‘নাট্যকেন্দ্র’র যাত্রা শুরুর গল্প বললেন তারিক আনাম খান

দেশের বরেণ্য অভিনেতা তারিক আনাম খানের হাত ধরে গড়ে উঠেছে ‘নাট্যকেন্দ্র’। এই নাট্যকেন্দ্র জন্ম দিয়েছে অনেক অভিনেতার।

এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসানসহ অনেকেরই আঁতুড়ঘর নাট্যকেন্দ্র।

১৯৯০ সালে গড়ে ওঠে এই দল। তারিখটি ছিল ১১ অক্টোবর। সেই দিনটি ঘিরে স্মৃতিকাতর হয়েছেন অভিনেতা তারিক আনাম খান। ফেসবুকে লেখেন একটি পোস্ট।

সেখানে ১১ অক্টোবরকে আবেগের তারিখ উল্লেখ করেন এই তারিক আনাম খান। তিনি লেখেন, ১১ই অক্টোবর। খুব আবেগের একটা তারিখ, এখনও। খুব স্মৃতিময় একটা তারিখ। নাট্যকেন্দ্রর জন্মদিন। ১৯৯০ সালের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ১০ অক্টোবর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন জেহাদ। ১১ অক্টোবর অর্ধদিবস হরতাল। অথচ আমরা অনেক আগেই ওই দিনটাই নির্ধারণ করে বসে আছি। একবার ভেবেছিলাম বাতিল করে দিই, পরে ভাবলাম করেই ফেলি, যা হওয়ার হবে। যদ্দুর মনে পড়ে দাওয়াতপত্রও দেওয়া হয়েছিল। এক নতুন দলের জন্মলগ্নে আপনাকে স্বাগত, এ রকম কিছু।

জার্মান কালচারাল সেন্টার, ধানমণ্ডিতে সন্ধ্যায় মোট ২৯ জন আমরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য বেশ অনেক দিন মহড়া করেছি। পুরোটাই স্ক্রিপ্টবিহীন কিন্তু মাথার মধ্যে সুগ্রথিত। মহড়া হতো নীলক্ষেত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমিতে- যোগ করেন এই অভিনেতা।

তিনি আরও লেখেন, জার্মান কালচারাল সেন্টারে করার কারণ তৎকালীন ডিরেক্টর মিস লেশনার পয়সা নেবেন না। আর একটা বড় কারণ হলো- তখন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘গ্যালিলিও’ নিয়মিত অভিনীত হতো। নাটকের সেট বেশ সুন্দর, অনেকগুলো লেভেল পাওয়া যাবে। নাগরিকের সবাই খুব বন্ধু এবং কাছের মানুষ। বিশেষ করে আলী যাকের, সারা যাকের, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, নিমা রহমান এরা।

‘নাট্যকেন্দ্র’ নাট্যসংগঠনের নাম দের প্রয়াত অভিনেতা আলী যাকের। সেই বিষয়টি উল্লেখ করে তারিক আনাম খান লেখেন, ‘নাট্যকেন্দ্র’ নামটা আলী যাকেরের দেওয়া। নাগরিকের অনুমতি নিয়ে ওখানে আমরা তার আগে ১-২ দিন মহড়াও করেছি। আমরা খুব দুশ্চিন্তায়, লোকজন আসবে তো আমাদের উদ্বোধনীতে? নাটকের স্বজন বন্ধুরা আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই হাজির। দর্শকাসন পরিপূর্ণ। আমাদের উদ্বোধনীতে অভিনেতাদের পোশাক মেয়েদের হালকা আকাশি নীল এবং ছেলেদের সাদা টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট। একমাত্র আমি বাদে। আমি নির্দেশক, মঞ্চে উঠিনি।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান কেমন ছিল, সেটা জানিয়ে তারিক আনাম খান লেখেন, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! একঝাঁক উজ্বল তরুণ-তরুণী প্রদীপ হাতে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলেন, কণ্ঠে তাদের গান ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’, একে একে সবাই মঞ্চের সম্মুখভাগে রেখে দিলেন প্রদীপ। পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হলো মঞ্চ, তারা যখন প্রদীপ রেখে একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, তখনই জ্বলে উঠল মঞ্চের সব আলো। জন্ম হলো নাট্যকেন্দ্রের।

‘নাট্যকেন্দ্র’র আলী যাকেরের দেওয়া ছিল, এর লোগো করেছিলেন আরেক বরেণ্য অভিনেতা আফজাল হোসেন। আর এই দলের নামও প্রকাশ হয়েছিল উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানের পর। এমনটাই জানান তারিক আনাম খান।

এ বিষয়ে তিনি আরও লেখেন, মঞ্চে একটা বোর্ডে সেই লোগো ও দলের নাম নিয়ে আসা হলো, বিটোভেন/মোজার্টের সংগীত মূর্ছনায়। বোর্ডের ওপরে লাল পর্দা। আমরা লোগো উন্মোচনের জন্য ঠিক করেছিলাম সিরাজ ভাইকে, যিনি তখন সব মঞ্চে আলো জ্বালতেন। সিরাজ ভাই পর্দা তুললেন। ‘নাট্যকেন্দ্র’ আলোতে এলো।

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে তারিক আনাম খান লেখেন, নাটকের দল, তাদের উদ্বোধনীতে নাটক হবে না, তা কি হয়? প্রথমে এলো, কী করে নাট্যকেন্দ্র জন্ম হলো, লোকজন দলে কীভাবে যোগ দিল, পত্রপত্রিকায় কী লেখা হলো, দলে যোগ দিয়ে শরীর ও কণ্ঠ চর্চা, পরিশ্রম ইত্যাদি নিয়ে এক মজার উপস্থাপনা। উপসাগরীয় যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। প্রাণহানি ঘটছে, মানুষের কষ্ট, আমাদের দেশের মানুষ যারা কুয়েত, আবুধাবিসহ উপসাগরীয় অঞ্চলে কাজ করতেন তাদের ফিরে আসা এসব মিলিয়ে একটা ইম্প্রোভাইজড নাট্যালেখ্য ‘উপসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর’। সর্বশেষে আমাদের আগামী দিনের নাট্যভাবনা, কার্যক্রম এসব ঘোষণা। আমার স্মৃতিতে এটুকু এখনও অম্লান।

লেখার শেষের প্রান্তে তারিক আনাম খান বেশ কয়েকজনের নাম যুক্ত করে জানালেন কৃতজ্ঞতা। তিনি লেখেন, আমি একা নই। দৃঢ়ভাবে পাশে ছিল তৌকীর, ঝুনা, মেঘনা। এরপর নাসরীন রাখী, সুমনা সুমি, জলি, প্রাচী, শিরীন শিলা, মুস্তাফা মুনির, গোলাম মোস্তফা, মোদাসসর্, শাহনূর, মোজাহার সেলিম, রতন সাহা, মোর্শেদ, নয়ন আলমগীর, শফিক সাদেকী, মোতাহের হাসান মিঠু, ইকবাল বাবু, আনোয়ার আকাশ, মাহিদুল ইসলাম অনিক, আশরাফুল রন্টু, ইমরুল বাবু, রফিক, মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান আরও অনেকে যারা শক্তি জুগিয়েছে, পরিশ্রম করেছে, নিজ প্রতিভায় নাট্যকেন্দ্রকে আলোকিত করেছে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমাদের বন্ধু নাট্যজন আমাদের দর্শক সবার প্রতি বিনম্র অভিবাদন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 + 6 =