নারীকে শক্তিশালী হতে হবে

নীলাঞ্জনা নীলা

সমাজে এখনো পুরুষদেরই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চাপ থাকে বেশি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার দায়িত্ব শুধু একা পুরুষের নয়, স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন একজন নারীরও। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা কিংবা যেকোনো ধরনের কাজ করা। এই কাজ এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে অনেক নারী বাধার সম্মুখীন হয়। সমাজে একজন নারীর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়া ও নিজের একটি পরিচয় থাকা অনেক বেশি প্রয়োজন। তা না হলে তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমান বাজারে একজন পুরুষের পক্ষে পুরো সংসার টেনে নেওয়া অনেক বেশি কঠিন। তাই পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীরও তালে তাল মিলিয়ে আয় করা প্রয়োজন। এতে তার একটি নিজের পরিচয় তৈরি হবে, পাশাপাশি সে পরিবারকেও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারবে। তাই তো কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

একটি পরিবার ও সমাজ নারী পুরুষ উভয়েরই সমান ভূমিকার ফলেই চলে। সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নারীর অবদানের কথা কখনো অস্বীকার করা যাবে না। কারণ বারবার নারীরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ দিয়েছে, শুধু বাড়িতে নয় ঘরে বাইরে উভয় স্থানে কাজ করে নিজের দক্ষতা পরিচয় দিয়েছে। সমাজের অনেক নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বামী ও পিতার উপর নির্ভরশীল। মানুষের জীবনে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই সবসময় আরেকজনের উপর নির্ভরশীল না হয়ে চেষ্টা করা উচিত নিজেকে তৈরি করা। একজন নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, এটি তার একটি আলাদা ধরনের শক্তি। একজন নারীর নিজের পরিচয় থাকা মানে তার পায়ের নিচের মাটি শক্ত থাকা। সমাজে এমন অনেক নারী রয়েছে যারা আয় করে না বলে প্রতিনিয়ত পরিবারের কাছ থেকে অবহেলিত হচ্ছে। পরিবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। কিছু পরিবারে নারীরা মতামত দিলেও তা মূল্যায়ন করা হয় না। পরিবার ও সমাজে নারীরা নানাভাবে প্রতিনিয়ত অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে। দেশে পুরুষপ্রধান পরিবার বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীপ্রধান পরিবার বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা স্বামীর মৃত্যু। অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে নারীদের পুরো পরিবারের হাল ধরতে হচ্ছে।

আমাদের দেশে একজন নারী যদি আয় করার চেষ্টা করে তখন যেমন তাকে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, আবার উল্টো আয় না করলেও তাকে নানাবিধ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। অনেক পরিবারে নারীরা যে ঘরের কাজের পাশাপাশি বাইরের কাজও সমান যোগ্যতার সঙ্গে করতে পারবে সে ভরসা করা হয় না। নানাভাবে একজন নারীকে পরিবার ও সমাজ দমিয়ে রাখে। সমাজে এমন অনেক নারী আছে যারা প্রতিনিয়ত স্বামী এবং স্বামী পরিবার দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সে নির্যাতনের কথা তারা মুখ ফুটে বলছে না। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে নিজের কোনো আয় না থাকা এবং স্বামীর উপর নির্ভরশীল হওয়া। তারা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকে যে, এই নির্যাতনের কথা স্বীকার করলে হয়তো বিবাহ বিচ্ছেদ হবে এবং তাদের কোনো আয়ের উৎস থাকবে না। নির্যাতনের শিকার হয়ে ও সমাজের ভয়ে আমাদের দেশের নারীদের আত্মহত্যা করার ঘটনাও বিরল নয়। একজন নারীর পায়ের নিচের মাটি অবশ্যই শক্ত হতে হবে শুধুমাত্র তার নিজের মঙ্গলের জন্যই। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হলে অনেক নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করে জীবন যাপন করতে পারবে।

