নায়ক ওমর সানী

মৌ সন্ধ্যা

দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ৯০ দশকের সেরা সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানী। সেসময় ঢাকাই সিনেমার নন্দিত নায়ক ছিলেন সানী। তার নামে হলে সিনেমা চলতো। এখন আর সিনেমায় তেমন দেখা মেলে না তার। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব থাকেন তিনি। নানারকম কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কখনো আলোচিত-সমালোচিত হন। জনপ্রিয় এই নায়কের জন্মদিন ৬ মে। তার জন্মদিনে রঙবেরঙের পক্ষ থেকে রইলো অনেক শুভেচ্ছা। জেনে নেওয়া যাক ওমর সানীর জীবনের নানান চড়াই-উৎরাই, সফলতা-ব্যর্থতার গল্প।

বরিশালের ছেলে

চিত্রনায়ক ওমর সানীর জন্ম ৬ মে ১৯৬৮। ওমর সানী হিসেবেই বেশি পরিচিত তিনি। তার পারিবারিক নাম মোহাম্মদ ইমরান। জনপ্রিয় এই চিত্রনায়ক ছোট পর্দাতেও অভিনয় করেছেন। খ্যাতিমান নায়িকা সুচন্দা, ববিতা, চম্পা তার খালা হন। চিত্রনায়ক রিয়াজ তার মামা।

পথচলা শুরু

১৯৯২ সালে নুর হোসেন বলাইয়ের ‘এই নিয়ে সংসার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ওমর সানীর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। ১৯৯৪ সালে দিলীপ বিশ্বাসের ‘দোলা’ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো মৌসুমীর বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে শাকিব খান অভিনীত ‘ওরা দালাল’ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। খলনায়ক হিসেবেও ওমর সানী সফলতা পান। ৯০ দশকের শুরুতে এহতেশামের হাত ধরে বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে নতুনদের যে জোয়ার শুরু হয়েছিল সেই জোয়ারে পাওয়া এক মুক্তা ওমর সানী। তিনি হয়েছিলেন আরেক ‘মুক্তা’ সালমান শাহর সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।

সিনেমা জীবনের গল্প

সানীর অভিনয় শুরু হয় ৯২ সালে। নুর হোসেন বলাইয়ের ‘এই নিয়ে সংসার’ সিনেমা দিয়ে। তবে সানীর প্রথম চুক্তি করা চলচ্চিত্র শেখ নজরুল ইসলামের ‘চাঁদের আলো’ যা ‘এই নিয়ে সংসার’ মুক্তির পর মুক্তি পায়। প্রথম ছবিতে পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসেবে সানী তার সুঠাম দেহ ও লম্বা চুলের কারণে সবার নজর কাড়েন। পরিচালক শেখ নজরুল ইসলামের প্রথম ছবি ‘চাঁদের আলো’ ছিল সানীর প্রথম একক নায়ক হিসেবে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ছবিটির গান জনপ্রিয় হওয়ায় সুপারহিট ব্যবসা করে। ফলে একক নায়ক হিসেবে নবাগত সানীকে সবাই সফল বলে মেনে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে নুর মোহাম্মদ মনির ‘প্রেম প্রতিশোধ’ বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে নুর হোসেন বলাইয়ের ‘মহৎ’ ছবির ব্যবসাসফলতা সানীকে বাঁচিয়ে দেয়। যার ফলে সম্পূর্ণ অ্যাকশন ছবি ‘আখেরি হামলা’য় নবাগতা নিশিকে নিয়ে নাদিম মাহমুদ আরও একটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন যেখানে সানী ছিলেন প্রধান নায়ক।

