নৃত্যের বাতিঘর শিবলী মোহাম্মদ

মৌ সন্ধ্যা

শিবলী মোহাম্মদ, আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের এক ধ্রুবতারার নাম। তিনি  ক্ল্যাসিকাল ‘কত্থক’ ধারার একজন অন্যতম প্রধান নৃত্যশিল্পী। এ দেশের পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে তার তুলনা নেই। যার নৃত্য দর্শককে সম্মোহিত করে রাখে। নৃত্যে জনপ্রিয় হওয়া পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে শিবলী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শহীদ পিতার সন্তান

শিবলী মোহাম্মদের জন্ম ৪ এপ্রিল, ঢাকায়। পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচার ইউনিয়নের নয়াকান্দি গ্রামে। বাবা সলিমুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। মা জেবুন্নেসা। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদ তার বড় ভাই।

শিক্ষাজীবন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেছেন শিবলী মোহাম্মদ। শিবলী ছায়ানট থেকে নিয়েছেন নৃত্যশিক্ষা। তিনি ছায়ানটে কার্তিক সিং, অজিত দে এবং অনিতা দে’র কাছ থেকে নৃত্যের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। পরে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে লক্ষেèৗয়ের ভাটখণ্ডে মিউজিক কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তার শিক্ষক ছিলেন পূর্ণিমা পাণ্ডে। নয়াদিল্লির কত্থক কেন্দ্রে কিংবদন্তি পণ্ডিত বীরজু মহারাজের অধীনে কত্থক নৃত্যে পরিপূর্ণ তালিম নেন শিবলী মোহাম্মদ। তিনিই ছিলেন এ কেন্দ্রের প্রথম বাংলাদেশি ছাত্র। পরে যুক্তরাজ্যে লন্ডন ব্যালে থিয়েটারে ব্যালে, ট্যাপ ও জ্যাজ নৃত্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

কর্মজীবন

শিবলী মোহাম্মদের কর্মজীবন বেশ বর্ণিল। তার হাত ধরে তৈরি হয়েছে অনেক নৃত্যশিল্পী। দীর্ঘদিন শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে শামীম আরা নিপার সাথে বিটিভিতে ‘তারানা অন’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন। শিবলী মোহাম্মদ নৃত্য সংস্থা ‘নৃত্যাঞ্চল’এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ২০০২ সালে শুরু হওয়া এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী নৃত্য শিখছে। ৫০টিরও বেশি দেশে শিবলী মোহাম্মদ নৃত্য পরিবেশন করেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নৃত্য প্রতিযোগিতায় তিনি বিচারক হিসেবেও কাজ করেছেন।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

নৃত্যশিল্পী হয়ে অনেক দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছেন শিবলী মোহাম্মদ। ২০২৪ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। সেরা বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার। এছাড়া পেয়েছেন জর্জ হ্যারিসন পুরস্কার, যায়যায়দিন পুরস্কার, বাসাস পুরস্কার, প্রথম আলো পুরস্কার ও লাক্স চ্যানেল আই পুরস্কার।

একুশে পদকপ্রাপ্তি নিয়ে কিছু কথা

দেশের নৃত্যকলা থেকে এমন গৌরবের অধিকারী খুব বেশি নৃত্যশিল্পী হননি। যিনি ভারতীয় কত্থক নৃত্যকে দিয়েছেন এক অনন্য মাত্রা। আবার তিনি যাকে তার নৃত্যকলার জন্য জুটি হিসেবে বেছে নিয়েছেন সেই শামীম আরা নিপাও কত্থক নৃত্যকে দিয়েছেন এ দেশে এক ভিন্ন মাত্রা। তাদের যুগল নৃত্য এ দেশের নৃত্যাঙ্গনকে যতটা বিনোদন দিয়েছে তেমন জুটি নৃত্য বোধ হয় আর কারও মধ্যেই দৃশ্যমান হয়নি।

শিক্ষকতা 

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ভিন্নধারার শিক্ষালয় রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগে সাম্মানিক শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন শিবলী মোহাম্মদ। শিবলী মোহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ভিন্নধারার বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত, নাট্যকলা, ফ্যাশন ডিজাইনের পাশাপাশি নৃত্যকলা বিভাগ চালুর মাধ্যমে সৃজনশীলতার চর্চাকে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে প্রতিষ্ঠার পথ প্রসারিত হলো। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে বাংলাদেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নৃত্যকলা বিভাগ খোলার অনুমতি পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।’

বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ

সাদি মহম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ পিতার সন্তান। বাবার নাম শহীদ সলিমুল্লাহ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তার নামে একটি রাস্তা। গর্বিত বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে শিবলী মোহাম্মদ এক গণমাধ্যমে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সেই বাড়িটা এখনো আছে। তবে আগের সেই বাড়ির কনক্রিটের কাঠামো ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। একাত্তরের ২৬ মার্চ অবাঙালিরা এই বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেদিন এই বাড়ির সামনেই হত্যা করে আমার পিতা শহীদ সলিমুল্লাহকে। বাসার পাশের মসজিদের ইমামের কাছ থেকে শুনেছি যে, রাতে আর্মিরা আসে। আমার বাবার মৃতদেহটা অনেকের সঙ্গে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে মাটি চাপা দেয়। ঐ জায়গাটিকে আমরা এখন বাবার কবর হিসেবে জানি।’

