ইরানী বিশ্বাস
একটি মেয়ের বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলোর মধ্যে ঋতুস্রাব অন্যতম। সাধারণত ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হতে দেখা যায়। এ সময় তারা বাল্যকাল থেকে কৈশোরে প্রবেশ করে। একজন মেয়ের জন্য ঋতুস্রাব আনন্দের বা উল্লাসের নয়। আবার লজ্জারও নয়। তবে এই ঋতুস্রাব একজন মেয়েকে এই পৃথিবীতে প্রাণের জন্ম দিতে পারার শক্তি সঞ্চারক। একজন নারীর মা হওয়ার যে প্রক্রিয়া তার প্রথম এবং প্রধান ধাপ হচ্ছে পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব। প্রাচীন হিন্দু রীতি অনুযায়ী মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হলে উৎসবের আয়োজন করা হতো। ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর তা পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগে অন্তত ১০ দিন। এই সময় দিন-ক্ষণ দেখে এই উৎসবের আয়োজন করা হতো। এটাকে বলা হতো ঋতুস্রাব উৎসব। মেয়েটিকে ঋতুস্রাবের ১০ দিন মাছ-মাংস বা আমিষ খেতে দেওয়া হতে না। সে সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার খেতো। ১০ দিন পর তাকে পবিত্র বা শুচি করার জন্য সমস্ত শরীর পরিস্কার করে গায়ে হলুদ দিয়ে স্নান করানো হতো। তারপর নতুন বস্ত্র পরিধান করানো হতো। তারপর মেয়েটিকে আমিষ দেওয়া হতো। এ উপলক্ষ্যে বাড়িতে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হতো। এভাবেই প্রচীন কালে হিন্দু মেয়েদের ঋতুস্রাবকে উৎসবের আমেজে বরণ করা হতো। দিনে দিনে সমাজ থেকে এই উৎসব বিলুপ্ত হয়ে বরং একটি ট্যাবু হিসেবে পরিণত হয়েছে।
ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড আর পাঁচটা শারীরিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মতোই একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। তবুও ঋতুস্রাবের মতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ঘিরে এখনো এই সময়ে নানা কুসংস্কার বহমান। কারণ পবিত্র এই মানব জন্মের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে সমাজ নারীকে অশুচি বলে ঘরবন্দি করে রাখে। অথচ এই প্রক্রিয়া কতোটা কষ্টদায়ক তা কেবল ঋতুস্রাব হওয়ার সময় একটি মেয়ে বুঝতে পারে। প্রায়শই দেখা যায়, একটি নারী তার প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী কাজ করছেন। সকালে উঠে নিত্যদিনের সাংসারিক কাজের জন্য বা অফিসে যাবার জন্য বা স্কুল কলেজে যাবার জন্য তৈরি হলেন। হঠাৎ তার ইউটেরাসে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হলো। অধিকাংশ মেয়ে ওই অবস্থায় ডেইলি রুটিনের সব কাজ সম্পন্ন করেন। আবার ব্যতিক্রম কিছু আছে, যাদের শরীর এতটাই খারাপ হয় যে তাদের শরীরের নানা অংশ ক্র্যাম্প হয়ে যায়। এই যন্ত্রণা তিনি মুখ বুজে সহ্য করে যায়। কারণ তিনি চিৎকার করে কাঁদতেও পারেন না আবার মুখ ফুটে বলতেও পারেন না। অনেক নারীর যন্ত্রণা প্রসব যন্ত্রণার চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারন করে। এ অবস্থায় তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়।
অসুস্থ অবস্থায় বাড়ির বা কর্মক্ষেত্রের কাজ, কোথাও কিন্তু কেউ ছাড় দেয় না। নির্ধারিত কাজ তাকে করতে হয়। আমাদের দেশের নারীরা পিরিয়ডকালীন যাবতীয় অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে সমানতালে সব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষ, নারীর এই অসুস্থতাকে অতটা তীব্রভাবে উপলব্ধি করেন বলে মনে হয় না।
