রোজ অ্যাডেনিয়াম
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে, ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/ আমি গান গাহি আপনার দুখে, তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে, আলেয়ার মত ডাকিও না আর, নিশীথ অন্ধকারে।/ কাজী নজরুল ইসলাম তার প্রথম স্ত্রী নার্গিসের একটি চিঠির উত্তরে এই গান লিখেছিলেন। অনুধাবন করা যায় গানটির মাঝে এক করুণ গল্প লুকিয়ে আছে। কী সেই গল্প? নার্গিসকে ঘিরে কী ঘটেছিল কবির জীবনে। নার্গিস ও কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে। সব মিলিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে এখনো এক রহস্যময় অধ্যায়। নানাজনের নানা মত এই বিয়ে নিয়ে। এবার সিনেমায় উঠে আসছে সেসব। সিনেমাটি নির্মাণ করছেন কলকাতার পরিচালক আবদুল আলিম। সম্প্রতি সিনেমাটির নায়ক-নায়িকা ও কলাকুশলীদের নাম প্রকাশ করেছেন পরিচালক।
কে হচ্ছেন রহস্যময়ী নার্গিস
নার্গিসের চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছেন ইতিমধ্যেই জেনেছেন দর্শক। এই চরিত্রটিতে অভিনয় করতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অর্চিতা স্পর্শিয়া। কাজী নজরুল ইসলামের বায়োপিক দিয়ে টালিউডে যাত্রা শুরু হচ্ছে তার। সম্প্রতি গণমাধ্যমে অভিনয়ের খবর নিশ্চিত করেছেন স্পর্শিয়া নিজেই। স্পর্শিয়াকে সর্বশেষ দেখা গেছে সফিকুল আলমের ‘সুস্বাগত’ সিনেমায়। ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ শিরোনামে বায়োপিকটি বানাবেন আবদুল আলিম। এই সিনেমা দিয়েই প্রথমবার পরিচালকের আসনে বসবেন তিনি।
এক নজরে স্পর্শিয়া
দীর্ঘ সময় ধরেই মিডিয়াতে পথচলা স্পর্শিয়ার। একই সঙ্গে তিনি বিজ্ঞাপনের মডেল ও অভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয়। স্পর্শিয়া তার অভিনয়জীবন শুরু করেন ‘প্যারাসুট’ তেলের বিজ্ঞাপনের অভিনয় দিয়ে। ‘বন্ধু তিন দিন’ শিরোনামের সেই বিজ্ঞাপনটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এরপর এয়ারটেলের কিছু বিজ্ঞাপনের মডেল হন তিনি। ছোটপর্দার নাটকের জন্যও ডাক পেতে শুরু করেন। এয়ারটেল পরিচালিত ‘ইম্পসিবল ৫’ এ অভিনয় করে ২০১৩ সালে সবার মন জয় করে নেন। বিটিভিতে বিবিসির ‘উজান গাঙ্গের নাইয়া’তে অভিনয় করেও সবার নজর কাড়েন। বেশকিছু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন স্পর্শিয়া। দেখার বিষয় নার্গিসের চরিত্রে কেমন অভিনয় করেন এই অভিনেত্রী!
আরও যারা থাকছেন
বায়োপিকটি প্রযোজনা করছে জেবি প্রোডাকশন। কাজী নজরুলের চরিত্রে অভিনয় করবেন কিঞ্জল নন্দ। ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছেন অভিনেতা। নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ইশা সাহাকে। এ ছাড়া আরও থাকছেন শেরেবাংলা ফজলুল হকের ভূমিকায় খরাজ মুখোপাধ্যায়, বিরজা সুন্দরী দেবীর চরিত্রে কাঞ্চনা মৈত্র। বাংলাদেশি অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবুকে দেখা যাবে আলী আকবর খানের ভূমিকায়। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন সৌগত বসু, সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন জয় সরকার।
কে এই নার্গিস
নার্গিস ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরের আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে। নার্গিসের বাবার নাম আব্দুল খালেক মুন্সি আর মায়ের নাম আসমতের নেছা। তার পৈতৃক নাম ছিল সৈয়দা খাতুন। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় তিনি তার মামার বাড়িতে থাকতেন। খাঁ বাড়ি থেকে একটু দূরেই মুন্সিবাড়ি। সেখানকার জব্বার মুন্সির সাথে নজর আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খানমের বিয়ে ঠিক হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে সে বিয়েতে দাওয়াত করা হয়। এখানে এসেই নার্গিসের সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের।
নার্গিস নামটি নজরুলের রাখা
