গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
লেখক নাজিম উদ দৌলা নিজের মাথায় ঘুরপাক খাওয়া গল্প আর চরিত্রগুলোকে বন্দি করেছেন কখনও বইয়ের মলাটে আবার কখনও সেলুলয়েডে। তিনি থ্রিলার লেখক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও, গত কয়েক বছরে চিত্রনাট্যকার হিসেবেও সকলের নজর কেড়েছেন। তার লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু সাড়া জাগানো সিনেমা। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমান সময়ে মেধাবী চিত্রনাট্যকারদের একজন নাজিম উদ দৌলা। ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দা সব জায়গায় নিজেকে জানান দিচ্ছেন। ওটিটি প্লাটফর্মেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি। শান, দামাল, অপারেশন সুন্দরবন থেকে শুরু করে এই ঈদে প্রেক্ষাগৃহ মুক্তি পাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’ কিংবা মাসুদ রানা সিরিজের ‘ধ্বংস পাহাড়’ উপন্যাস অবলম্বনে হলিউডের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হতে যাওয়া ‘এম আর নাইন’ সিনেমার চিত্রনাট্যও তার লেখা।
থ্রিলার লেখক নাজিম উদ দৌলা
বিভিন্ন ব্লগ সাইটে, ফেসবুক সহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে লেখালেখি করেছেন তিনি কৈশোর বয়স থেকেই। নাজিম উদ দৌলার লেখালেখির চর্চা অনেক দিনের। ২০১২ সালে প্রথম গল্প ‘কবি’ প্রকাশিত হয় কালান্তর সাহিত্য সাময়িকীতে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫-তে প্রকাশিত হয় তার প্রথম থ্রিলার উপন্যাস ‘ইনকারনেশন’ এবং একই বছর আগস্টে প্রকাশিত হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার ‘ব্লাডস্টোন’ যা তাকে এনে দেয় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। ছাত্র অবস্থাতেই প্রকাশিত হয় তার এ দুই থ্রিলার। লেখক নাজিম উদ দৌলা সবসময়ই থ্রিলার ঘরানার লেখালেখি করেছেন। এখন পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে: ইনকারনেশন, ব্লাডস্টোন, স্কারলেট, ব্রিজরক্ষক, মহাযাত্রা, মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া, প্রহেলিকা, মুখোশে ঢাকা নরক, অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, চম্পা হাউজ ও অন্যান্য। নাজিম উদ দৌলা লেখালেখি করে নিজের একটা পাঠক মহল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে লেখক নাজিম উদ দৌলার আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তিনি নিজের লেখনি দিয়ে পাঠকদের তৃপ্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রভাষকের চাকরি ছেড়ে এজেন্সিতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ করেছেন তিনি। পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকের চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই লেখালেখিতে ডুবে থাকার ফলে শিক্ষকতা পেশায় মন বসাতে পারছিলেন না। সৃজনশীল কিছু করার প্রবণতা ছিল সবসময়ই তার মধ্যে। শিক্ষকতা ছেড়ে এরপর বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ শুরু করেন। এজেন্সিতে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন নাজিম উদ দৌলা। ‘গিকি সোশ্যাল’ নামের একটি এজেন্সিতে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন ২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তারপর বাংলাদেশের প্রথম সারির এজেন্সি ‘এনালাইজেন’ এ চার বছর কাজ করেছেন। ক্রিয়েটিভ সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ইতি টানেন এজেন্সি পাড়ার। বর্তমানে তিনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘আলফা আই’ তে ক্রিয়েটিভ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত।
ছোট পর্দা থেকে ওটিটি প্লাটফর্ম
২০১৮ সালে নাজিম উদ দৌলার লেখা গল্পে তৈরি শর্টফিল্ম ‘আজ আমার পালা’ বেশ সাড়া ফেলে নাটকপাড়ায়। ১৭ মিনিট দৈর্ঘ্যরে শর্ট ফিল্মটি নির্মাণ করেন ভিকি জাহেদ। এছাড়া ভিকি জাহেদের ‘লাভারস ফুড ভ্যান’ নাটকেও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন নাজিম উদ দৌলা। তারপর একসাথে বেশ কিছু প্রজেক্টে কাজ করছেন ভিকি-নাজিম জুটি। ছোট পর্দায় ২০২২ সালে ভিকি জাহেদের ‘চম্পা হাউজ’ নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে তুমুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমান সময়ে ছোটপর্দার পাশাপাশি ওটিটি প্লাটফর্মে বেশ ভালো কাজ উপহার দিচ্ছেন নাট্যনির্মাতারা। নির্মাতাদের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নাজিম উদ দৌলার চিত্রনাট্যে বেশ কিছু চমৎকার কাজ দেখা গিয়েছে ওটিটি প্লাটফর্মে।