এখানেই থেমে নেই। একটি নারীর মাসিক চক্র অনুযায়ী সবসময় একই দিনে বা সময়ে পিরিয়ড শুরু হয় না। অনেক সময় তারিখ এবং সময় বদল হয়। অনেকেই তারিখ অনুয়ায়ী ভুলে যান বাড়ি থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে যেতে। যদিওবা নিয়ে যান তবে তিনি তো জানেনই না ঠিক কখন থেকে শুরু হবে। অধিকাংশ সময়ে অপ্রস্তুত হতে হয়। নিজের অজান্তে পেশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঋতুস্রাব চলাকালীন সময় নারীকে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। এ সময় সাধারণত নারীর মন-মেজাজ খারাপ বা মুড-সুইং হতে পারে। বর্তমানে মুড সুইং শব্দটা খুব ব্যবহারিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বাধিক আলোচিত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এই প্রজন্মের অনেকেই মুড সুইং শব্দের মাঝে তীব্র অজুহাতের গন্ধ খুঁজে পান। যা নিয়ে নিজেদের অজান্তেই হাসি ঠাট্টার ছলে একে বিদ্রুপাত্মক শব্দে পরিণত করে ফেলেন। যা পিরিয়ড বা ঋতুস্রাবের জন্য একটি বিব্রতকর শব্দ। কোনো পুরুষ যদি মন খারাপ করে বা মন খারাপের কথা বলে। বন্ধুরা তাকে ঠাট্টা করে বলে ‘তোর কি পিরিয়ড হয়েছে?’। অথচ এটা কোনো হাস্য-কৌতুক বা ঠাট্টার বিষয় নয়। পিরিয়ডের সময় যে অমানুষিক শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয় তা তথাকথিত সামজের বিদ্রুপকারীদের পক্ষে তা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অনেক সময় মুড সুইংয়ের ভয়াবহতা গিয়ে পড়ে পরিবারের সদস্যদের উপর। এ সময়গুলোতে পরিবার তথা সমাজের সকল সদস্যদের উচিত মানসিকভাবে সাহায্য করা।
এতক্ষণ যে ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা হলো, তার জন্য দরকারি বা অত্যাবশ্যকীয় জিনিস স্যানিটারি ন্যাপকিন। পিরিয়ডের বিষয়ে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের মেয়েরা সচেতন বেশি। তাই স্যানিটারি প্যাডের সহজলভ্যতা শহরাঞ্চলে বেশি। এ কারণে শহরাঞ্চলে দোকানে বা ফার্মেসিতে কোনো নারী স্যানিটারি প্যাড কিনতে গেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। কেউ যদি দোকানদারকে গিয়ে বলে ‘প্যাড দিন’। নারীদের মুখে এ ধরনের কথা শুনতে পেয়ে দোকানে উপস্থিত সকল পুরুষ নড়েচড়ে ওঠে, যেন মেয়েটির শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। তা দেখার জন্য কৌতুহলী মানুষগুলো তীক্ষণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাতে থাকবে। এরপরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। ‘প্যাড দিন’ কথাটি স্পষ্ট শুনতে পাওয়ার পরও সেলসম্যান পুনরায় জিজ্ঞেস করবেন, কি চাই? যাতে মেয়েটিকে লজ্জা ভেঙে অনেক মানুষের সামনে আবারও উচ্চারণ করতে হয় ‘প্যাড দিন’। এখানেই শেষ নয়, এরপর জিজ্ঞেস করতে থাকে বেল্ট না প্যান্টি? অথবা কোন কোম্পানির দেবো, এরকম অবান্তর অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে। আর আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কৌতুহল আরও বাড়তে থাকে।
এরপর দোকানি স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেট এমনভাবে কাগজে মুড়ে দেন, যেন এগুলো অবৈধ কোনো জিনিস যা গোপনে বহন করতে হবে। এই রাখঢাকের কারণ কি? তাহলে কি সত্যি ঋতুস্রাব হওয়া কোনো খারাপ বিষয়? ফার্মেসিতে ঔষধ কিনতে গেলে সেলসম্যান বা উপস্থিত ক্রেতা কখনো তো এমন করেন না। একজন পুরুষ যখন কনডম কিনতে যান তখনও সেলসম্যান এমন করেন না। এমনকি জন্ম নিরোধক পিল, লিউকোরিয়ার ওষুধ বা এইডস-এর ওষুূধ কিনতে গেলে দোকানি বা সেলসম্যান বা উপস্থিত ক্রেতাগণ এমন কৌতুহল নিয়ে তাকান না। সমস্ত ঝামেলা স্যানিটারি ন্যাপকিনে! সমাজের এই অসুস্থ মানসিকতা এবং বিকৃত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা ভীষণ জরুরি।