১৯২১ সালে নজর আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খানমের বিয়ের অনুষ্ঠানে নজরুল পরিচিত হন এক তরুণীর সঙ্গে। যার নাম সৈয়দা খাতুন। কাজী নজরুল নাম পাল্টে ইরানের বিখ্যাত ফুলের নামে রাখলেন নার্গিস। নার্গিস সম্পর্কে কবি লিখেছেন ‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোনো নারীর কাছে হইনি।’ নজরুলের গান, কবিতা, গল্প, বিদ্রোহ নিয়ে। ভালোবাসেন মানুষ। কিন্তু নার্গিসের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। একদিন নজরুলকে এসে শুধান, ‘গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি’। এই পরিচয়ের পরই নজরুল সেই নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। তার আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকে।
বিয়ের রাতেই পলায়ন
১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় শুক্রবার কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য হয়। সেদিন বিয়ের আকদ সম্পন্ন হলেও কাবিনে ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। নজরুল বাসর সম্পন্ন না করেই নার্গিসকে ছেড়ে দৌলতপুর ত্যাগ করে রাতেই কুমিল্লা চলে আসেন। জানা যায়, বৃষ্টি ভেজা রাতে কর্দমাক্ত রাস্তায় ৪০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বীরেন্দ্র কুমারকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল কুমিল্লা এসে কিছুকাল অবস্থান করেন। পরিশ্রম ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ। তারপর বন্ধু মোজাফ্্ফর আহমেদ এসে তাকে কলকাতায় নিয়ে যান। দৌলতপুর ছাড়ার পর নজরুল আরো কয়েকবার কুমিল্লায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। দৌলতপুরে এসে সেখানকার মনোরম পরিবেশে অবস্থান করে কবি বহু কবিতা ও গান কবিতা লিখেছেন। নজরুল গবেষকদের মতে তিনি এখানে কবিতা লিখেছেন ১২০টি এবং গানইলখেছেন ১৬০টি। উল্লেখযোগ্য কবিতা হচ্ছে – বেদনা অভিমান, অবহেলা, অনাদৃতা, পথিকপ্রিয়া, বিদায় বেলা। এছাড়াও রয়েছে হার মানা হার, হারামণি ও বিধুরা।
নার্গিসের দীর্ঘ অপেক্ষা
নজরুল দৌলতপুর ছেড়ে গেলেও নার্গিসকে ভুলতে পারেননি। তার লেখা একটি চিঠিতে তা অনুধাবন করা যায়। চিঠিতে তিনি লিখেছেন ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা, কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি। তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না। ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’ নার্গিসও ভুলতে পারেননি নজরুলকে। অনেক বছর কাজী নজরুলের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তিনি।
দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। নজরুল এই গদ্যের শুরুর গানটি লিখে দেন। ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের সাত-আট মাসের মাথায় আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। আজিজুল হাকিমও বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে সমাদৃত।
নার্গিসের মৃত্যু
নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের প্রেম কাহিনী ব্যথায় ভরা। সারা জীবন নজরুলকে হারানোর বেদনা বয়ে বেড়িয়েছিন নার্গিস। মামা আলী আকবর খান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় পুস্তক ব্যবসায়ে মন দিয়েছিলেন। ঢাকার বাংলাবাজারে বাড়ি বানিয়ে নার্গিসকে ঢাকায় নিয়ে চলে আসেন। নার্গিস আবার পড়াশোনা শুরু করে। চৌদ্দ বছর পর ১৯৩৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। ৩২ বছর বয়সে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আইএ পাস করেন (ইডেন গার্লস কলেজ তখন সদরঘাটের দিকে ছিল)। নার্গিস সাহিত্য চর্চাও করেন। তার কবিতায় নজরুলকে না পাবার ব্যথা, বিরহ, একাকিনী থাকার কষ্ট ফুটে উঠতো। একাধিক উপন্যাসও লিখেছিলেন নার্গিস। উপন্যাসগুলো স্বামী কর্তৃক অবহেলিত স্ত্রীর আক্ষেপে ভরপুর। তার এমনি একটি উপন্যাস ‘তাহমিনা’। পারস্য-বীর রুস্তম কর্তৃক ফেলে যাওয়া স্ত্রী তাহমিনার বিলাপ নার্গিস সবিস্তারে লিখেছেন, লিখেছেন পুরুষ জাতির নির্দয়তা, পাষাণচিত্ততা। ‘তাহমিনা’ পড়ে নজরুল তার উত্তরে লেখেন কবিতা ‘হিংসাতুর’। নার্গিসের লেখা উপন্যাস ‘ধুমকেতু’ এবং ‘পথের হাওয়া’ও নজরুলকে উপলক্ষ্য করে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে নার্গিসের মৃত্যু হয়। এখন দেখার অপেক্ষা সিনেমায় কী রুপে হাজির হন নার্গিস!
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি