নারীর গৌরবে রঙিন কান উৎসব

নন্দিতা আহমেদ
জমকালো আয়োজনে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৬তম আসরের পর্দা নেমেছে। প্রাচীন এবং প্রভাবশালী কান চলচ্চিত্র উৎসবের এ আসরটি বসে ফ্রান্সের কান শহরে। অস্কারের পর এটিকেই সিনেমার জন্য সবচেয়ে মর্যাদাবান স্বীকৃতি ভাবা হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসে সিনেমা, ছুটে আসেন নানা দেশের তারকাশিল্পী ও কলাকুশলীরা। দেড় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা এ উৎসবে বসে সিনেমা ও তারকাদের মেলা। লাল গালিচায় হেঁটে সবাই নিজ নিজ দেশের সিনেমা ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। প্রতিবারের মতো এবারেও জৌলুসের কমতি ছিল না। হাজির হয়েছিলেন জনি ডেপ, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, জেনিফার লরেন্স, নাটালি পোর্টম্যান, ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, আনুশকা শর্মাদের মতো তারকারা।

এবারের আসরে সেরা সিনেমা হিসেবে স্বর্ণপাম জিতে নিয়েছে ‘অ্যানাটমি অফ অ্যা ফল’। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন ফরাসী নির্মাতা জাস্টিন ত্রিয়েত। এ নিয়ে তৃতীয় কোনো নারী কানের সেরা পুরস্কার জিতে নিলেন। বিশ্ব সিনেমায় তার প্রশংসা চলছেই। তার এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে তুষারপাতে স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় জার্মান লেখক সান্ড্রা। আদালতে বিচারকার্যের সময় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। এর চিত্রনাট্য লিখেছেন জাস্টিন ত্রিয়েত ও আর্থার হারারি। এ সিনেমাটির সঙ্গে স্বর্ণপামের জন্য প্রতিযোগিতায় ছিল আরও ১৯টি সিনেমা ও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। বিজয়ী ছবির নির্মাতা জাস্টিন ত্রিয়েতের হাতে স্বর্ণপাম তুলে দেন আমেরিকান অভিনেত্রী জেন ফন্ডা।

লক্ষণীয় তথ্য হলো, এবার মূল প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে কান উৎসবের বেশিরভাগজুড়েই রয়েছে নারী নির্মাতাদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। এরমধ্যে মূল প্রতিযোগিতায় লড়ছেন ৭ নারী নির্মাতা। আর গোটা বিশ্বের সিনেমা স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাদপ্রদীপের নিচে তুলে ধরার জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসব চালু করেছে ‘লা সিনেফ’ বিভাগ। আয়োজন বিচারে উৎসবের বয়স এবার ৭৬ হলেও, লা সিনেফের বয়স মাত্র ২৬। সেখানেও পুরস্কার জিতে নিয়েছেন তিন নারী নির্মাতা। তারা হলেন ডেনমার্কের মারলেয়ানা এমিলিয়া লিংস্তা, দক্ষিণ কোরিয়ার হোয়াং হাইন এবং মরক্কোর জিনেব ওয়াকরিম।

গত ২৭ মে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল ভবন প্যালে ডে ফেস্টিভ্যালে বসে ৭৬তম এই আসরের সমাপ্তি অনুষ্ঠান। যেখানে উপস্থিত হন মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের সব বিচারক ও উৎসব কর্তৃপক্ষসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা। এবারের আসরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন দুইবার স্বর্ণপাম জয়ী সুইডিশ নির্মাতা রুবেন অস্টলান্ড। তার নেতৃত্বে বিচারক হিসেবে ছিলেন ‘ক্যাপ্টেন মারভেল’ তারকা ব্রি লারসন, আমেরিকান অভিনেতা পল ড্যানো, মরোক্কান পরিচালক মরিয়ম টুজানি, ফরাসি অভিনেতা দঁনি মিনোশেঁ, জাম্বিয়ান-ওয়েলশ পরিচালক-চিত্রনাট্যকার রুঙ্গানো নিয়োনি, আফগান কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার আতিক রহিমি, আর্জেন্টাইন পরিচালক দামিয়ান সিফ্রন এবং স্বর্ণপাম জয়ী ফরাসি পরিচালক জুলিয়া দুকুরনো।

