নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সামাজিক সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন

সমাজের প্রথাগত ধারা ও ক্ষমতার অসমতা বদলে ভয়হীন ভবিষ্যৎ গড়ার আহ্বান জানিয়ে নারী ও কণ্যা শিশুর প্রতি সহিংসতার অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান বক্তারা। সামাজিক সম্মিলিত প্রয়াশই পারে সহিংসতার অবসানে ভূমিকা রাখতে।

বিশ্বব্যাপী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিরোধী ১৬ দিনের ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও কর্মসূচি শুরু করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। কর্মসূচির অংশ হিসেবে মানবাধিকার ভিত্তিক সংগঠনটি বুধবার ঢাকার গুলশানস্থ লেকশোর গ্র্যান্ডে একটি উচ্চপর্যায়ের জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে।

“নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই”– জাতিসংঘ ঘোষিত বৈশ্বিক এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আয়োজিত এ সংলাপে নীতিনির্ধারক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, উন্নয়ন সহযোগী, সাংবাদিক এবং তরুণরা অংশ নেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এমজেএফ-এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, নারীদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও দেশে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা এখনও ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান।

জানুয়ারি থেকে অক্টোবর ২০২৫ সময়কালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় – সহিংশতায় নারী মৃত্যুর ঘটনা ৫০৩টি এবং শিশুদের ওপর ৯০৫টি যৌন সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে। এছাড়াও, বাংলাদেশে ৭৮ শতাংশের বেশি নারী ডিজিটাল সহিংসতার শিকার, বিশেষত ফেসবুকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং মহিলা পরিষদের হিসাব থেকে।

শাহীন আনাম জোরালো আবেদন জানান, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতাকে জরুরি ও জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে দেখা দরকার।নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা (VAWG) কমাতে হলে নেতিবাচক সামাজিকধারা ও প্রথা যা সহিংসতাকে উৎসাহিত করে, সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে।পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং বিচারব্যবস্থাকে কার্যকর করা অত্যাবশ্যক।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে সংখ্যা বা পরিসংখ্যান পুরোটা গল্প বলে না, কারণ প্রতিটি যৌনসহিংসতার ঘটনায় একজন নারী, কন্যা বা শিশুর যন্ত্রণা ও ট্রমা লুকিয়ে থাকে।আমাদের তাদের কথা মনে রাখতে হবে এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার দৃঢ় সংকল্প নিতে হবে।

তিনি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তনে বিনিয়োগ, আইন বাস্তবায়ন শক্তিশালীকরণ, সরকারি সেবাখাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, ডিজিটাল নির্যাতন মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ, এবং সমতা, মর্যাদা ও অহিংসার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সামষ্টিক প্রচেষ্টার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা সংবাদে যে সহিংসতার খবর দেখি, বাস্তবে তার বাইরেও প্রতিদিন অসংখ্য সহিংসতা ঘটে, যা অনেক সময় প্রকাশই পায় না। ক্ষমতার অসমতা বা পাওয়ার ডায়নামিক্স–এর কারণে বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে খুবই অসহায় অবস্থায় থাকে।

নারীদের সত্যিকার ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে শুধু কর্মসংস্থান বা জীবিকার সুযোগ বাড়লেই হবে না; একই সঙ্গে নিরাপদ কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমাজের সবাইকে একসঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে, তবেই পরিবর্তন সম্ভব।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক সেলিম জাহান বলেন, সহিংসতা মোকাবিলায় আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায় থেকেই সচেতন প্রয়াস দরকার। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার পেছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ থাকলেও সবচেয়ে বড় কারণ হলো পুরুষের মানসিকতা। নারীদের বিশ্লেষণ ও বোঝার ক্ষমতা বেশি – এই ক্ষমতাই অনেক সময় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে অস্বস্তিতে ফেলে। ফলে নারীর ওপর অসমতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। যখন নারী প্রতিবাদ করে বা নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে, তখনই সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

এছাড়াও তিনি যুক্ত করেন, নারীর সাফল্য অনেক পুরুষকে শঙ্কিত করে, আর এ শঙ্কাই সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। নারীর অর্জন যেন সহিংসতার কারণ না হয়, এটা সমাজকে নিশ্চিত করতে হবে। এখন তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করেও সহিংসতা ঘটানো হচ্ছে; তাই ডিজিটাল সহিংসতা প্রতিরোধের উপায় জানতে হবে, সচেতন হতে হবে।

নারী-পুরুষ সমতার কথা উঠলেই এখনো অনেকেই আতকে ওঠেন; এমনকি কর্মঘন্টা কমানোর মতো যুক্তি তুলে নারীর সামনে অদৃশ্য বাঁধা তৈরি করা হয়। কিন্তু এভাবে নারীকে আটকে রাখা যাবে না। নারীর অধিকার ও সমতার পথ রুদ্ধ হলে সমাজ কখনো উন্নত হতে পারে না, যোগ করেন সেলিম জাহান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 10 =