‘চাঁদের আলো’র পর একটি ফ্লপ ও দুটি সুপারহিট ছবি দিয়ে যখন সানী নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়া ঠিক তখনই শেখ নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘চাঁদের হাসি’। যা ‘চাঁদের আলো’ ছবির ব্যবসার ধারে কাছেও ছিল না। তবে এর মাঝে এ জে মিন্টুর ‘বাংলার বধু’ ছবিতে সানী জিনাতের সাথে সুপারহিট হোন। পরিচালক দীলিপ সোম দুটি সুপারহিট সিনেমার নায়িকা মৌসুমীর সাথে ওমর সানীকে নিয়ে ‘দোলা’ ছবি তৈরি করে এক অর্থে ‘জুয়া’ খেললেন। যেখানে মৌসুমীর চরিত্রের নাম ছিল ‘দোলা’। নির্ভেজাল প্রেমের সুপারহিট রোমান্টিক সিনেমা ছবি ‘দোলা’ দিলো অনেক প্রশ্নের জবাব। সালমান ছাড়া মৌসুমীর জুটি হতে পারে তরুণ এই সানী। এরপর সানীকে পাই রায়হান মুজিব পরিচালিত ‘আত্ম অহংকার’ ছবিতে, যে ছবিটিও সুপারহিট ব্যবসা করে। এই ছবিটা যেন সানী-মৌসুমী জুটিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিলো। এরপর এলো গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘ক্ষুধা’ সেখানেও সানী-মৌসুমী হিট। সানী সেসময় শুধু মৌসুমীর সাথে রোমান্টিক ছবিতে সফল ছিলেন না, সফল ছিলেন অন্য নায়িকাদের সাথেও; সামাজিক অ্যাকশন, পারিবারিক গল্পের সিনেমাতেও।

সানীকে পাওয়া যায় সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘আখেরি রাস্তা’, এ জে মিন্টুর ‘বাংলার বধু’, জীবন রহমানের ‘হুলিয়া’, ‘জানের দুশমন’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘প্রেমগীত’, মমতাজুর রহমান আকবরের ‘কুলি’, ওয়াকিল আহমেদের ‘প্রেমের অহংকার’, ‘অধিকার চাই’, সৈয়দ হারুনের ‘চরম আঘাত’ এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমাগুলোতে। শাবনুরের সাথে সানীর ওয়াকিল আহমেদ পরিচালিত ‘প্রেমের অহংকার’ সিনেমাটিও সুপারহিট ব্যবসা করেছিল। অনেকের মতে সানী অভিনীত সেরা সিনেমা হলো এ জে মিন্টুর ‘বাপের টাকা’। সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য, সুনিপুণ নির্মাণের সাথে সানীর সেরা অভিনয় পুরোটা আদায় করে নিয়েছিলেন এ জে মিন্টু। একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী গল্পের ‘বাপের টাকা’ সিনেমাতে সানী ধনাঢ্য আলমগীরের একমাত্র সন্তান। যে টাকাকেই সবকিছু মনে করে বখে যায়। পরবর্তীতে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে বুঝতে পারে টাকাই সবকিছু নয়। টাকা ব্যয় করার চেয়ে অর্জন করা কঠিন। সানীর অন্য সেরা ছবিগুলো হলো রায়হান মুজিবের ‘আত্ম অহংকার’, ওয়াকিল আহমেদের ‘প্রেমের অহংকার’ ও ‘অধিকার চাই’, আজিজুর রহমানের ‘লজ্জা’, হাফিজউদ্দিনের ‘প্রিয় তুমি’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘প্রেমগীত’, নাদিম মাহমুদের ‘আখেরী হামলা’, এ জে মিন্টুর ‘প্রথম প্রেম’, সোহানুর রহমান সোহানের ‘আখেরী রাস্তা’, মনতাজুর রহমান আকবরের ‘শয়তান মানুষ’, উত্তম আকাশের ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ও ‘কে অপরাধী’।

ছোট পর্দায়

ছোটপর্দাতেও অভিনয় করেছেন ওমর সানী। ২০১৫ সালে সানী-মৌসুমী জুটির টেলিফিল্ম ‘ভালোবাসার ২০ বছর’ প্রচার হয় চ্যানেল আইতে। মৌসুমী-ওমর সানী চলচ্চিত্রের আলোচিত ও সফল জুটি। প্রথমে প্রেম এরপর বিয়ে। দাম্পত্য জীবনেও সুখে রয়েছেন তারা। তাদের দাম্পত্য জীবনের ২০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনকে ভিত্তি করেই এ টেলিফল্মটির গল্প তৈরি হয়। তাদের ভালোবাসার ২০ বছরের নানা ঘটনা টেলিছবিটিতে উঠে আসে। এ টেলিছবিতে মৌসুমীকে দেখা যায় একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে। আর ওমর সানীকে দেখা যায় একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে। এটা ছাড়াও আরও কয়েকটি টেলিছবিতে অভিনয় করেছেন সানী। ছেলে ফারদিনের পরিচালনায় ‘ডেস্টিনেশন ২’ নামের একটি টেলিছবিতে অভিনয় করেছিলেন ওমর সানী ও মৌসুমী।