এবার বিশেষ সম্মানসূচক স্বর্ণপাম জিতেছেন একাডেমি পুরস্কার ও গোল্ডেন গ্লোব বিজয়ী মার্কিন চলচ্চিত্র অভিনেতা ও প্রযোজক মাইকেল ডগলাস। ৭৮ বছর বয়সী এ অভিনেতার ক্যারিয়ারে আছে ‘দ্য চায়না সিনড্রোম’, ‘বেসিক ইন্সটিক্ট’, ‘ফলিং ডাউন’ এবং ‘বিহাইন্ড দ্য ক্যান্ডেলাব্রা’র মতো সাড়া জাগানো সিনেমা। এই চারটি ছবিই কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল। এছাড়াও ডগলাসের জনপ্রিয় আরও দুটি সিনেমা হলো ‘ওয়াল স্ট্রিট’ ও ‘ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন।’ সম্মাননা নিতে কান উৎসবে হাজির হয়েছিলেন ডগলাস। আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি তার দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বিশ্ব সিনেমার বৃহৎ শোকেস ৭৬তম কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অফিসিয়াল পোস্টারে স্থান পেয়েছেন বর্ষীয়ান ফরাসি অভিনেত্রী ক্যাথরিন দ্যুনোভ। ১৯৬৮ সালে তোলা হয় তার সাদাকালো ছবিটি। তিনি হলেন কিংবদন্তি ফিল্মমেকার মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নির স্ত্রী। তাদের মেয়ে ফরাসি অভিনেত্রী কিয়ারা মাস্ত্রোইয়ান্নি।

এবার কান উৎসব দেখিয়েছে বৈচিত্র্যময় জাতির সিনেমার সমৃদ্ধি। ইউরোপ আমেরিকার আধিপত্য ছিলই। পাশাপাশি আরব, আফ্রিকা, এশিয়াও দেখিয়েছে তাদের নির্মাণ ও সিনেমাশিল্পের জৌলুস। অনেকে জয় করেছে পুরস্কারও। তাদের ভিড়ে সেরা অভিনেতা হয়েছেন জাপানের ফুজি ইয়াকুশো, সেরা অভিনেত্রী তুরস্কের মারভে দিজদার। সেরা পরিচালকের স্বীকৃতি জিতেছেন ভিয়েতনাম ফ্রান্সের ট্র্যান আন হাং।
এবার বেশ ঘটা করে কান উৎসবে স্টল নিয়েছিল বাংলাদেশ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই স্টল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএফডিসি)। তবে সে স্টলে ছিল না উল্লেখযোগ্য কারো উপস্থিতি। সেখান থেকে প্রকাশ হয়েছে সাজ্জাদ খান পরিচালিত ‘কাঠগোলাপ’ সিনেমার পোস্টার। নিজের উদ্যোগে কানের বাণিজ্যিক শাখায় প্রদর্শিত হয়েছে অরণ্য আনোয়ার পরিচালিত পরীমনি অভিনীত ‘মা’ সিনেমা। এ ছাড়া উৎসবে ব্যক্তিগত আয়োজনে প্রকাশ করা হয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার ‘এমআরনাইন’ সিনেমার ট্রেলার।
একনজরে ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিজয়ীদের তালিকা

