নিজস্ব সম্পদ দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত জ্বালানি মিশ্রিণ নিশ্চিত করতে হবে – ইপি ওয়েবিনারে বক্তারা

রঙবেরঙ ডেস্ক: নির্ভরযোগ্য সরবরাহ ও সহনীয় দাম নিশ্চিত করার জন্য জ্বালানির বুদ্ধিদীপ্ত মিশ্রণের জন্য নিজস্ব সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তারপরও গ্যাসের মতো প্রাথমিক জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে। এই চাপ কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বৈশ্বিক। ফলে এতে করে স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় সংকট হবে না। তবে আমদানি নির্ভরতার কারণে গ্যাসের পুরো বাড়তি দাম শিল্পের উপর চাপানোর কোনো সুযোগ নেই। সেখানে পরিকল্পিত সাবসিডি অব্যাহত রাখতে হবে। আবার সরকারি খাতে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে যে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে তার দামও যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করতে হবে। একই সাথে তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের কাজ যুদ্ধকালীন পরিকল্পনায় শুরু করতে হবে। আর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করে নিজস্ব কয়লাসম্পদ তুলে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। যা গ্যাসের উপর একক চাপ অনেকাংশে কমিয়ে আনবে।

“গ্যাস সংকটকালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ ও শিল্প খাতে এর চ্যালেঞ্জ” শিরোনামে এনার্জি এন্ড পাওয়ার আয়োজিত ওয়েবিনারে বক্তারা এমন মতামত তুলে ধরেছেন। তিরিশ দিনের কাগজ রঙবেরঙ এবং মাসিক কাগজ ফুড অ্যান্ড ফার্মার সহায়তায় আয়োজিত এই ওয়েবিনারে বক্তারা আরো বলেন, বাড়তি দামে মাত্র ৫ শতাংশ এলএনজি আমদানির কারণে মিশ্রিত গ্যাসের দাম এত পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি যৌক্তিক নয়। তারা দেশের স্থলভাগে তেল গ্যাস পাওয়ার জন্য বার্ষিক কমপক্ষে ১০টি অনুসন্ধান কূপ খননে বিশেষ বরাদ্ধ ও পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, আঞ্চলিক সহাযোগিতার মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানে বিনিয়োগ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানি করার উদ্যোগকে আরো জোরদার করতে হবে।

ইপি সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেনের সঞ্চালনায় এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। মুখ্য আলোচক ছিলেন আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার আবদুস সালেক সূফি। আলোচক হিসাবে কথা বলেছেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও বাংলাদেশ এনার্জি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জি. মিজানুর রহমান, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভলপমেন্ট (বিল্ড) এর চেয়ারপারসন আবুল কাসেম খান, এফবিসিসিআই এর জ্বালানি ও পরিসেবা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও এনার্জিপ্যাকের সিইও হুমায়ুন রশীদ এবং ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অরুণ কর্মকার।

প্রফেসর ইজাজ হোসেন বলেন, সিস্টেম লস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটা আসলে চুরি। অন্ততপক্ষে ৮% ভাগ সিস্টেম লস বা চুরি হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। এনার্জি এফিশিয়েন্সি কিছুটা বেড়েছে তবে পুরোপুরি হয়নি। এটা বাড়াতে হবে। এখন গ্যাস খুবই মূল্যবান। এলএনজি আমদানি করব, দাম যাই হোক না কেন বিক্রি করবÑ এই মনোভাব ভুল চিন্তা। সেক্ষেত্রে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান না করে আমদানিতে যাওয়া বড় ভুল হয়েছে। নিজেদের কয়লা না তোলা আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত। পরিবেশের ক্ষতি আমরা মোটেই করি না। আমরা বরং গ্যাসের উপর নির্ভর করে থেকেছি। আরেকটি বিষয় হলো গ্যাস ব্যবহার করে সার তৈরি করব কিনা তাও ভাবা প্রয়োজন। উত্তারিধার সূত্রে পাওয়া গ্যাস, যার দাম অনেক কমÑ তা কে ভোগ করবে তাও আমাদের ঠিক করতে হবে। শিল্প, গৃহস্থালী, সার না বিদ্যুৎ কোন খাতে ব্যবহার হবে তা ঠিক করতে হবে। যেখানে সর্বজনীন সুবিধা হয় সেখানেই ‘লিগাসি’ গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্যাসের উপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে পারিনি। যদিও গ্যাস এখন আর অফুরন্ত নয়। বর্তমানে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তায় আমরা বিনিয়োগ করতে পারিনি। বিদ্যুৎ আমদানি বা হাইড্রো এনার্জি বাড়াতে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সোলার এখনও ১০% ও যেতে পারিনি। শুধু গ্যাসের উপর নির্ভরতার মূল্য এখন দিতে হচ্ছে। বর্তমানে সাবসিডির পরিমাণ ৩ গুণ বেড়ে গেছে। এটা যুক্তিসঙ্গতভাবে দেখতে হবে। এখানে ব্যালেন্স করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শিল্পের জন্য ট্যারিফ বেশি, গৃহস্থালিতে কম। এটা কম-বেশি করা যেতে পারে। বাণিজ্যিক জায়গায় কিছুটা কমিয়ে গৃহস্থালিতে বাড়ান যেতে পারে। ট্যারিফ র‌্যাশনালাইজেশন ফান্ড করা প্রয়োজন। যখন দাম কম থাকবে তখন কিছু অর্থ জমাতে হবে। যখন দাম বাড়বে তখন সাবসিডি দিতে হবে। জ্বালানিখাতে ব্যক্তিখাতকে আরও যুক্ত করা যেতে পারে। গ্যাসের উপর চাপ কমাতে কয়লাকে বিবেচনায় নিতে হবে।