জীবন সংগ্রামের দিনগুলো

নিজেদের জীবন সংগ্রামের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে একবার এক গণমাধ্যমকে শিবলী বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরে শহীদ পরিবার হিসেবে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সাহায্য আমরা পাইনি। আবেদন জানিয়েও পাইনি। সংগ্রামটা করেছেন আমার মা। তিনি সেলাইয়ের কাজ জানতেন। তার সেলাইয়ের কাজই হয়ে উঠে আমাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। আমাদের ১০ ভাইবোনকে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করেছেন। বড় করে তুলেছেন। রাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা এতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, অথচ কেউ আমাদের খোঁজও রাখেনি। বরং আমাদের পৈত্রিক বাড়িটিকে বিহারিদের সম্পত্তি হিসেবে দেখানোরও পাঁয়তারা হয়েছে। মামলা হয়েছে, মামলায় অবশ্য আমরাই জিতেছি। বিএনপি আমলে আমরা বার বার হয়েছি বঞ্চনার শিকার। আমাদের দুই ভাই সেই আমলে ছিলাম কালো তালিকাভুক্ত শিল্পী। শিল্পকলা একাডেমিতে নাচের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমাকে এমন অপদস্থ করা হতো যে, শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়ার অপরাধে বিএনপি-জামায়াত আমলে আমরা ছিলাম সরকারিভাবে নিষিদ্ধ শিল্পী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সেই কালো তালিকা সাদা হয়নি অনেকদিন। আওয়ামী লীগের আমলেও সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদের ডাকা হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সাদি মহম্মদের আর নৃত্যশিল্পী হিসেবে যদি আমার একটা অবস্থান না থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই দেশে-বিদেশে পারফর্ম করার জন্য এত আমন্ত্রণ পেতাম না। নিজেদের পরিচয়েই এখন আমরা এগিয়ে যেতে চাই।’

শিবলী মোহাম্মদের ভাষ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে কতটা কঠিন দিন পার করেছে তার পরিবার। সম্প্রতি ভাই সাদি মহম্মদকেও হারিয়েছেন। সব শোক কাটিয়ে আরও বহুদূরে নিজের জ্যোতি ছড়াক আমাদের প্রিয় নৃত্য শিল্পী ও নৃত্যের বাতিঘর।

সাদি মহম্মদের একুশে পদক না পাওয়া

পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এ মাধ্যমে সেরকম বিতর্কের অবকাশ নেই। যেমন, সঙ্গীতে শিবলী মোহাম্মদের বড় ভাই সাদি মহম্মদ এ দেশের রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথিতযশা শিল্পী ছিলেন – এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। যিনি ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মহাতারকা। কিন্তু তারপরেও তাকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকের মতো বড় মাপের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। অথচ রবীন্দ্রসঙ্গীতে ইতিপূর্বে এমন অনেকে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন যেখানে তাদের আগেই সাদি মহম্মদ এই পদকে ভূষিত হতে পারতেন। সেটা পাননি, ভবিষ্যতে হয়তো মরণোত্তর পুরস্কার হিসেবে এই পদকে ভূষিত করা হবে। কিন্তু তখন সে পুরস্কারে কার কি আসে যায়। তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে সাদি মহম্মদকে বারবার এ পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে সেটা হয়তো তারাই ভালো বলতে পারবেনÑ যারা এর নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত আছেন। তবে শিবলী মোহম্মদকে আরো অন্যান্যদের সঙ্গে যেদিন এই পুরস্কারে ভূষিত করা হবে সেদিন সেই অনুষ্ঠানে সাদি মহম্মদ লজ্জাতেই যাননি। এ থেকেই আন্দাজ করা যায়, নিজেকে নিয়ে তিনি কী মনোবেদনার মধ্যে ছিলেন। তবে বড় ভাইয়ের এই না পাওয়া বেদনা ছোট ভাই হিসেবে শিবলী মোহাম্মদকেও কম দগ্ধ করেনি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের অনেক অভিমান ছিল। ও মনে করত, তাকে মূল্যায়ন করেনি। আমরা বোঝাতাম, তোমাকে হাজার কোটি লোক ভালোবাসে। তোমার গান ভালোবাসে। এটাই তো তোমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কী হবে এত পদক দিয়ে, এত কিছুই তো মানুষ পায়। আমার ভাইকে নিয়ে কখনো কেউ ভাবেনি। এটা নিয়ে ওর মনে অনেক কষ্ট ছিল। ওর অনেক সময় অভিমান হতো এটা হয়নি, ওটা হয়নি। বোঝাতাম, দরকার নেই। আমরা তো কিছু প্রাপ্তির জন্য কাজ করি না। ভালোবেসে আমরা কাজ করি। অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ভেতরে ছিল চাপা কষ্ট।’

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × 1 =