শবনম শিউলি
২০২৪ সালের আগে ২০১৮ সালেও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। কিছুতেই যখন এই আন্দোলন থামানো যাচ্ছিল না, তখন ১১ এপ্রিল সংসদে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্ভবত এটি ‘আবেগপ্রসূত’ বা ‘বিরক্তিবশত’ একটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি নিজেও পরে স্বীকার করেছেন। তবে সেই আন্দোলনের পর কোটা পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদে সব রকম কোটা বাতিলের ঘোষণার পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে যে নির্বাহী পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
হাইকোর্ট ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর এই কোটা পরিবর্তনের পরিপত্রটিকে বাতিল করে দেন। এই আপিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হওয়ার প্রথম তারিখটি ঠিক হয় ৪ জুলাই। ৪ জুলাই আদালত যখন শুনানি আরও এক মাস পিছিয়ে দিলেন, তখন ছাত্রদের আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। ৬ জুলাই কোটাবিরোধীরা অবশেষে সারা দেশে ‘বাংলা বন্ধের’ ডাক দেন। ১৪ জুলাই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এরপর ১৬ জুলাই সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পাল্টাপাল্টি হামলা ও পুলিশের গুলিবর্ষণে ওই দিনই নিহত হন ৬ জন। আন্দোলনকারীদের কাছে শহীদের মর্যাদা পেয়ে যান রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এভাবেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ১৮ জুলাই থেকে রাজপথে নেমে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের সকল শিক্ষার্থীরা। তেমনই একজন শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ৮১ ব্যাচের শিক্ষার্থী তিনি।
নুসরাত আর দশজন শিক্ষার্থীর মতোই একজন আন্দোলনকারী। কিন্তু তার সাহসিকতা আর দৃঢ়তা তাকে আলাদা করেছে। এই মেয়েটি তার অদম্য সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন তার সহযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য। তার দৃঢ় কণ্ঠ একবারের জন্যও টলেননি পুলিশের গাড়ির সামনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে সারাদেশ দেখেছে তার রুখে দাঁড়ানোর চিত্র। পুলিশ ভ্যানের সামনে একা দাঁড়িয়ে এক নারী বলছিলেন, চালান! আমার উপর দিয়ে গাড়ি চালান। হ্যাঁ ৩১ জুলাই পুলিশের ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া মেয়েটির নাম নুসরাত।
ঘটনার দিন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্য সব শিক্ষার্থীর মতো নুসরাতও হাজির হয়েছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে। সেদিনের গন্তব্য হাইকোর্ট আর কর্মসূচি ছিল মার্চ ফর জাস্টিস। নুর হাসান, ইফাজ, বিধান, ওমাইদাসহ আরও অনেকের সঙ্গে নুসরাতও রওনা দেন হাইকোর্টের দিকে। পথে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী। এক সময় তারা পৌঁছে যান হাইকোর্টের সামনে।
হাইকোর্টের সামনে সেদিন আইনজীবীরা প্রতিবাদ করছিলেন। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষার্থীরা ছিলেন তাদের সঙ্গে। পৌঁছানোর প্রায় ১০ মিনিট পর দুজন টহল পুলিশ সাতজনের দলটিকে দেখে ফেলে। এই সাতজনও বুঝতে পারেন, তারা টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। সরে যাওয়ার আগেই পুলিশ এসে তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। ফলে সবাই বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছেলেদের আটক করতে থাকে। নুসরাতের পাশে তখন দাঁড়িয়ে ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই নুর। তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় নুসরাত তার হাত ধরে রাখেন, পুলিশকে বাধা দেন। একসময় একজন পুলিশ সদস্য নুসরাতের হাতে আঘাত করেন। ফলে তার হাত ছুটে যায় এবং নুরকে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু হাল ছাড়েননি নুসরাত। ছুটে এসে আবার নুরকে ধরেন তিনি। পুলিশ আর নুসরাতের টানাহেঁচড়ার একপর্যায়ে আবারও নুরের হাত ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে নুসরাতের পক্ষে। এবার তিনি নুরের বেল্ট ধরে ফেলেন।
এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হন সাংবাদিকেরা। তারা ছবি তুলতে থাকেন। পুলিশ এক সাংবাদিককে লাথি মারে। এতে সাংবাদিকরা পুলিশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সে সময় কেউ একজন সেখান থেকে নুসরাতকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এর পরেও পুলিশ নুরসহ অন্য ছেলেদের ভ্যানে তোলে। এর প্রতিবাদে নুসরাত একা দাঁড়িয়ে যান পুলিশের গাড়ির সামনে। দুই হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন গাড়িটি। কাঁধে ব্যাগ আর চোখে চশমা পরে পুলিশের গাড়ির সামনে প্রতিরোধের আইকন হয়ে ওঠা নুসরাতের ছবি ছড়িয়ে যায় সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পুলিশ অন্যায়ভাবে কাউকে আটক করতে পারে না। তাদের উপরে এমন হামলা হওয়ার কারণে সেদিন রুখে দাড়িয়েছিলেন নুসরাত। তিনি জানতেন না, তার সেই প্রতিবাদী ভঙ্গি হাজারো মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলবে। হাজারও শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করে তুলবে আন্দোলন আরও জোরদার করার। পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়ানো নুসরাতকে নিয়ে আঁকা হয়েছে কার্টুন ও দেয়াল চিত্র। আজ দেশের অনেক স্থানের দেওয়ালে স্থান পেয়েছে নুসরাতের প্রতিবাদের প্রতীকি ছবি। আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে তার এমন আচরণ।
পরিবার নুসরাতের নিরাপত্তা নিয়ে ভেবেছিল। তবে বাধা দেননি। তারা হয়তো জেনে গিয়েছিলেন, এমন মেয়েকে কোনো কিছুর ভয় দেখিয়ে আটকে রাখা সম্ভব নয। বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশমাতৃকার মুক্তি অসম্ভব।’ এই আন্দোলনে নুসরাতের মতো আরও অসংখ্য মেয়ে এই কথাটিকে বারবার প্রমাণ করেছে। তারা রুখে দাড়িয়েছে দৃঢ়তা নিয়ে। কথা বলেছে অধিকার নিয়ে। পক্ষ নিয়েছে ন্যায়ের। আর তাই অর্জিত হয়েছে বিজয়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