ইঞ্জি. মিজানুর রহমান বলেন, নিজস্ব সম্পদের স্বল্পতার কারণে জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। এখন গ্যাসের দাম যে ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই দাম সমন্বয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৩ বছর পর। আমি মনে করি প্রতি বছর জ্বালানির দাম সমন্বয় করা উচিত। আর গ্যাসের যে উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে খরচ তার পুরোটা ভোক্তার উপর চাপানো সঠিক হবে না। আগেও তা করা হয়নি। এবারও বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

আবুল কাশেম খান বলেন, আমরা যদি পুরো আমদানি করা জ্বালানির উপর নির্ভর করি তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বর্তমানে দেশের যে অর্থনীতি, উন্নয়ন প্রক্রিয়া এতে করে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দেশে গ্যাস পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা অনুসন্ধানে সঠিক উদ্যোগের অভাব আছে। প্রাকৃতিক কয়লা ফেলে রাখা কতটুকু যৌক্তিক তাও ভেবে দেখা দরকার। কারণ আমাদের কার্বন নিঃসরণ তেমন কিছু নয়। বহুদেশ কয়লার উপর নির্ভর করে উন্নয়ন করেছে। শুধুমাত্র কয়লা দিয়ে দেশের ৭৫ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বিষয়টি সকলের নতুন করে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

হুমায়ুন রশীদ বলেন, দেশের শিল্পখাত জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার ব্যবহার করার জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু একধাপে গ্যাসের দাম বিপুল পরিমাণ বাড়ানো হলে তার দায় শিল্প সামাল দিতে পারবে না। মনে রাখতে হবে শিল্পে ৫ টাকা সাবসিডি দিলে প্রবৃদ্ধিতে ৩৫ টাকার অবদান যোগ হতে পারে। জ্বালানি মূল্য ও সরবরাহ নিয়ে সরকার দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা দিতে না পারলে এডিআই ও স্থানীয় বিনিয়োগ উভয় বিঘ্নিত হবে। সর্বপরি নিজস্ব সম্পদ অনুসন্ধান আর আহরণ না করে কেবল আমদানি নির্ভরতা সঠিক পথ হতে পারে না।

খন্দকার আবদুস সালেক বলেন, বর্তমানে গ্যাস মিশ্রণে ৭৮% নিজস্ব গ্যাস ২২% আরএলএনজি। তার মাত্র ৫% স্পট বাজার থেকে আমদানি করা। ফলে বিপুল পরিমাণ দাম বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমান যেতে পারে। পেট্টোবাংলার গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। এমন বিকল্প চিন্তা করতে হবে। শিল্পখাতে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুন করলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামনের তিন বছর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উত্তরণের পথে বাধা যেন না হয় সেজন্য গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সেভাবে বিবেচনা করতে হবে।

তিনি বলেন, সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা হলে স্থলভাগেই আরো ৮-১০ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাপেক্স এটা এককভাবে করতে পারবে বলে মনে হয় না। কয়লা না উঠান এখন বুমেরাং হয়েছে। শিল্প উদ্যোক্তাদের মনে রাখতে হবে কোয়ালিটি জ্বালানি পেতে হলে মূল্য কিছুটা বাড়াতেই হবে। তাই শিল্প যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না সেই বিবেচনায় সাবসিডিও দিতে হবে। কিন্তু তা যাতে অপচয় না হয় এটাও দেখতে হবে।

অরুণ কর্মকার বলেন, গ্যাসের চুরি এবং অদক্ষ ব্যবহার বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে আমরা নিজস্ব গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ না করে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে সঠিক কাজ করিনি। তিনি মনে করেন, দেশের বেঙ্গল বেসিন ও কিছু আবিষ্কার হওয়া সুরমা বেসিনে পরিকল্পিতভাবে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করা হলে আরো ৮ থেকে ১০ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া সম্ভব।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 1 =