পরিবার

১৯৯৬ সালের ২ আগস্ট ওমর সানী জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ফারদিন এহসান স্বাধীন নামের এক ছেলে ও ফাইজা নামে এক মেয়ে রয়েছে।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

দর্শকপ্রিয় চিত্রনায়ক ওমর সানী বাংলা সিনেমায় তিন দশক অতিক্রম করেছেন বছর চারেক আগেই। নব্বই দশকের শুরুতে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন তিনি। নায়ক ছাড়াও তাকে নানামাত্রিক চরিত্রেও দেখা গেছে। ওমর সানী প্রায় ১৭০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অভিনয় জীবনে নায়িকা হিসেবে পেয়েছেন চম্পা, অঞ্জু ঘোষ, মৌসুমী, শাবনূর, লিমা, পপি, শাহনাজ, শিল্পী, ঋতুপর্ণাসহ আরও অনেককেই। অভিনেত্রী স্ত্রী মৌসুমীর সঙ্গেই ৪০টির বেশি সিনেমায় নায়ক হয়েছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো: ‘দোলা’, ‘আত্ম অহংকার’, ‘লাট সাহেবের মেয়ে’, ‘রঙিন রংবাজ’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘হারানো প্রেম’, ‘গরীবের রানী’, ‘প্রিয় তুমি’, ‘শান্তি চাই’, ‘মিথ্যা অহংকার’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘লজ্জা’, ‘সংসারের সুখ দুঃখ’ ও ‘কথা দাও’। এছাড়া অন্য অভিনেত্রীদের মধ্যে শাবনূরের বিপরীতে ‘অধিকার চাই’, ‘রঙিন নয়নমণি’ ও ‘কে অপরাধী’। শাহনাজের বিপরীতে ‘চালবাজ’, পপির সঙ্গে ‘কুলি’ ছবিগুলো ব্যবসাসফল হয়েছিল। ত্রিশ বছর সিনেমায় অভিনয় জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে ওমর সানী বলেন, ‘আমার অভিনয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি দর্শকের ভালোবাসা। এখনও তারা ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। এর চেয়ে সুন্দর পাওয়া কী হতে পারে, অপ্রাপ্তিগুলো নিয়ে ভাবতে চাই না। অপ্রাপ্তি সবসময়ই বেদনার। সেসব এড়িয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয়।’

ব্যবসায়ী

ওমর সানী বসুন্ধরা সিটিতে ‘ফ্রি জোন’ নামে পোশাকের শো-রুম চালু করেছিলেন। দীর্ঘদিন সেখানে সময় দিয়েছেন। সেখানে বেশিরভাগ পোশাক ডিজাইন করতেন মৌসুমী ও তাদের মেয়ে ফাইজা। ফ্যাশন ডিজাইনের প্রতি খুবই আগ্রহ ছিল ফাইজার। মৌসুমী ও ওমর সানী দুজনেই আলাদা চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। মৌসুমীর ‘কপোতাক্ষ’ ও সানীর ‘স্বাধীন’ নামে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখান থেকে বেশ কিছু ভালো নাটক নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও ওমর সানীর একটি কনসাল্টিং ফার্মও রয়েছে। একসময় পরিবহন ব্যবসাও ছিল। বর্তমানে খাবারের ব্যবসা করছেন সানী-মৌসুমী। ২০২২ সালে গুলশানে ‘চাপওয়ালা’ নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন সানী-মৌসুমীর একমাত্র ছেলে ফারদিন এহসান স্বাধীন। এখানে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চাপ পাওয়া যায়। সঙ্গে লুচি, আলুর দম। পরে আফতাব নগরীতে ‘চাপওয়ালা রেস্টুরেন্ট’র দ্বিতীয় শাখা খুলেন ওমর সানী।

বর্তমান ও শেষ কথা

ঈদে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ওমর সানী ও মৌসুমী অভিনীত ‘সোনার চর’ সিনেমা। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন জাহিদ হোসেন। এছাড়া ওমর সানী অভিনীত এবং মোহাম্মদ ইকবাল পরিচালিত ও প্রযোজিত ‘ডেডবডি’ নামে একটি সিনেমাও ঈদে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করে নির্মাতা কর্তৃপক্ষ। ফলে মুক্তি পায়নি সানীর ‘ডেডবডি’। আরও কয়েকটি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় আছে তার। সব মিলিয়ে আরও নতুন চমক নিয়ে আসুক ওমর সানী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − five =