২০২১ সালে ওটিটি প্লাটফর্ম বায়স্কোপের জন্য নির্মাতা শাফায়েত মনসুর রানা নির্মাণ করেন ৭টি গল্পে শর্টকাট সিরিজ। দুটি ফিকশনের চিত্রনাট্য লিখেছেন নাজিম উদ দৌলা। ‘আকাশ ভরা তারা’ ও ‘এক ভাই চম্পা’ নামের ফিকশন দু’টি তার লেখা ছিল। সঞ্জয় সমাদ্দারের ‘লোহারতরী’, ভিকি জাহেদের ‘লাল কাতান নীল ডাকাত’ ও ‘শুক্লপক্ষ’, রায়হান রাফির ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ও ‘দ্যা ডার্ক সাইড অফ ঢাকা’ ওটিটি প্লাটফর্মে নাজিম উদ দৌলা সবসময়ই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ২০২১ সালে রায়হান রাফির নির্মিত ওয়েব ফিল্ম ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ প্রকাশের পর নাজিম উদ দৌলা বেশ প্রশংসিত হয় দর্শকমহলে। তানিম রহমান অংশুর ‘বুকের মধ্যে আগুন’ ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্যও নাজিম উদ দৌলার লেখা। খেলতে হবে জুয়া, কিন্তু অর্থ দিয়ে নয়, লগ্নি হবে ‘আত্মা’; এমন গল্পে ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’ নির্মাণ করেছেন ভিকি জাহেদ। নির্মাতার সঙ্গে যৌথভাবে সিরিজটির চিত্রনাট্য লিখেছেন নাজিম উদ দৌলা। ভিন্নধর্মী গল্পের নির্মাণ দর্শকদের বেশ পছন্দ হয়েছিল।
রূপালি পর্দায় নাজিম উদ দৌলা
এবারের ঈদে রায়হান রাফি নির্মিত ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা দর্শক মহলে তুমুল প্রশংসা কুড়াচ্ছে। রায়হান রাফির ড্রিম প্রেজেক্টের স্ক্রিপ্ট রাইটার ছিলেন নাজিম উদ দৌলা। বড় পর্দায় নাজিম উদ দৌলার লেখা চতুর্থ চলচ্চিত্র এটি। ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমাটি দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে তার অন্যতম কারণ সিনেমার শক্তিশালী চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্যের গতি শুরু থেকে শেষ সমান স্কেলে ছিল। সিনেমার দুর্দান্ত স্ক্রিন প্লের ফলে দর্শক চুম্বকের মতো আটকে ছিল পর্দায়। ২০২২ সাল থেকে নাজিম উদ দৌলা বড় পর্দায় চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ২০২২ সালে তার লেখা চিত্রনাট্যে তিনটি সিনেমা বড় পর্দায় মুক্তি পায়। বড় পর্দায় মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা এম রাহিমের নির্মিত ‘শান’ সিনেমা। মানবপাচারের শিকার হওয়া মানুষের গল্প ও মানবপাচারের শিকার হওয়া সাধারণ মানুষদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিভাবে মুক্ত করেন তা নিয়েই ছিল সিনেমার গল্প। বড় পর্দায় অভিষেক হয় নাজিম উদ দৌলা এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখে। সিনেমার নায়ক ছিলেন সিয়াম আহমেদ। দীপংকর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার স্ক্রিপ্টও তার লেখা। সর্বশেষ ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তি পায় বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কাহিনীকে কেন্দ্র করে রায়হান রাফি নির্মিত ‘দামাল’ সিনেমা। যেটার চিত্রনাট্যও লিখেছেন নাজিম উদ দৌলা। মাসুদ রানা সিরিজের ‘ধ্বংস পাহাড়’ উপন্যাস অবলম্বনে হলিউডের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হতে যাওয়া ‘এম আর নাইন’ সিনেমার চিত্রনাট্যও যৌথভাবে লিখেছেন তিনি। অনান্য রাইটাররা সবাই অনান্য দেশের, বাংলাদেশ থেকে শুধু তিনি ছিলেন।
বর্তমানে নাজিম উদ দৌলা একজন পেশাদার চিত্রনাট্যকার। তার কাজের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সবসময়ই বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ঘরানার মিশ্রণ ঘটাতে চান। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে অবহেলা করা হয় সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্যকে। পার্শ্ববর্তী দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায় সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় গল্প এবং চিত্রনাট্যকে। কেননা একটা সিনেমা তৈরি হয় শক্ত চিত্রনাট্যে। নাজিম উদ দৌলার মতো মেধাবী তরুণেরা ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলে আমরা একদিন আমাদের কাজ নিয়ে গর্ব করতে পারবো।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি