানায় বাধা নেই আর ফুচকা। এর পেছনে অবদান রয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাঁধুনি কিশোয়ার চৌধুরীর। তিনি ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতায় জিততে কিশোর বেছে নিয়েছিলেন দেশি খাবার। এরমধ্যে ফুচকাও ছিল। তার নিজস্ব ধারায়  তৈরি ফুচকা পরিবেশনের পর মন জয় করে নিয়েছিল বিচারকদের। বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। এছাড়া সিএনএনের ট্রাভেল বিভাগে ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট কেট স্প্রিঙ্গার লিখেছেন, ‘একটু মিষ্টি, একটু টক, একটু ঝাল ফুচকা বাংলাদেশের পথেঘাটে সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া খাবার। ভারতে যেটি পানিপুরি, গোলগাপ্পা বা গুপচুপ নামে পরিচিত, ফুচকা সেটিরই বাংলাদেশি সংস্করণ।

‘ফুচকা’ তৈরির সহজ রেসিপি

উপকরণ

১ কাপ সুজি, ২-৩ টেবিল চামচ ময়দা, ১/৪ চা চামচ বেকিং সোডা, লবণ, তেল, পানি (ডো তৈরি করতে)

প্রণালি

সব শুকনা উপকরণ মিক্স করে নিয়ে তাতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে ডো তৈরি করুন। খেয়াল রাখতে হবে যাতে ডো খুব বেশি নরম না হয়। ডো তৈরি করার সময় তেল দিবেন না। একটি পরিষ্কার ভেজা কাপড় দিয়ে ২০-৩০ মিনিটের জন্য ডো ঢেকে রাখুন। ২০-৩০ মিনিট পর কাপড় সরিয়ে আবার একটু ময়ান করে নিন। এবার একটি রোলিং বোর্ডে আটা ছিটিয়ে নিন। একটু পাতলা করে ডো বেলে নিয়ে আনুমানিক ২ ইঞ্চি করে গোল গোল অংশে কেটে নিন। কেটে নেওয়া অংশগুলোও ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন। কেননা, শুকিয়ে গেলে ভাজার সময় ফুলবে না। এবার ডো থেকে কাটা গোল অংশগুলো ভেজে নিন। তেলে দেয়ার সাথে সাথেই ফুচকা ফুলে উঠবে এবং ফুচকায় সোনালি-বাদামি রঙ আসবে। একটি ভাজা হয়ে গেলে আরেকটি ভাজুন। একই সাথে একের অধিক ফুচকা তেলে ভাজার জন্য দিবেন না। একটি প্লেটে টিস্যু বিছিয়ে তাতে ফুচকা উঠিয়ে রাখুন।

শুধু ফুচকা

প্রথমে ২ কাপ ময়দার সাথে পরিমাণমতো পানি, লবণ ও সরিষা গুঁড়া একসাথে নিয়ে মোলায়েম ভাবে মাখিয়ে নিন।এরপর ছোট ছোট রুটির মতো বেলে নিয়ে কেটে ফেলুন এবং ডোবা তেলে ভাজুন। ফুলে বাদামি রঙ হলে উঠিয়ে রাখুন। এভাবেই শুধু ফুচকা তৈরি করা হয়।

ফুচকার পুর

৫-৬ ঘণ্টা আগে ভিজিয়ে রাখা মটরের ডাল ও কুচি করে কাটা আলুর সাথে ২ টেবিল চা চামচ করে আদা বাঁটা, রসুন বাঁটা, জিরা বাঁটা, গরম মশলা বাঁটা নিয়ে তেল দিয়ে ভালো করে রান্না করুন। এরপর রান্না করা ডালের সাথে ভাজা শুকনা মরিচের গুঁড়া, চটপটির মশলা, পেয়াজ কুচি, তেতুলের টক দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে পুর তৈরি করুন।

তেতুলের টক

১ ঘণ্টা আগে ভেজানো তেতুলের সাথে কুচি করে কাটা ধনে পাতা, কুচি করে কাটা কাচা মরিচ ও বিটলবণ দিয়ে ভালো করে চটকিয়ে নিলেই হয়ে যাবে তেতুলের টক।

এবার কাজ খুবই সহজ। ভাজা ফুচকার ভিতর পুর ভরে ফুচকা তৈরি করুন এবং আলাদাভাবে টক দিয়ে পরিবেশন করুন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − five =