মূল প্রতিযোগিতা
স্বর্ণপাম: অ্যানাটমি অব অ্যা ফল (জাস্টিন ত্রিয়েত, ফ্রান্স), গ্রাঁ প্রিঁ: দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট (জনাথন গ্লেজার, যুক্তরাজ্য), সেরা পরিচালক: ট্র্যান আন হাং (দ্য পত অঁ ফু, ভিয়েতনাম/ফ্রান্স), জুরি প্রাইজ: ফলেন লিভস (আকি কাউরিসমাকি, ফিনল্যান্ড), সেরা অভিনেতা: ফুজি ইয়াকুশো (পারফেক্ট ডেজ, জাপান), সেরা অভিনেত্রী: মারভে দিজদার (অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস, তুরস্ক), সেরা চিত্রনাট্যকার: ইউজি সাকামাতো (মনস্টার, জাপান), ক্যামেরা দ’র: থিয়েন আন ফাম (ইনসাইড দ্য ইয়েলো কোকুন শেল, ভিয়েতনাম), সম্মানসূচক স্বর্ণপাম: মাইকেল ডগলাস, হ্যারিসন ফোর্ড।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র: টোয়েন্টি সেভেন (ফ্লোরা আন্না বুদা, ফ্রান্স ও হাঙ্গেরি), স্পেশাল মেনশন (স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি): ফার (কুন্নুর মার্তিন্সদত্তির স্লুতার, আইসল্যান্ড)
আঁ সাঁর্তা রিগা
সেরা চলচ্চিত্র: হাউ টু হ্যাভ সেক্স (মলি ম্যানিং ওয়াকার, যুক্তরাজ্য), জুরি প্রাইজ: হাউন্ডস (কামাল লাজরাক, মরক্কো), সেরা পরিচালক: আসমা এল মুদির (দ্য মাদার অব অল লাইস, মরক্কো), সেরা অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীর সম্মিলন : দ্য বুরিটি ফ্লাওয়ার (জোয়াও সালাভিৎসা, পর্তুগাল এবং রেনে নাদের মেসোরা, ব্রাজিল), ফ্রিডম প্রাইজ: গুডবাই জুলিয়া (মোহাম্মদ কোর্দোফানি, সুদান), নিউ ভয়েস অ্যাওয়ার্ড: অমেন (বালোজি, বেলজিয়াম/কঙ্গো)
লা সিনেফ
প্রথম পুরস্কার: নরওয়েজিয়ান অফস্প্রিং (মারলেয়ানা এমিলিয়া লিংস্তা, ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুল অব ডেনমার্ক), দ্বিতীয় পুরস্কার: হোল (হোয়াং হাইন, কোরিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম আর্টস), তৃতীয় পুরস্কার: মুন (জিনেব ওয়াকরিম, ইএসএভি মারাকেশ)

মুক্ত পুরস্কারের তালিকা
ফিপরেসি অ্যাওয়ার্ড
মূল প্রতিযোগিতা: দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট (জনাথন গ্লেজার, যুক্তরাজ্য), আঁ সাঁর্তা রিগা: দ্য সেটেলার্স (ফেলিপে গালভেজ আবের্লে, চিলি), প্যারালাল শাখা (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক): পাওয়ার অ্যালি (লিলা হালাহ, ব্রাজিল/প্রথম সিনেমা), ইকুমেনিকাল জুরি পুরস্কার: পারফেক্ট ডেজ (ভিম ভেন্ডার্স, জার্মানি)

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক
গ্র্যান্ড প্রাইজ (গ্রাঁ প্রিঁ): টাইগার স্ট্রাইপস (আমান্ডা নেল ইউ, মালয়েশিয়া), ফ্রেঞ্চ টাচ জুরি প্রাইজ : ইট’স রেইনিং ইন দ্য হাউস (পালোমা সারমন-দাই, বেলজিয়াম), লাইৎজ সিনে ডিসকভারি প্রাইজ (শর্ট ফিল্ম): বোলেরো (ন্যঁ ল্যাবোর-দ্যুজুরদা, ফ্রান্স), লুই রোদ্যুরের ফাউন্ডেশন রাইজিং স্টার অ্যাওয়ার্ড : জোভান গিনিচ (লস্ট কান্ট্রি, সার্বিয়া), গ্যান ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড ফর ডিস্ট্রিবিউশন: ইনশাল্লাহ অ্যা বয় (আমজাদ আল রশীদ, জর্ডান), ক্যানাল প্লাস অ্যাওয়ার্ড (শর্ট ফিল্ম): বোলেরো (ন্যঁ ল্যাবোর-দ্যুজুরদা, ফ্রান্স), এসএসিডি অ্যাওয়ার্ড: দ্য র‌্যাপচার (ইরিস ক্যালটেনব্যাক, ফ্রান্স)
ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট
সেরা ইউরোপিয়ান সিনেমা (ইউরোপা সিনেমাস লেবেল অ্যাওয়ার্ড): ক্রেয়াতুরা (এলেনা মার্তিন হিমেনো), সেরা ফরাসি ভাষার সিনেমা (এসএসিডি অ্যাওয়ার্ড): অ্যা প্রিন্স (পিয়ের ক্রোঁতো)
সেরা শর্টফিল্ম
ক্যারোস দ’র: সুলেমান সিসে

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × one =