একজন নারীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হলে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা একজন নারীর জ্ঞান সমৃদ্ধ করবে এবং তার যোগ্যতা  বাড়িয়ে তুলবে। একজন শিক্ষিত নারী খুব সহজে তার আয়ের উৎস খুঁজে বের করে আনতে পারে। প্রতিটি নারীর উচিত তার নিজ নিজ স্থান থেকে নিজেকে শিক্ষিত করা। প্রতিটি পরিবারের উচিত মেয়েদের পড়ার সুযোগ করে দেওয়া। শিক্ষিত হলে একটি চাকরি কিংবা আয়ের উৎস খুঁজে বের করা সহজ। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যাবে না কিংবা অর্থ উপার্জন করা যাবে না সে কথাটিও সম্পূর্ণ ভুল। অনেক স্বল্পশিক্ষিত নারীরাও নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলছে, নিজেদের উদ্যোগ গড়ে তুলছে নিজের প্রতিষ্ঠান। এমনকি অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন পেইজে শুধুমাত্র রান্নাবান্না করে তা বিক্রি করে অনেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকলেও নিজের পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব এবং নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন কিছু দক্ষতা। আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পশিক্ষিত নারীদের শক্তিশালী করে তোলার জন্য তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিচ্ছে। সেলাই কাজ, রান্না শেখা, ছোট ব্যবসা দাঁড় করিয়ে, নিজের বাগানের সবজি বিক্রি করে নারীরা নিজেদের আয়ের তৈরি করে নিচ্ছে।

নিজেকে যোগ্য করে তুলতে একজন নারী যদি নিজেকে যোগ্য করে তুলতে চায় তাহলে তাকে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে।

ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা

অনেক নারীদের মধ্যে আঁকড়ে থাকার প্রবণতা রয়েছে, সেটা হোক ব্যক্তি কিংবা স্থান। সেখানে নির্যাতিত হলেও তারা সহজে সেই স্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু নিজেকে সফল করে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই আঁকড়ে থাকার প্রবণতা থেকে বের হয়ে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতে হবে। নতুনকে গ্রহণ করতে ভয় করলে চলবে না। নতুন কোনো স্থানে যাওয়া, নতুন কাজের যুক্ত হওয়াকে ভয় করলে জীবনে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়।

শেখার আগ্রহ

একজন নারীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হলে অবশ্যই শেখার আগ্রহ থাকতে হবে এবং নতুন স্কিল অর্জন করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকেও অনেক সময় নানা ধরনের স্কিল মানুষকে সাহায্য করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে। প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে নতুন কিছু শেখার জন্য। নতুন কিছু শিখতে পারলে নতুন সম্ভাবনা সামনে খোলা থাকবে। এবং প্রত্যেকটি সুযোগ কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

আত্মবিশ্বাসী থাকা

আত্মবিশ্বাসী হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। একজন আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তি সব কাজে এগিয়ে থাকে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকলে যেকোনো কিছু অর্জন করা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়। প্রতি মুহূর্ত নিজেকে অনুভব করাতে হবে যে, ‘আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে’।

লোকের কথায় কান না দেওয়া

নতুন কোনো কাজ শেখার সময় কিংবা নতুন কিছু করার চেষ্টা করলে আশেপাশের ব্যক্তিরা অনেক সময় কটূ কথা বলে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে জীবনে সফল হতে গেলে লোকের সব কথায় কান দেওয়া যাবে না। কিছু কথা এড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হতে হবে। বুঝতে হবে কে মঙ্গল চায় এবং কে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিতে চায়। যাদের আশেপাশে থাকলে আত্মবিশ্বাস প্রতিনিয়ত কমে যায় এবং নিজের প্রতি সন্দেহ তৈরি হয়, তাদের সবসময় এড়িয়ে চলা উচিত। যেসব পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধুরা আমাদের আত্মবিশ্বাস দেয় তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত।

লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × 5 =