ঋতুস্রাব একটা স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়া। নিয়মিত ঋতুস্রাব হওয়া অনেক রোগ-প্রতিরোধে সহায়ক। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা এখনো প্রতিমাসে পিরিয়ড চলাকালে এক সপ্তাহ স্কুল যাওয়া বন্ধ রাখে। কারণ অন্য কেউ যদি জানতে পারে তাহলে পিরিয়ড নিয়ে টিটকারি শুনতে হতে পারে। এসব মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সময় মেয়েরা স্কুলে বা ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। এই সংস্কৃতির কারণে সাংসারের বা সমাজের কতোটা ভালো হয় জানা নেই, তবে মেয়েটির পড়াশোনার অনেক বড় ক্ষতি হয়।
পিরিয়ড কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়। খুবই স্বাভাবিক ও সর্বজনীন প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতির জন্ম হয়েছে। সুতরাং যারা বাবা-মা বা পরিবারের অভিভাবক আছেন এবং যারা ভবিষ্যতে বাবা-মা বা অভিভাবক হতে যাচ্ছেন তারা অবশ্যই তাদের ছেলে সন্তানকে পিরিয়ডের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করবেন। তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম কখনো এমন কুৎসিত রসিকতায় লিপ্ত হবে বলে আশা করি না। বরং নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। সেইসঙ্গে কোনো নারীর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদী হয়ে উঠবে এবং অন্যকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে উৎসাহিত করবে।
পিরিয়ড নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা পরিবর্তন করার সময় এসেছে। পিরিয়ড চলাকালীন সময় যাতে কোনো নারী লজ্জা না পায়, বরং লজ্জা ভেঙে যাতে বেরিয়ে আসতে পারে, সে জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সুতরাং এটাকে ট্যাবু হিসেবে না রেখে রাষ্ট্রের উচিত পিরিয়ড পণ্য সহজলভ্য করা এবং ট্যাক্সের বেড়াজাল থেকে অবমুক্ত করা। সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের উচিত নারীর জন্য পিরিয়ডকালীন ছুটির ব্যবস্থা করা। সমাজের সকলের উচিত পিরিয়ডের যন্ত্রণাময় সময়গুলোতে মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা-প্রেমিকাসহ সকল নারীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সেনিটারি ন্যাপকিন বিক্রির জন্য ফার্মেসিগুলোতে নারীকর্মী রাখতে পারে। তাহলে মেয়েরা নির্বিঘ্নে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারবে। এছাড়া সমাজ থেকে পিরিয়ড সংক্রান্ত যাবতীয় কুসংস্কারকে সমূলে উপড়ে ফেলা দরকার। তার জন্য পিরিয়ড নিয়ে উন্মুক্ত পরিবেশে বেশি বেশি আলোচনা করা দরকার। সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে পিরিয়ড বিষয়ে সঠিক ধারনা পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে নারীকে দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গিয়ে লজ্জা পেতে হবে না। সমাজের প্রতিটি নারী-পুরুষের জানা প্রয়োজন নারীর পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব লজ্জা নয়, অহংকার।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